বিজ্ঞাপন

ভারত বিদ্বেষের ‘ক্রিকেটিয় পোস্টমর্টেম’

July 11, 2019 | 8:05 pm

রফিকুল্লাহ রোমেল, ম্যানেজিং এডিটর, সারাবাংলা ডট নেট

আমি নিজেও এখন ভারত  ‘ক্রিকেটে’ হারলে খুশি হই। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে পাকিস্তান হারার চাইতেও বেশি খুশি হয়। এই খুশি হওয়ার পেছনে খুবই সুনির্দিষ্ট একটি কারণ রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

ভারতের হারে মানুষের খুশি হওয়ার পেছনে কিছু কারণ ইদানীং দেখা যায়। যার মধ্যে অন্যতম একটি কারণ ‘পাকিস্তানের সমর্থক’  মানসিকতা থেকে বের হতে না পারা। যাদের একটা বিশাল অংশ ৭৫-৯৫ এ বড় হওয়া ব্রেইনওয়াশড জেনারেশন। যারা ‘ধর্মীয় কারণ’ আর দ্বিজাতিতত্ত্বের কুইনাইনের বাইরে কথিত ক্রিকেটবোদ্ধা এবং প্রগতিশীল গ্রুপের অংশ । ‘ক্রিকেটে’ ভারতকে তাদের কখনোই পছন্দ ছিল না। এছাড়াও অন্য যে কারণগুলো দেখা যায় তা হলো- ভারতের খেলোয়াড়দের ঔদ্ধত্য (যদিও কোহলি ছাড়া কোন উদাহরণ নেই), গত বিশ্বকাপে ‘নো বল ইন্সিডেন্স’ (যেটা পাকিস্তানের আম্পায়ার দিয়েছে) ইত্যাদি। পাশাপাশি আরও তিনটে কারণ পাওয়া গেছে –

১) আইসিসি মানেই ভারত। তাদেরকে সুবিধা দেওয়ার জন্যই ‘প্রতিটা পদক্ষেপ’ আইসিসি ভারতকে চিন্তা করে নেয়।

২) ভারত বাংলাদেশকে খেলতে ডাকে নাই বা ডাকলে খেলতে আসে নাই।

বিজ্ঞাপন

৩) ভারত তার নিজের খেলোয়াড়দের বিপিএল-এ খেলতে দেয় না কিন্তু পাকিস্তানের খেলোয়াড়দের খেলতে দেওয়া হয়।

আইসিসি যে ভারতকে বেশ কিছু সুবিধা দেয় সেটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নাই। এই যে এবারের বিশ্বকাপে পাঁচ তারিখে ভারতের প্রথম খেলা হল, তত দিনে অন্য কোনো কোনো দল তিনটি খেলাও খেলে ফেলেছে। আইসিসির আর্থিক বিষয়গুলোতে ভারতের সুস্পষ্ট প্রাধান্য আছে। সেটার বড় কারণ আইসিসির টোটাল রেভিনিউর প্রায় ৬৫% সরাসরি ভারতের মার্কেট থেকে আসে।

কিন্তু এগুলো বাদ দিলে আইসিসি খেলার মধ্যে সরাসরি ভারতের পক্ষ নিয়েছে এমন ঘটনা কি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত?

বিজ্ঞাপন

আইসিসির দুটো বিশ্বকাপ, একটা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি বা দুটো টি-২০ বিশ্বকাপের কোনোটাতেই তো ভারত জেতে নাই। বরং তাদেরকে দক্ষিণ আফ্রিকার চাইতেও বড় চোকার্স মনে হয়েছে।

এই পুরো সময় ভারত দল হিসেবে তো খারাপ ছিল না। এই ছয় বছরে লিমিটেড ওভারে তারা ধারাবাহিকভাবে এক অথবা দুই নম্বর দল। আগে বিদেশে সিরিজ জিততো না। এখন নিয়মিতই জিতছে। ইন্ডিভিজুয়ালি তাদের ব্যাটসম্যান ও বোলাররা সবাই র‍্যাংকিং এর শীর্ষে আছে। নিজেদের মাটিতেও বড় টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছে। এত কিছুর পরেও তারা চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। ফাইনালেই যায় নাই গত দুই বিশ্বকাপে (২০১৯ এবং ২০১৫)। অথচ ভারতের এই দলকে আইসিসি একটু হালকা-পাতলা বোনাস দিয়ে দিলেই তো তারা চ্যাম্পিয়ন হয়ে যেতো। সেজন্য তো পুকুর চুরিও করতে হয় না।

যেমন ধরুন বুধবারের (১০ জুলাই) খেলায় বিরাট কোহলির এলবিডব্লিউ। খালি চোখে দেখে অন্তত ৯৯% ক্ষেত্রে আম্পায়াররা ওইরকম ফরোয়ার্ড মুভে হাইট ইস্যুতে আউট দিতেন না। প্রায় সব ধরনের প্রিসিডেন্স তাই বলে। এই বিশ্বকাপেই ক্লিপিং দ্য বেলস ইস্যুতে ভারতের তিনটি রিভিউ খারিজ হয়েছে।

এখন আম্পায়ার যদি কোহলিকে আউট না দিতেন, উইলিয়ামসন আর বোল্ট রিভিউ নিলেও কোহলি আউট হতেন না। বল স্পষ্টতই উইকেটের অল্প অংশ ছুঁয়ে ছিল। তো ভারত যদি ১৩ জন নিয়েই মাঠে নামে, তাহলে এই সিদ্ধান্ত এমন হওয়ার কথাই না। পার্টিকুলার রেসিস্ট চোখ দিয়ে খেলা না দেখে যারা খেলা দেখেন, তাদের জানা থাকার কথা যে এরকম ফেভার ভারত পাচ্ছে বা শুধু ‘ভারতই’ একা পাচ্ছে এমন কোন তথ্য কারো কাছে নাই।

বিজ্ঞাপন

ভারতের খেলোয়াড়রা বিপিএল খেলতে আসে নাই। ঠিক আছে বুঝলাম। তা ভারতের খেলোয়াড়েরা কি অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশ খেলে? বা ক্যারিবিয়ান লিগ? পিএসএল? কোন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগটা তারা খেলেছে?

আর ভারত বিপিএলে প্লেয়ার পাঠায় নাই বুঝলাম। বিপিএলে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড এমনকি নিউজিল্যান্ড আর সাউথ আফ্রিকার প্রথম সারির কয়জন খেলেছে? সমস্যা টা কি শুধু ভারতের?

বিগত সময়ে ভারত সফরে গিয়ে বাংলাদেশ মাত্র একটি টেস্ট খেলেছে। এটা খুব খারাপ কথা আর অন্যায় হয়েছে। একই সময়ে আমরা কতবার নিউজিল্যান্ড গিয়েছি? ২০১৯ এর সফরসহ চার বার (২০০১-২০০২, ২০০৭-২০০৮, ২০০৯-২০১০, ২০১৬-২০১৭, ২০১৮-২০১৯)।  ইংল্যান্ডে কতবার? ২০০৫ এ একবার এবং ২০১০ এ একবারসহ মোট দুইবার । সাউথ আফ্রিকায় কয়বার ? প্রথমবার করেছিল ২০০২-২০০৩ সিরিজে, ২০০৮-২০০৯ সিরিজ এর পরে ২০১৭-২০১৮ সিরিজসহ ৩ বার। । বাংলাদেশ আসলে দেশের বাইরে শ্রীলঙ্কা (৫ বার) আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ (৪ বার) ছাড়া কার সঙ্গেই বা খেলার সুযোগ পায়? জিম্বাবুয়ের সঙ্গে আমরা তাদের মাটিতে খেলেছি ৪টা টেস্ট সিরিজ। নিরাপত্তা জনিত কারণে বিশ্বের সকল দেশ যখন পাকিস্তানে খেলা বর্জন করে সেই সময় থেকে বাংলাদেশও সেখানে খেলে না। তা সেই পাকিস্তানে কয়টা সিরিজ খেলার সুযোগ পেয়েছিল বাংলাদেশ? মাত্র একটা। অস্ট্রেলিয়া কয়টা সিরিজে বাংলাদেশকে আতিথেয়তা দিয়েছিল? জানেন কি? সেই ২০০৩ সালে একবার একটি সিরিজ অনুষ্ঠিত হয়েছিল যেখানে প্রচুর অপমানজনক কথা বাংলাদেশকে নিয়ে বলা হয় সিরিজের শুরুতে। মাঠের পারফরম্যান্সের পরে যদিও তা কিছুটা থামে। কিন্তু এর পরে আইসিসির এফটিপি সূচিতে থাকলেও অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশের সঙ্গে সিরিজ খেলেনি এমন উদাহরণও কিন্তু আছে।

বাংলাদেশে ভারত একদিনের আন্তর্জাতিক সিরিজ খেলেছে পাঁচ বছরে দুই বার। একবার তাদের বিকল্প খেলোয়াড়দের দল নিয়ে। যেটির কাছেও আমরা হেরে যাই। কিন্তু এশিয়া কাপে খেলতে এসেছে তিনবার। কারো মনে এই প্রশ্নটি আসেনি যে ছয় বছরের মধ্যে যে চারটা এশিয়া কাপ বাংলাদেশে হয়েছে তার পেছনে সব চেয়ে বড় সাহায্য কার? এশিয়া কাপে সিঙ্গেল লিগ থেকে ডাবল লিগ করাই হয়েছে যেন নিজেদের মধ্যে খেলা বেশি হয়, দ্বিপাক্ষিক সিরিজ না হয়ে। এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলে কিন্তু বিগ থ্রি নাই……বিগ ওয়ান!

তো সব কিছু মিলিয়ে ভারত সাপোর্ট না করার পেছনে কাকতাড়ুয়া কারণ দাঁড় করাবার কারণটাও বোধগম্য নয়।

আমি শুরুতেই বলেছি একটি খুব স্পেসিফিক কারণে আমিও ‘ক্রিকেটে’ ভারত সাপোর্ট করি না। তার কারণ আমি মনে করি ভারতের প্রধান আর প্রবল এশিয়ান প্রতিপক্ষ এখন বাংলাদেশই। আর্চ রাইভালারি এখন পাকিস্তান – ভারত থেকে ‘বাংলাদেশ – ভারত’ ম্যাচে শিফট করেছে। আমাদের দলে পাকিস্তানের ধারে কাছেও ন্যাচারাল ট্যালেন্ট নাই। স্পেশালি বোলিং এ। আমাদের যারা আছে তাদের ক্যারিয়ার ও অস্তাচলে। নইলে বিশ্ব ক্রিকেটে ধারাবাহিকভাবে আমরা পাকিস্তানের উপরে থাকতাম।

অনেকে বলে থাকেন সিধু তেলাপোকা বলেছে, সেবাগ খোঁড়া দল বলেছে – এজন্য ভারত দেখতে পারেন না। ভারতের অর্ধশত ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ তো আপনার ভালো জিনিসের প্রশংসাও করেছে। তো রমিজ রাজা, আমির সোহেলদের উদাহরণ বাদ দিয়েও ম্যাককালাম কি বলেছে আপনার দেশকে নিয়ে? চ্যাপেল, বব হুকসরা কি বলেছিল? আর্থারটন কি বলেছিল? একেবারেই নিরীহ দক্ষিণ আফ্রিকার শন পোলকরা তাসকিনের চাকিং নিয়ে কি বলেছিল? শ্রীলঙ্কার এক ডি সিলভাই আম্পায়ার হিসেবে কতগুলো সিদ্ধান্ত আপনার বিরুদ্ধে দিয়েছিল? শেষ নিদহাস কাপের খেলায় নো বল নিয়ে দিবালোকের মত স্পষ্ট জোচ্চুরি নিয়ে সাকিব যখন দল নিয়ে বেরিয়ে গেল তখন মাঠে কাদের আম্পায়ার ছিল? কই তাদের দেশের সমর্থন করতে বা ভারতের বিরুদ্ধে তাদের হয়ে দাঁড়াতে আপনাকে তো কখনো পিছপা হতে দেখেনি……

এগুলো বাদ দিয়ে আপনি মুসলিম বা আপনি বাংলাদেশকে পাকিস্তান ধাঁচের দেখতে চান বা আপনি আওয়ামী লীগকে ভারতের দালাল মনে করেন দেখেই ভারতকে সমর্থন করেন না – এগুলো অনেক সস্তা বাজারি কথা, বুলশিট ধরনের কথা, লজিক বিহীন কথা – কিন্তু ভন্ডামিহীন সিধা কথা। ‘ক্রিকেট’ বা ‘ক্রিকেট স্পিরিটকে’ জড়িয়ে সুশীল বোদ্ধাসুলভ ভণ্ডামিতে পরিপূর্ণ লোকদের চাইতে অনেক স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড কথা এবং সেটা বেটার অ্যাপ্রোচ।

ঠিক একইভাবে পাকিস্তানকে সাপোর্ট করেন না এটাও জাস্টিফাই করতে গিয়ে যখন পাকিস্তানের খেলোয়াড় এর কোয়ালিটি নিয়ে প্রশ্ন উঠে তখনো সেটা একই ভণ্ডামি হয়। আফ্রিদির পেছনে লাগতে গিয়ে দেখলেন সে বিপিএল এর তৃতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি। আমিরের ঘুষ নিয়ে বাকবাকুম করতে গিয়ে দেখলেন সে বিশ্বের অবিসংবাদিত ভয়ংকর বোলারদের একজন। এমনকি ইমরান তাহিরকে ট্রল করতে গিয়েও (সেটাই বা কেন দরকার হয়েছিল?) যখন তার পাকিস্তান পরিচয় সামনে চলে আসে তখন বুঝতে হয় আমরা আসলে অসুস্থ।

দক্ষিণ এশিয়ার সাধারণ ক্রিকেট ভক্তরা র‍্যাশনাল নন। অহেতুক আবেগি, উত্তেজিত এবং প্রায়শই অশালীন। নইলে গেল বিশ্বকাপের মওকা বিজ্ঞাপনটি ওরকম হত না (এবার যদিও অনেক উন্নত হয়েছে)।

কিন্তু যারা নিজেদের ক্রিকেট বোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দেন, অমুক ইতিহাস তমুক টেস্ট নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দেন কিংবা সরাসরি স্পোর্টস জার্নালিজমের সঙ্গে যুক্ত, তারা যখন উপরের পয়েন্টগুলিতে ভারত বা পাকিস্তানের সমালোচনা করেন, তখন বুঝতে হবে মাঠের খেলা বা বিসিবির দায়িত্বশীলতা নয়, আমাদের ক্রিকেট স্পিরিট আর ক্রিকেট ইকোসিস্টেমে বিশাল একটা গর্ত আছে। যেই গর্ত দিন দিন বড় হচ্ছে অন্যের দিকে আঙুল তুলতে গিয়ে। আমরা নিজের দেশের মাঠের খেলার উন্নতির কথা না ভেবে বরং ভাবছি অন্য দেশ কিভাবে কি করলো তা নিয়ে।

এই গর্ত ভরাট না করে হালুম হালুম করে চিৎকার করে কোনো লাভ নেই।

সারাবাংলা/এসবি

Tags: , , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন