বিজ্ঞাপন

এরশাদকে নিয়ে যা যা বলতেই হবে

July 14, 2019 | 12:36 pm

সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ আর নেই। ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে,(সিএমএইচ)চিকিৎসাধীন অবস্থায় আজ সকাল পৌনে আটটায় এরশাদ মারা যান।

বিজ্ঞাপন

এটি খবর আবার খবরও নয়। খবর হল – একজন সামরিক স্বৈরাচার, গণ অভ্যূথ্যানে উৎখাত হয়েছিলেন, তার মন্ত্রীরা, তার দলের নেতা কর্মীরা জনরোষ থেকে বাঁচতে পালিয়েছিলেন। জনগণ কর্তৃক এমনভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েও একজন সাবেক শাসক জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত ভিআইপি মর্যাদায় যেভাবে রাষ্ট্রীয় সব সুবিধা নিয়ে মারা গেলেন তা ইতিহাসে বিরল। নিশ্চয়ই রাষ্ট্রবিজ্ঞানে তা পঠিত হবে।

স্বাভাবিক শিষ্টাচারের কারণে রাজনীতির প্রায় সব মহল থেকেই এরশাদের মৃত্যুতে শোক জানানো হয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ অসাধারণভাবে বিশ্বাস করে বাংলাদেশের রাজনীতি হল এক অনর্থক এবং দুর্বোধ্য কুনাট্যরঙ্গ। এরশাদকে উৎখাতে যে রাজনৈতিক শক্তি বড় ভূমিকা রেখেছিল, তারাই আবার তাকে কাছে টানতে নানা রঙ্গ করেছে। এরশাদকে নিয়ে এইসব খেলা যেন রহস্য-রোমাঞ্চে ভরা টেলিভিশন ধারাবাহিককে হার মানিয়ে রেখেছে এই দেশে। গল্পে, উপন্যাসে, টেলিভিশনে বা কল্পকথায় এই রহস্য-রোমাঞ্চ ভাল লাগতেই পারে। কিন্তু রাজনীতি তো রহস্য বা রোমাঞ্চ তৈরির ক্ষেত্র নয়! রাজনীতি হল জনসেবার ক্ষেত্র, সুসংহতভাবে রাষ্ট্রীয় বন্দোবস্তটাকে পরিচালনা করার ক্ষেত্র। সেখানে এই রহস্য-রোমাঞ্চ সুখকর বা উপভোগ্য নয়, বরং কুনাট্যের সমার্থক। কিন্তু এদেশের মানুষকে সেই রঙ্গ এরশাদের জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত দেখতে হয়েছে।

গনতন্ত্রের শত্রু স্বৈরশাসন। কিন্তু তাকে গ্রহণ করে নেওয়া আরও ক্ষতিকর। ১৯৮২ সালে ২৪ মার্চ দেশে সামরিক আইন জারি করে শাসনকাজ শুরু করেন এরশাদ। এরপর ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি গঠন করেন জাতীয় পার্টি। তিনি একটানা নয় বছর শাসন করেন। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে জেনারেল এরশাদ পদত্যাগ করেন। তাই এ দিনটিকে অনেকেই স্বৈরাচার পতন দিবস বলে অভিহিত করেন। তীব্র গণ-অভ্যুত্থানের মুখে এরশাদ ৪ ডিসেম্বর ১৯৯০ রাত ১০টার কিছু পরে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশ করেন।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু এটুকু বললে এরশাদের শাসনামলটাকে ঠিক বোঝা যায়না। ১৯৭৫-এ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে বাংলাদেশে পাকিস্তানপন্থি যে উগ্র সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি শুরু হয়ে ছিল তাকে সবচেয়ে বিকশিত করছিলেন এরশাদ। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দিয়ে রাষ্ট্রীয় মদদে তৈরি হয় ফ্রিডম পার্টি, দৈনিক মিল্লাত নামে এদের মালিকানায় পত্রিকা দেয়া হয়, খুনিদের অনেককেই জাতীয় সংসদে আসন দেওয়া হয়।

ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহারের বড় হাতিয়ার ছিল তার। দুনিয়ার কোথাও এমন প্রথা না থাকলেও তিনিই উদার বাংলাদেশের পিঠে শেষ পেরেকটুকু বিদ্ধ করে ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম ঘোষণা করেন। ধর্ম নিয়ে এত উন্মাদনা দেখালেও এরশাদের ব্যক্তিগত চরিত্রে সামান্য নৈতিকতাও ছিলনা। এরশাদের নারী কেলেংকারীর ঘটনা এখনও মানুষের মুখে। এরশাদের পুরো নয় বছরের শাসনামলের সবচেয়ে বড় শিকার ছিল শিক্ষা ব্যবস্থা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পুলিশি হামলায় যত ছাত্রের প্রাণ গেছে তার হিসেব আনেক লম্বা। লেখাপড়া এমনভাবে বিঘ্নিত হয়েছিল যে, সেশন জট নামের এক নতুন শব্দই আবিষ্কৃত হয়েছিল শিক্ষাঙ্গনে। চার বছরের অনার্স আর মাস্টার্স কোর্স শেষ হতে সময় লেগেছে প্রায় আট বছর।

এরশাদ দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দিয়েছিলেন। তার আমলেই এ সত্য বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয় যে, দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে ভাল লাভ করা যায়, ধরা পড়ার ঝুঁকি কম। অনেকেই বলেন, এরশাদের আমলে অনেক অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে। এ কথা সত্য এরশাদের আমলে দেশজুড়ে অনেক সড়ক ও মহাসড়ক নির্মিত হয়েছে। কিন্তু এটিও সত্য যে, তার আমলেই উন্নয়ন ও দুর্নীতি মাসতুতো ভাইয়ে পরিণত হয়েছিল যা আজও অব্যাহত আছে।

বিজ্ঞাপন

অপরিমিত ক্ষমতাশালী ছিলেন এরশাদ। যা মন চেয়েছে করেছেন। সকালে বিকেলে কথা বদলেছেন। দু:খজনক হলো, জনগণ কর্তৃক পতিত এই সামরিক রাজনীতিককে আবার টেনে তুলেছিল রাজনীতিই। যে তিন জোটের রূপরেখার ভিত্তিতে ২৭ নভেম্বর ও পরবর্তী সময়ে ছাত্র গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়, এরশাদ পতনের পর বড় দলগুলো এ নিয়ে আর আগ বাড়েনি। সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য, সম্মিলিত পেশাজীবী সংগ্রাম পরিষদ ও প্রগতিশীল বিভিন্ন মহল তিন জোটের ঐক্যবদ্ধ নির্বাচন ও ঐক্যবদ্ধ সরকার গঠন করে স্বৈরাচারী ব্যবস্থাকে নির্মূল করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজে হাত দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। সেটিও হয়নি। আলাদা আলাদা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দলীয় সরকার এল তাতে কাঙ্খিত গণতন্ত্রের চেহারা কখনও আর দেখা যায়নি। এরশাদকে হটানোর মাধ্যমে ১৯৯০ সালের পর বাংলাদেশকে উদার, অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক মর্যাদার দেশ হিসেবে গড়ার যে দ্বিতীয় সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল, তা সফল হয়নি রাজনীতির মঞ্চে নানা কুনাট্যের কারণে।

রাজনীতির উপর থেকে সাধারণ নাগরিকদের এক বিরাট অংশের আস্থা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সে রাজার নীতিও আর নেই, নীতির রাজকীয়তাও উধাও। এরশাদ বিদায় নিয়েছেন। রাজনীতির কুনাট্যরঙ্গে কিছুটা হলেও ভাটা পড়বে কিনা জানিনা। হয়তো পড়তেও পারে। আমাদের দেশে গোটা বন্দোবস্তটাই রাজনীতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং পরিচালিত। সেই রাজনীতি যদি এরশাদীয় রাজনীতি হয় তাহলে গণতান্ত্রিক কাঠামোটা কখনও শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়ায়না।

১৯৮৭ সালে নূর হোসেন নামক এক যুবক গায়ে পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক’ লিখে এরশাদের শাসন বিরোধী মিছিলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল ঢাকার রাজপথ। এই মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরশাদের পুলিশ তাকে গুলি করে হত্যা করে অজস্র মানুষের সামনেই। বাংলাদেশের মানুষ এরশাদ থেকে আজ মুক্তি পেয়েছে, গণতন্ত্র মুক্তি পেয়েছে কিনা তা কেবল ইতিহাস বলবে।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, এডিটর ইন চিফ, সারাবাংলা ও জিটিভি

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/এমএম

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন