বিজ্ঞাপন

এরশাদ যেভাবে জায়েজ হলেন

July 14, 2019 | 5:16 pm

প্রভাষ আমিন

৮৫ সাল থেকে এরশাদের পতন পর্যন্ত, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে প্রতিটা পর্যায়ে মাঠে ছিলাম। ১৯৯০ সালের ১০ অক্টোবর জেহাদ হত্যার মাধ্যমে শুরু হয় আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়। সেদিনও আমি ঢাকার রাজপথে ছিলাম। তারপর ধাপে ধাপে আন্দোলন এগিয়ে যায় চূড়ান্ত পরিণতির দিকে। ২৭ নভেম্বর ডাঃ মিলন শহীদ হওয়ার পর সবকিছু অচল হয়ে যায়। স্বৈরাচারের পতন হয়ে যায় সময়ের ব্যাপার। কিন্তু তখনই আম্মা ঢাকা এসে আমাকে জোর করে কুমিল্লা নিয়ে যান। আমার সারাজীবনের আফসোস ৯০এর ৬ ডিসেম্বর আমি ঢাকায় থাকতে পারিনি। আমার স্পষ্ট মনে আছে, এরশাদের পতনের খবর শুনে আমি লুঙ্গি পড়েই মিছিলে চলে গিয়েছিলাম। কুমিল্লার কান্দিরপাড় পুবালী চত্বরে চলছিল বিজয় উল্লাস। তখন সিনিয়র নেতারা কান্দিরপাড় থেকে নজরুল এভিনিউ হয়ে ঠাকুরপাড়ার দিকে যাওয়ার রাস্তা আগলে দাড়িয়েছিলেন। কারণ এরশাদের পতনের অল্প কয়েকদিন আগে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন কুমিল্লা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা আফজল খান। এরশাদ পতনের পর কুমিল্লায় কর্মীদের ক্ষোভ ছিল আফজল খানের ওপর। আমার মনে আছে, সেদিন কান্দিরপাড়ে কর্মীদের মধ্যে যে আবেগ আর উত্তেজনা ছিল; তাতে নেতারা না ঠেকালে আফজল খানের বাসা গুড়িয়ে দিতো। এরশাদের ঘোষণার পর মন্ত্রীপাড়া খালি হয়ে গিয়েছিল নিমেষেই। মন্ত্রীরা বোরকা পড়ে পালিয়েছিলেন। ৬ ডিসেম্বরের আবেগটা আমার স্পষ্ট মনে আছে। সেদিন কেউ ভাবেনি, পতিত এরশাদ আবার বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হবেন, গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করবেন, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হবেন, বিরোধী দলীয় নেতা হবেন। কিন্তু রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই এবং রাজনীতিতে অসম্ভব বলেও কিছু নেই। পতনের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন সরকারই গ্রেপ্তার করে এরশাদকে। পরের পাঁচ বছর তিনি কারাগারেই ছিলেন। কারাজীবনের অধিকাংশটাই কেটেছে তার নাজিমউদ্দিন রোডের তখনকার কেন্দ্রীয় কারাগারে। শেষ সময়ে ছিলেন সংসদ এলাকায় একটি ভবনে, যেটিকে সাব জেল ঘোষণা করা হয়েছিল। ৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সরকারের সাথে সমঝোতায় এরশাদের মুক্তির পথ প্রশস্ত হয়। প্রথমে তিনি সংসদের অধিবেশনেে যোগ দেন। পরে মুক্তি পান।

বিজ্ঞাপন

মজাটা হলো, ৯০ সালে এরশাদের পতনের দিনে আমি রাজপথে ছিলাম। আর ৯৬ সালের মুক্তির সময় আমি ভোরের কাগজের রিপোর্টার হিসাবে কাভার করতে গিয়েছিলাম। মুক্তি পেয়ে সংসদ লবিতে এরশাদের প্রথম সংবাদ সম্মেলনেও উপস্থিত ছিলাম। সংবাদ সম্মেলনে এত কাছে এরশাদকে দেখে আমি বারবার ৯০এর উত্তাল দিনগুলোতে ফিরে যাচ্ছিলাম। মাত্র পাঁচ বছরেই এরশাদের এমন রাজকীয় প্রত্যাবর্তন। এরশাদ ছিলেন তখন ক্ষমতার নির্ধারক। বিএনপি ও জামায়াতের জোটের বিপরীতে জিততে হলে এরশাদের ভোট দরকার ছিল আওয়ামী লীগের। আওয়ামী লীগের সাথে জাতীয় পার্টির সমঝোতার মধ্যস্ততা করেছিলেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। বিনিময়ে তিনি মন্ত্রিত্ব পেয়েছিলেন। তবে কদিন বাদেই মন উঠে যায় এরশাদের, সরকার থেকে পদত্যাগ করতে বলেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে। সরকার না ছেড়ে মঞ্জু জাতীয় পার্টি ছেড়ে দেন। গঠন করেন নতুন জাতীয় পার্টি। আর এরশাদ জুটে যান বিএনপির সাথে। ৯৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপির নেতৃত্বে গঠিত হয় চারদলীয় ঐক্যজোট। চার দলের শীর্ষ নেতাদের প্রথম বৈঠকটি হয়েছিল ২৯ মিন্টো রোডে বিরোধী দলীয় নেতার বাসভবনে। সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া, এইচএম এরশাদ, গোলাম আযম এবং শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক। সেদিনও রিপোর্টার হিসেবে আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। সেদিনের একটা স্মৃতি আমি কোনদিনও ভুলবো না। মিন্টো রোডের বাংলোগুলোতে ঢোকার পরে মূল ভবনে যেতে একটা ঘোরানো ড্রাইভওয়ে আছে। মূল গেট থেকে ভবন পর্যন্ত মাঝের অংশটায় ফুলের বাগান। এরশাদ এসেছেন, খবর পেয়ে আমানউল্লাহ আমান তাকে স্বাগত জানাতে ছুটে যান। তার এতোই তাড়া ছিল, তিনি সময় বাঁচাতে ফুলের বাগানে মাড়িয়ে ছুটে গিয়েছিলেন। আমানউল্লাহ আমান সেদিন শুধু মিন্টো রোডের ফুলের বাগান নয়, মাড়িয়ে দিয়েছিলেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের এক কর্মীর হৃদয়ও। সেদিন খুব গ্লানি হয়েছিল। এই আমান উল্লাহ আমানদের পেছনেই আমরা স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন করেছিলাম!

স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের এক কর্মীর হৃদয় ভেঙেচুড়ে গেলেও সেদিনটি ছিল এরশাদের জন্য সবচেয়ে বড় বিজয়ের। আওয়ামী লীগের সাথে জোট বেধে মুক্তি পেয়েছিলেন। আবার বেগম খালেদা জিয়ার পাশে বসে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলনের ছক কষছিলেন। এরপর আর কে তাকে স্বৈরাচার বলবে? দুই দলের সাথে সমঝোতা করে এরশাদ বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজেকে জায়েজ করে নেন। আস্তে আস্তে উল্টো এরশাদই গণতন্ত্রের জন্য মায়াকান্না শুরু করেন। সবাই যখন ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার পতন দিবস পালন করে, এরশাদ পালন করতেন গণতন্ত্র রক্ষা দিবস হিসেবে। এভাবেই এই বাংলাদেশে রাজনীতিবিদদের সমঝোতার সুবাদে জাকিয়ে বসেন এরশাদ।

চারদলীয় জোট গড়লেও বেশিদিন সেখানে থাকেননি। এরশাদ চলে এলেও নাজিউর রহমান মঞ্জুর আরেকটি জাতীয় পার্টি গড়ে চারদলীয় জোটে রয়ে যান। এভাবে একবার আওয়ামী লীগ, একবার বিএনপি; এমন পেন্ডুলামের মত রাজনীতি করলেও শেষ জীবনটা তিনি বাধা পড়েছিলেন আওয়ামী লীগের মহাজোটে। আওয়ামী লীগের সাথে থাকার সুবাদে পরপর দুইবার তার দল জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল হয়েছে। একবার তার স্ত্রী রওশন এরশাদ, একবার তিনি নিজে বিরোধী দলীয় নেতা হয়েছেন। এরশাদ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হয়েছেন। তার দল ক্ষমতার অংশীদার ছিলেন। কিন্তু তবুও এরশাদ সন্তুষ্ট ছিলেন না। প্রায়ই তিনি মুক্তি চাইতেন, স্বাধীনতা চাইতেন। সরকারের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতেন। কিন্তু বেশি বিপ্লবী হতে পারতেন না। তার প্রাণ ভোমরা ছিল সরকারের হাতে। প্রথমবার এরশাদকে কারাগার থেকে মুক্ত করলেও নিজেদের পক্ষে রাখতে পারেনি আওয়ামী লীগ। দ্বিতীয়বার জোট করার সময় আটঘাট বেধে নামে আওয়ামী লীগ। এরশাদের বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা সচল করা হয়। এরশাদ গাইগুঁই করলেই একটা মামলার তারিখ দেয়া হতো। ব্যস, তাতেই এরশাদ পোষ মেনে যেতেন। এরশাদ কিছুতেই কারাগারে যেতে চাইতেন না। শেষ জীবনটা এরশাদ কারাগারের বাইরে থাকলেও মুক্ত মানুষ ছিলেন না।

বিজ্ঞাপন

তবুও কে ভেবেছিল এরশাদ ৮৯ বছরের পূর্ণ জীবন পাবেন। হাইকোর্টে রায়ে অবৈধ রাষ্ট্রপতি হলেও, মৃত্যুর পর তিনি পূর্ণ মর্যাদা পাবেন, কে ভেবেছিল।

প্রভাষ আমিন : সাংবাদিক ও কলাম লেখক। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ।

সারাবাংলা/পিএম

বিজ্ঞাপন

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন