বিজ্ঞাপন

ডেঙ্গু নিয়ে সরকারি তথ্যে গড়মিল!

July 24, 2019 | 10:55 pm

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা নিয়ে সরকারি তথ্যের সঙ্গে মাঠ পর্যায়ের তথ্যের কোনো মিল নেই। স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে গত ২৩ জুলাই দেওয়া তথ্য অনুযায়ী আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৪৭৩ জন। কিন্তু রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা পাঁচ শতাধিকের বেশি।

বিজ্ঞাপন

একই সঙ্গে মৃতের সংখ্যা নিয়েও সরকারি তথ্য ও হাসপাতালগুলোর তথ্যেও পাওয়া গেছে গড়মিল। স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, সরকারি ও বেসরকারি অনেক হাসপাতালেই ডেঙ্গু বিষয়ে তথ্য দিচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও বিভিন্ন হাসপাতালে সরেজমিনে ঘুরে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

একদিনে হাসপাতালে ৫৬০ ডেঙ্গু রোগী, শুধু ঢামেকেই ১৪৫

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার সারাবাংলাকে বলেন, ‘সকল সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে প্রতিদিনের রিপোর্ট আপডেট করতে বলা হয়েছে। কিন্তু এখনো সেটা অনেক হাসপাতাল থেকেই করা হচ্ছে না। বিভিন্ন সময়ে প্রতিটি হাসপাতালের প্রতিনিধিদের এই বিষয়ে প্রতিদিনের আপডেট জানাতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে ডেঙ্গু বিষয়ক সচেতনমূলক কর্মসূচি সম্পর্কেও সবাইকে জানানো হয়েছে।’

বিজ্ঞাপন

স্বাস্থ্য অধিদফতরের ২৪ জুলাইয়ের রিপোর্ট অনুযায়ী, গত চব্বিশ ঘণ্টায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ৪৭৩ জন। একই রিপোর্টে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা পাঁচ জন উল্লেখ করা হয়। একইদিন রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে সরেজমিনে ঘুরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আরও বেশি পাওয়া গেছে।

সরেজমিনে রাজধানীর সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি জুলাই মাসে ২১৪ জন রোগী এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। অথচ স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেওয়া পরিসংখ্যানে দেখা যায় হাসপাতালটিতে ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ১৮৬ জন। একই রিপোর্টে দেখানো হয় সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বর্তমানে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা ৪৯ জন। কিন্তু হাসপাতালটিতে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন থাকা রোগীর সংখ্যা ৬৬ জন।

২২ জুলাই থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালটিতে ভর্তি হওয়া নতুন রোগীর সংখ্যা ২৮ জন (২৩ জুলাই বিকেল ৫টা পর্যন্ত)। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদফতরের রিপোর্টটিতে দেখানো হয় সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে নতুন কোনো রোগীই ভর্তি হননি।

বিজ্ঞাপন

রাজধানীর আরেকটি বেসরকারি হাসপাতাল ল্যাবএইড হাসপাতাল। হাসপাতালটির কমিউনিকেশনস বিভাগের অ্যাসিসট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার সাইফুর রহমান লেনিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী প্রতিদিনই হাসপাতালে আসছেন। উনাদের কাউকে ভর্তি রাখা হয় আবার কেউ কেউ চিকিৎসা নিয়ে চলে যান। কেউ কেউ ফলোআপেও থাকেন। ২৩ জুলাই থেকে ২৪ জুলাই রাত ৮টা পর্যন্ত মোট ছয় জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। বর্তমানে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১৭ জন রোগী চিকিৎসাধীন আছেন।’

অথচ স্বাস্থ্য অধিদফতরের রিপোর্ট অনুসারে ল্যাবএইড হাসপাতালে ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত মাত্র একজন রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। রিপোর্টে বলা হয়েছে বর্তমানে কোনো ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী চিকিৎসাধীন অবস্থায় নেই।

রাজধানীর উত্তরায় অবস্থিত আরেকটি বেসরকারি হাসপাতাল শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এই হাসপাতাল ঘুরে বিভিন্ন বেডে দেখা যায় ডেঙ্গু রোগীরা এখানে চিকিৎসাধীন আছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানান সাম্প্রতিক সময়ে অনেক ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীই হাসপাতালটিতে ভর্তি হচ্ছেন। শুধুমাত্র ২২ জুলাই থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত সময়ে এই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ৩২। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদফতরের রিপোর্টে দেখা যায় এই হাসপাতালটিতে এখন পর্যন্ত কোনো রোগীই ভর্তি হননি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানান, সিটি করপোরেশন থেকে আগে খবর নেওয়া হতো। কিন্তু এই মৌসুমে এখনো কোনো আপডেট কেউ নিতে আসেননি। এমনকি স্বাস্থ্য অধিদফতরে রিপোর্ট পাঠানো প্রসঙ্গেও উনারা কেউই অবগত নন।

বিজ্ঞাপন

তবে উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জানা যায়, প্রতিদিনই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রোগীরা ভর্তি হচ্ছেন হাসপাতালে। এই বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে তারা প্রতিবেদন পাঠিয়ে থাকে। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেওয়া দৈনিক প্রতিবেদনে যে সংখ্যা দেখানো হয় তার চাইতেও বেশি রোগী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।

রাজধানীর পান্থপথ অবস্থিত একটি হাসপাতাল হেলথ অ্যান্ড হোপ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেওয়া প্রতিবেদনে দেখা যায় এই হাসপাতালে কোনো ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী চিকিৎসাধীন নেই। কিন্তু সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় হাসপাতালটিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা আসছেন প্রতিদিনই।

হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘হাসপাতালে প্রতিদিনই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রোগীরা আসছেন। তবে সিটি করপোরেশন বা স্বাস্থ্য অধিদফতর কোনো স্থান থেকেই প্রতিদিনের রিপোর্ট জানানো প্রসঙ্গে কিছুই জানানো হয়নি।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের দৈনিক ভিত্তিতে করা রিপোর্টটিতে ঢাকা শহরের ২৩টি হাসপাতালে কোনো রোগী ভর্তি না হওয়ার তথ্য জানানো হয়। কিন্তু হাসপাতালগুলোতে গিয়ে দেখা যায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী সেখানে চিকিৎসাধীন আছেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে দেওয়া সরকারি প্রতিবেদনে জানানো হয় মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা পাঁচ জন। কিন্তু একাধিক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় সংখ্যাটি সঠিক নয়। বাস্তবতায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি।

মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) রাজধানীর মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৮ মাস বয়সী এক বাচ্চা মৃত্যুবরণ করে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে। কিন্তু এই মৃত্যুর তথ্য উল্লেখ নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাঠানো দৈনিক প্রতিবেদনে। বুধবার (২৪ জুলাই) স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে দেওয়া প্রতিবেদনে মৃতের সংখ্যা আট জন বলা হলেও তাতে দেখা যায় ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা শিশুটির সংখ্যা যোগ করা হয়নি।

মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে কথা বলার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও অধিদফতরের ব্যস্ততার কারণ দেখিয়ে কেউ কথা বলেননি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে পাঠানো তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রতিদিনই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা নিয়ে রিপোর্ট করা হয়।

কন্ট্রোল রুমের একজন কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখনো অনেক হাসপাতাল থেকেই আমরা দৈনিক রিপোর্ট পাই না। কিছু হাসপাতালে ফোন করেও তথ্য নিতে হয়। খুব দ্রুতই এই বিষয়ে আমরা সকল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আবারও কথা বলবো।’

সারাবাংলা/এসবি/এমআই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন