বিজ্ঞাপন

শোকের মাস, একটি নাটক ও কিছু অনুভূতির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া

August 1, 2019 | 2:06 pm

প্রত্যাবর্তনের দেশে- এটি একটি নাটকের নাম। নামটি আমাকে মনে করিয়ে দিলেন খ ম হারূন। তাঁকে আজকে (৩০ জুলাই) একটা ফোন করেছিলাম এবং কথা শুরু হতেই তিনি আমাকে এই নামটির কথা বললেন। বলার সঙ্গে সঙ্গেই আমার মনে পড়লো এটি একটি নাম, নাটকের নাম। যে নাটকটি লেখা হয়েছিলো ১৯৭৫ সালে। ১৯৭৫ সাল আমাদের জীবনের ইতিহাসে, দেশের ইতিহাসে, রাজনীতির ইতিহাসে একটি বছর, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নানা কারণে এবং এই কারণগুলো আমরা জানি। তার মধ্যে প্রধানতম কারণ হচ্ছে যে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হয়েছিলো এবং তার প্রেক্ষিতে দেশে যে অবস্থা হয়েছিলো, সেই কারণগুলো মুখ্যত প্রধান হয়ে দাঁড়ায় যখন বাংলাদেশের এই জনপদের ইতিহাস লেখা হয়, আলোচনা করা হয়, বলা হয়- তখন এই সালটির কথা বারবার উঠে আসে। যেমন উঠে আসে ১৯৭১ সালের কথা, তেমনি উঠে আসে ১৯৭৫ সালের কথা। এই ১৯৭৫ সালে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। আমরা বলতে- আমি, খ ম হারূন, ম হামিদ।

বিজ্ঞাপন

উনারা আমার অগ্রজ। এরা নাটকের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং নাটক আমরা করতাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে, মূলত টিএসসিতে। সেখানে রিহার্সাল হতো, সেখানেই মঞ্চস্থ হতো আমাদের নাটক এবং সেটা হতো মূলত নাট্যচক্রের উদ্যোগে। সে সময় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যারা জড়িত ছিলেন, তারা মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যচক্রের সদস্য ছিলেন কিংবা তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। অথবা সংস্কৃতি সংসদ নামে আরেকটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছিল- যাকে ঐতিহ্যবাহী বলা যায়, এর সদস্য হিসেবে যারা কাজ করতেন, তারা নাটক অথবা অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকতেন। যাই হোক- ১৯৭৫ সালটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বলা যায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। কারণ সেই বছর বিশ্ববিদ্যালয় সপ্তাহ উদযাপিত হয় এবং সেই সময় নানা বিষয়ে নানা ধরণের প্রতিযোগিতা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলগুলোর মধ্যদিয়ে ছাত্রদের মধ্যে এবং সেই সময় নানারকম প্রতিযোগিতা হয় যেমন বিতর্ক, গান চিত্রাঙ্কন এবং নাটক। এইগুলো চলছিলো সেই সময়, বিভিন্ন হলের এবং বিভিন্ন সংসদের ছাত্ররা সেগুলা নিয়ে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন এবং শেষ হয়েছিল ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের ১৪ তারিখ। এবং আগস্টের ১৪ তারিখে টিএসসিতে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চূড়ান্ত বিতর্ক প্রতিযোগিতা এবং সেই প্রতিযোগিতায় ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইটি হল- সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ও সূর্যসেন হল। এবং আমিও সূর্যসেন হলের পক্ষ থেকে এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলাম, চূড়ান্ত দিনে। আর সেদিন বিশেষ অতিথি ছিলেন আব্দুল মালিক উকিল এবং তিনি আমাদের সংসদের স্পীকার ছিলেন এবং সেই সুবাদে চূড়ান্ত দিনে তিনি বিশেষ অতিথি ছিলেন। তার পরদিনের কথা তো আপনাদের জানারই কথা। তারপর দিন সকালে বিরাট আকারের অনুষ্ঠান- উপস্থিতি পর্ব শেষ হয়েছিল এবং অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা ছিল ১৫ আগস্ট। কিন্তু সেদিন সকালে পট পরিবর্তন হয়ে গেল, সেদিনের রাতেই পট পরিবর্তন হলো। আমরা জানতে পারলাম তার পরের দিন অর্থাৎ ১৫ আগস্ট সকালে।

জানলাম যে, দেশের রাজনৈতিক জীবনের একটি অধ্যায় শেষ হয়েছে নির্মমভাবে। আরেকটি নতুন অধ্যায় সূচনা হয়েছে এবং সেই সূচনা লগ্নে অনেককেই দেখা গেল যে পট পরিবর্তন করতে, নাম পরিবর্তন করতে, দলের নাম পরিবর্তন করতে, আদর্শের নাম পরিবর্তন করতে। সবকিছু বন্ধ হয়ে গেল, নাটক তো বটেই। সে সময় ডাকসুর অফিসও বন্ধ হয়ে গেল, তালা ভাঙ্গা হলো, তালা লাগানো হলো। এসব কর্মকাণ্ড চলছিলো, ভয়ে ভয়ে দিন কাটতো সে সময়। ক্লাসগুলো চলতো, ক্লাসে ছাত্রের সংখ্যা কম ছিল এবং যারা আসতো তারা ভয়ে ভয়েই আসতো। এইরকম সময়ে নাটক আবার শুরু করার একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় নাট্যচক্রের পক্ষ থেকে। উদ্যোক্তা হিসেবে ম হামিদ ছিলেন, তিনি মূলত আমাকে বললেন, ‘তুমি একটা নাটক লিখো’। সে সময় মনে হলো দেশের এই পরিবর্তিত অবস্থার ভিত্তিতে একটি নাটক লেখা দরকার এবং চেষ্টা করা দরকার। তখন আমি অন্তত এই চেষ্টায় এগিয়ে এলাম, লিখতে শুরু করলাম এবং যতদূর লেখা সম্ভব সতর্কতা অবলম্বন করে, সেটা করা শুরু করলাম। তবে বাড়িতে বসে নয়, সেটা শুরু হলো সূর্যসেন হলের ছাত্রাবাসে, খ ম হারূনের কক্ষে। সেখানে বসেই আমি শুরু করলাম তার তত্ত্বাবধানে নাটক লিখতে। লেখা হলো প্রত্যাবর্তনের দেশে।

বিজ্ঞাপন

প্রতীকী নাটক, নাটকের চরিত্রগুলো প্রতীকী। যারা তখন ক্ষমতায় আসছিলেন তাদেরকে প্রতীকী চরিত্র হিসেবে নিয়ে আসা হচ্ছিলো এবং সে সঙ্গে ভাইরাসকে একটি প্রতীকী অসুখ হিসেবে নিয়ে আসা হচ্ছিলো, যে পরিবর্তনগুলো ঘটছিলো সেটি ভাইরাসের মতো, সেটিক ভাইরাস হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছিলাম সেই নাটকে। যাই হোক, সেই নাটকের রিহার্সালও বলা যায় লুকিয়ে করতে হয়েছিলো আমাদেরকে এবং সে সময় সেটা করা হয়েছিলো সূর্যসেন হলে। সেখানে আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে নাটকের রিহার্সাল করতাম, নাটকের মহড়া দিতাম। এই কারণে যে- যারা বিপক্ষে ছিলেন, যারা চাইতেন না যে আমরা নাটকটা করি, যারা চাইতেন না যে এই পট পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে কোন নাটক লেখা হোক বা মঞ্চস্থ হোক বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেটা যারা চাইতেন না, তাদের পক্ষ থেকে আক্রমণ আসতে পারে, হামলা হতে পারে, এমন আশঙ্কা করেই আমরা গোপনে রিহার্সাল করতাম। তারপরে, নাটকটি লেখা শুরু হয় ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসে, সেই বছরের বাকি মাসগুলো, দিনগুলো নভেম্বর, ডিসেম্বর ওভাবেই কাটলো। পরবর্তী বছর ১৯৭৬ সালের মার্চ মাসে আমরা নাটকটি মঞ্চস্থ করলাম টিএসসির মঞ্চে। প্রথম মঞ্চায়নেই আঘাত আসে, নাটকের শেষদিকে এসে ঢিল ও অন্যান্য জিনিস ছুঁড়াছুঁড়ি শুরু হয়, নাটকটি যেনো বন্ধ হয়ে যায় সেই চেষ্টা করা হয়। এবং সেই অপচেষ্টা খানিকটা স্বার্থকও হলো বলা যায়, শেষের দিকে এসে নাটকটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলাম আমরা। আমিও মঞ্চে উপস্থিত ছিলাম অভিনেতা হিসেবে এবং আমি তখন মঞ্চের পিছন যে সাজঘর, সেই সাজঘরে যেয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসি। তখন আমার একটি বাইক ছিলো, সে সময় আমি বাইক চালাতাম, সেই বাইকে করে আমি বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যাই। এবং সেই সময় যারা আমাকে পছন্দ করতেন কিন্তু আমার নাটক করাটাকে পছন্দ করতেন না, তারা আমাকে এরকম একটা হুমকি দিয়েছিলো যে- তুমি এসব ছাড়ো, এসবের সাথে সম্পৃক্ত হইয়ো না, এখন আমরা আসছি ক্ষমতায় এবং তুমি এসব পরিত্যাগ করো। তারা তখন সেই রকম কথা আমাকে বলতেন এবং আমিও চুপচাপ শুনে যেতাম এবং শুনে চুপ থাকতাম। তারপরে এই নাটকটি মঞ্চস্থ করা সম্ভব হয়নি, এরপরে দ্বিতীয়বার বেশ ব্যবধানে মঞ্চস্থ হয়েছিলো। এই ছিলো প্রত্যাবর্তনের দেশে নাটকের পটভূমি এবং সেই কথাটিই হঠাৎ খ ম হারূন মনে করিয়ে দিলেন।

এই কথাটা মনে হতেই আরেকটি অনুভূতির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া শুরু হয় আমার ভিতর, এই কারণে যে এই কথাগুলো বলতে গিয়ে, লিখতে গিয়ে বা শোনাতে গিয়ে এক ধরণের ক্রোধের জন্ম হয় মাঝেমাঝে এবং সেটাকে আমি বলছি আমার অনুভূতির ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া। এই কারণে যে সেদিন যারা এই পটভূমির পরিবর্তনে অর্থাৎ এই পট পরিবর্তনের পটভূমিতে নাম পরিবর্তন করেছিলেন, দল পরিবর্তন করেছিলেন, যারা সোচ্চার হয়েছিলেন অন্য দলের হয়ে স্লোগান দিতেন, তারাই কিন্তু আজকাল বেশ লেখালেখি করেন বা উক্তি দেন বা ইতিহাস থেকে কথা বলেন এবং তারা ভুলে যান যে তাদের সেই সময়ের ভূমিকা কিন্তু নেতিবাচক ছিলো। অথচ আজকে তাদের অনেকেই ইতিবাচক কথা বলেন, এখনকার জয়জয়কার প্রেক্ষাপটে। এখন যা কিছুর জয়জয়কার উচ্চকিত ভাবে উচ্চারিত হচ্ছে, তার পক্ষেই তারা বেশ গলা ছেড়েই নিজের অবস্থানের কথা ব্যখ্যা করছেন, এখনকার অবস্থানের কথা, তখনকার অবস্থান তাদের এইরকম ছিলো না, এটা তারা ভুলে গেছেন। এই জিনিসটাকে ‘এমনেশিয়া’ বলবো। এটিকে সিলেক্টিভ এমনেশিয়া বলবো, এই কারণে যে তারা খুব নির্দিষ্ট জায়গাটা ভুলে যাচ্ছেন, পঁচাত্তরের আগস্ট মাসের ঘটনা ভুলে যাচ্ছেন, পঁচাত্তরের পরবর্তী সময়, নভেম্বরের কথাগুলো, ৪ নভেম্বরের ঘটনাগুলো।

এই যে পঁচাত্তরের শেষেদিকের ঘটনাগুলো, পঁচাত্তরের আগস্ট মাসের ঘটনাগুলো ভুলে যাচ্ছেন তারা, যে তাদের সেই সময় কি ভূমিকা ছিলো। এবং সেই কথা সম্পূর্ণভাবে ভুলে গিয়ে তারা আজকে নতুন মোড়কে, নতুন রূপে, নতুন নামে নিজেদের পরিচয় দিচ্ছেন এবং একেকজন কমান্ডার হিসেবে দাঁড়িয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন যে তারাই সেদিন কান্ডারী (৭৫ সাল) ছিলেন। হ্যাঁ, কর্মকান্ডের কান্ডারী ছিলেন, এবং সেটা দুষ্কর্মের। সেটা তারা ভুলে যান এবং এই রোগ, এই ব্যাধী থেকে তাদের মুক্তি হোক এই কামনা করি। এই ব্যাধী থেকে তারা যদি মুক্তি পান, তাহলে তারাও সুস্থ হয়ে উঠবেন এবং আমরাও স্বস্তি পাবো। আপনাদের সবারই মঙ্গল হোক।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/এমএম

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন