বিজ্ঞাপন

কেবিন নম্বর ১১২৩! যেখানে বিচ্ছিন্ন এই বন্ধন!

August 5, 2019 | 5:41 pm

জান্নাতুল ফেরদৌসী, বার্তা সম্পাদক

ঢাকা: রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালের ১১২৩ নম্বর কেবিনে চিকিৎসা চলছে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ছয় বছরের মালিহার। পুরো নাম মালিহা বিনতে সরকার। গত ৩১ জুলাই এই হাসপাতালে ভর্তি হয় সে। এই কেবিনটিতেই ভর্তি ছিল মালিহার বড় ভাই রাইয়ান সরকার (১১)। গত ২ আগস্ট ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রাইয়ান মারা যায়। দুই সন্তানের ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে দেশের সবচেয়ে দামি এই হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলেন তাদের বাবা-মা। বাবা মোমিন সরকার ও মা জান্নাত আরা জাহান পুত্রশোকে কাতর হলেও নিজেদের স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। কারণ তাদের ছোট্ট মালিহা এখনো জানে না তার ভাইয়ের মৃত্যুর কথা। সে জানে, এখনো এই হাসপাতালেই ভর্তি আছে ভাই রাইয়ান!

বিজ্ঞাপন

সোমবার (৫ আগস্ট) বাবা মোমিন সরকারের সঙ্গে কথা হয় সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, ‘আজ আমার মেয়েটি অনেকটা সুস্থ। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, সে এখন আউট অব ডেঞ্জার। তার রক্তে প্লেটলেট কাউন্টও বেড়েছে। লুজ মোশন ছিল, কমেছে। হয়তো আজ বাড়ি যেতে পারব। যদিও বাড়িতে আর ফিরতে ইচ্ছে করছে না।’ এটুকু বলতে কণ্ঠ ধরে আসে মোমিন সরকারের।

তিনি বলেন, ‘বাড়িটা ছেড়ে অন্য কোথাও যাব ভাবছি।’ রাজধানীর শেখেরটেকের বাড়িটার ওপরই যেন যত ক্ষোভ মোমিনের। ওই বাসাতেই যে এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয় রাইয়ান ও মালিহা।

তবে কোনোভাবেই ওই বাসা ছাড়তে রাজি নন রাইয়ানের মা জান্নাত আরা। ‘আমাদের ছেলের সব স্মৃতি তো ওই বাসাতেই। কিভাবে ছেড়ে যাব এই বাড়ি!,’ স্ত্রীর কথাই উদ্ধৃত করছিলেন মোমিন।

বিজ্ঞাপন

‘ওর স্কুলের ব্যাগ ঘরে ওভাবেই পড়ে আছে। টেবিলে বই-খাতা সব এলোমেলোভাবে ছড়ানো। ছেলের ড্রয়িং খাতা, বল— সবকিছু ও যেভাবে রেখেছিল, ঠিক সেভাবেই আছে,’— সারাবাংলাকে বলেন এই বাবা।

স্কয়ার হাসপাতালের রিসেপশনে বসে একনাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছিলেন মোমিন সরকার। এতদিনে যেন বুকে জমে থাকা সব কথা বলার সুযোগ পেলেন। কথার পুরোটা জুড়েই ছেলে রাইয়ান। টানা দেড়ঘণ্টায় তিনি শোনালেন ছেলেকে নিয়ে তার আকাশছোঁয়া স্বপ্নের কথা, ছেলের পছন্দ-অপছন্দ, ভালো লাগা-মন্দ লাগা, খেলাধূলা-লেখাপড়াসহ আরও কত কী!

বিজ্ঞাপন

মোমিন সরকার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, আহা! আমার রাইয়ান! কত স্বপ্ন ছিল ছেলেকে নিয়ে, কত স্মৃতি! ১১ বছর ৭ মাস ধরে ছেলেটাকে কত যত্ন আর মমতায় বড় করলাম। গেল মাসে সাঁতারে ভর্তি করিয়েছিলাম। শুক্রবার করে দু’টো ক্লাসও করেছে সাঁতারের। ছেলেটাকে আমার চেয়েও বড় কিছু বানাব ভেবেছিলাম। ওর মা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করেও কোনো চাকরি করেনি শুধু সন্তান মানুষ করার জন্য। নিজের সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করেছে। কিন্তু ছেলেকে মানুষ করার সুযোগ আর পেল কই!

চোখের কোণে জমানো পানি লুকানোর চেষ্টা করে রাইয়ানের বাবা বলেন, আমার ছেলেটা খুব মেধাবী ছিল। খুব খেলাধূলা পছন্দ করত। স্কুলে মোজা পরে খেলত, জুতা নোংরা করত না। পাছে মা টের পায়। বাসায় ফিরে নিজেই মোজা ধুয়ে ফেলত। আমি অফিস থেকে ফিরলেই বলত, বাবা, ল্যাপটপটা দিবা? আমরা গ্রহ-তারা-নক্ষত্র দেখব, সমুদ্রের তলদেশ দেখব। এসবে রাইয়ানের খুব আগ্রহ ছিল। খুব শান্ত ছিল ছেলেটা আমার, ভাত খেতে পছন্দ করত। খুব সাহসীও ছিল আমার ছেলে।

ছেলের কথা যেন ফুরতেই চায় না। ছেলে কোন কোন স্কুলে পড়েছে, কোথায় কবে কোন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে— সব খুঁটে খুঁটে স্মৃতি থেকে বের করে আনলেন মোমিন সরকার।

কথা বলতে বলতে আসে মেয়ে মালিহার প্রসঙ্গও। মোমিন বলেন, ‘ছেলে মারা গেছে আজ তিন দিন। এখনো আমার মেয়েটি জানেই না তার ভাই আর নেই। সে জানে, ভাই এই হাসপাতালেই ভর্তি। মৃত্যু সম্পর্কেও তার তেমন ধারণা নেই। তাই একটু পরপরই জেদ করে, চলো, ভাইয়ের কাছে যাব। ওর মা বলে, ভাই মামা বাড়ি। মালিহা বলে, আমাকেও নিয়ে চলো। মা কখনো বলে, ভাইয়া কবরে। মালিহা বলে, ভাইয়ার কাছে কবরেই যাব!’

বিজ্ঞাপন

একটু থেমে মোমিন বলেন, ‘গতকাল একবার হাসপাতাল থেকে স্ত্রীকে নিয়ে শেখেরটেকে বাড়িতে যাই। আমি অফিস থেকে বাড়ি ফিরলে ওরা ভাইবোন হুড়োহুড়ি করত, কে আগে দরজা খুলে দেবে। কতদিন ব্যাথাও পেয়েছে। কিন্তু কাল কেউ  এলো না, দরজা খুলল না কেউ! ওদের মা— ছেলের পোশাক, বই-খাতা, স্কুল ব্যাগ— সব ধরে ধরে কাঁদছিল। আমাকে বলল, চলো, রাইয়ানের স্কুলের গেটে গিয়ে একটু  দাঁড়িয়ে থাকি!’

‘স্ত্রীকে কী বলে সান্তনা দেবো বলেন? নিজেকেই তো সামলাতে পারছি না। আমি বেসরকারি চাকরি করি। ওদের সময় খুব কম দিতে পারি। মা-ই ওদের বেশি সময় দিত। আমি তো অফিসের কাজে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ব। ওদের মা কী করবে? রাইয়ানের অস্তিত্ব আমাদের পুরোটা জুড়ে। ওর সময় কী করে কাটবে। আমাদের দু’জনের জীবনের বিনিময়েও যদি ছেলেটাকে বাঁচানো যেত! হাসপাতালে আসা সহকর্মীরা কত টাকা নিয়ে এসেছেন এই হাসপাতালে— আমার এমডি, জিএম সবাই। বলেছিলেন, বিদেশে নিতে হলেও তারাই খরচ দেবেন। ওদের সবার কাছে দোয়া চেয়েছি । কমপক্ষে ৫০ থেকে ৬০ জনের কাছে ছেলের জন্য, ছেলেকে বাঁচাতে দোয়া চাইলাম ! কিন্তু ছেলেটাকে বাঁচাতে পারলাম না,’— বলতে বলতে যেন গলা বুঁজে আসে মোমিন সরকারের।

খানিকটা সময় আর কথা সরে না না। একটু চুপ থাকেন। আবার বলতে শুরু করেন, ‘সঠিক সময়ে হাসপাতালে সিট পেলে, সময়মতো চিকিৎসা পেলে ছেলেটাকে হয়তো হারাতে হতো না!’ আবেগ, বেদনা থেকে এবার বাবার কণ্ঠে ক্ষোভ।

রাইয়ান-মালিহার বাবা আক্ষেপ করে বললেন, কত জায়গায় ঘুরলাম— মিরপুর ল্যাবএইড, ইবনে সিনা। কত রিকোয়েস্ট করলাম, রিপোর্টটা একটু দ্রুত দেওয়া যায় কি না? সেই একই উত্তর সবখানে— ‘সিস্টেম নাই’।

‘কী সিস্টেম আছে এখানে? কত মানুষ মারা যাচ্ছে ডেঙ্গুতে। হাসপাতালে সিট নাই। কী করছেন আপনারা? আমরা চিকিৎসা চাই, কোটি টাকার বিনিময়েও সন্তানকে বাঁচাতে চাই,’ আরও ক্ষুব্ধ মোমিন সরকার।

‘২৮ জুলাই ছেলেটা স্কুল যাওয়ার আগে তার মাকে বলেছিল, ঈশ! আমার যদি মালিহার মতো জ্বর হতো! তুমি ওকে কত আদর করছ! মুখে তুলে খাওয়াচ্ছ!,’- বলেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন মোমিন সরকার।

থেমে যায় তার একনাগাড়ে কথা বলা। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন, ‘কত ঘুরাঘুরির পর এই হাসপাতালে এক আত্মীয় চাকরি করার সুবাদে ১১২৩ নম্বর কেবিনটি পাই। প্রথমে ছেলেকে ভর্তি করি। দু’দিন পর ছেলেকে এনআইসিইউতে নেওয়ার পর ওই কেবিনেই আবার মেয়েকে ভর্তি করি।’

ছেলের মৃত্যুর পর আমার স্ত্রী আমাকে নানা প্রশ্ন করছেন, ‘কেন ছেলেটাকে নিয়ে দিনভর হাসপাতালে সিটের জন্য ছুটেছ? বাসায় রাখলে তো লিকুইড খাওয়াতে পারতাম। কেন এনআইসিইউতে নিয়েছ? আমার বাচ্চার ছোট্ট শরীরে কত কাটা ছেঁড়া করল, কষ্ট দিলো; আমার কোলে মাথা রেখে শান্তিতে মারা যেত, একটু পানি খাওয়াতে পারতাম।’ এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর আমার জানা নেই , বলেন মোমিন।

সারাদেশের ডেঙ্গু আর ডেঙ্গু আতঙ্ক কমাতে সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি আর্কষণ করে মোমিন সরকার বলেন, ডেঙ্গু সমস্যা নিয়ে আরও বেশি কার্যকর পদক্ষেপ দরকার। এখনও কেন কারও টনক নড়ছে না। আপনারা প্রতিটা হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে গিয়ে দেখেন, কি অসহায় অবস্থা! সিটের কত সংকট! মানুষের কাছে সঠিক তথ্যও নেই, জ্বর কমার সময়টায় যে ভয়াবহ এটায় বেশিরভাগ মানুষ জানে না এখনও। এলাকাভিত্তিক ক্যাম্প করে হলেও সবাইকে সচেতন করতে হবে, ঘরে ঘরে তথ্য আর  চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দিতে হবে। একটা মশার কামড়ে, জ্বরের মত সাধারণ অসুখে, চিকিৎসার সুযোগ না পেয়ে আর কোনো মানুষ যেন এ দেশে মারা না যায়।

সারাবাংলা/জেডএফ/এমএম

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন