বিজ্ঞাপন

‘আমাদের বেঁচে থাকাটা মৃত্যুর চেয়েও যন্ত্রণার’

August 16, 2019 | 9:32 pm

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: শোকাবহ ১৫ আগস্টের স্মৃতিচারণ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, রেহানা এবং আমি মাত্র ১৫ দিন আগে দেশ ছেড়েছিলাম। আমরা বেঁচে গেয়েছিলাম, সে বাঁচাটা বাঁচা না। সেই বাঁচার যন্ত্রণাটাও মৃত্যুর থেকেও অনেক বেশি। ব্যক্তিগতভাবে আমরা মনে করি এটা আমাদের দুর্ভাগ্য ছিল।

বিজ্ঞাপন

শুক্রবার (১৬ আগস্ট) বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৪তম শাহাদাৎবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। সভার শুরুতে ১৫ আগস্ট শহীদদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিভিন্ন প্রেক্ষাপট এবং স্বাধীনতার পর একদিকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ গড়ার কাজ এগিয়ে নেওয়া এবং অন্যদিকে সরকারবিরোধী শক্তির ষড়যন্ত্রের কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘এই কঠিন কাজ মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে করে গিয়েছিলেন তিনি। সেই সময় নানা চক্রান্ত চলেছে, কখনো পাটের গুদামে আগুন, থানা লুট করা, আওয়ামী লীগের নির্বাচিত ৭ জন সংসদ সদস্যকে তখন হত্যা করা হয়েছিল।’

‘যারা স্বাধীনতাবিরোধী, রাজাকার-আলবদর বাহিনী অনেকেই দেশ ছেড়ে বের হয়ে গিয়েছিল। অনেকেই আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গিয়েছিল, সেই আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে একের পর এক ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে শুরু করেছিল। তার সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক নেতারাও তখনকার অবস্থাটা অনেকেই বুঝতে পারেনি’, বলেন প্রধানমন্ত্রী।

বিজ্ঞাপন

শেখ হাসিনা বলেন, ‘একটা দেশ, দীর্ঘদিন বঞ্চিত, শোষিত ছিল তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করা হয়েছে। তারা এতো সহজে ছাড়বে না। তাদের দোসররা ছিল রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আর তাদের ষড়যন্ত্র চক্রান্ত সবসময় অব্যাহত থাকবে, এই উপলব্ধিটা তখনকার দিনে আমাদের অনেক রাজনৈতিক নেতার মধ্যেও আসেনি। তাই তারা এটা হয় নাই, ওটা হয় নাই, এটা হলো না কেন? নানা ধরনের প্রশ্ন, লেখালেখি শুরু করেছিল। তখনকার ওই অবস্থাটা উপলব্ধি করে একটা বিধস্ত দেশকে গড়ে তুলতে হচ্ছে। ক্ষতবিক্ষত একটা দেশ, অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু একটা দেশ। সেই দেশটাকে গড়ে তোলা যে অন্তত কঠিন দুরূহ কাজ, এটা যে একদিনেই এক কথায় গড়ে ওঠে না। এই উপলব্ধিটা যদি সবার মাঝে থাকত, তাহলে হয়ত ১৫ আগস্টের মতো এতো বড় একটা আঘাত এই দেশে আসত না।’ কিন্তু তখনকার অনেকেই সেই উপলব্ধিটা অনেকেই করে নাই। কেন তারা উপলব্ধি করতে পারেনি, আমি জানি না। এর মধ্যে জ্ঞানীগুনী অনেকেই আছেন, বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।

১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন জনের লেখালেখি পড়ার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “কেউ যদি একবার চোখ বুলান, পড়েন তখন দেখবেন, কত ভুল সিদ্ধান্ত এবং ভুল কথা তারা বলে গিয়েছিলেন। আর সেই খেসারতটা জাতিকে দিতে হল ৭৫’এর আগস্টে।”

নিজের পরিবার-পরিজনসহ আত্মীয়-স্বজনকে হত্যার লোমহর্ষক ঘটনা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা দুই বোন। রেহানা এবং আমি। ব্যক্তিগতভাবে আমরা মনে করি, এটা আমাদের দুভার্গ্য ছিল। মাত্র ১৫দিন আগে দেশ ছেড়েছিলাম। আমি যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। গিয়েছিলাম দুটি বাচ্চাকে নিয়ে আর রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে স্বামীর কর্মস্থলে। আমরা বেঁচে গেয়েছিলাম। সে বাঁচাটা বাঁচা না। সেই বাঁচার যন্ত্রণাটা মৃত্যুর থেকেও অনেক বেশি। ছয় বছর দেশে আসতে পারিনি। অন্যদেশে শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নিয়ে থাকতে হয়েছিল।’

বিজ্ঞাপন

আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাকে যখন নির্বাচিত করল, প্রথম এটা আমি গ্রহণ করতে পারিনি। কাজ করেছি থেমে থাকিনি। ১৯৭৯ সালে প্রথম রেহানা প্রতিবাদ করে সভা করেছিল সুইডেনে। সেই রাজনৈতিক সভা রেহানাই প্রথম শুরু করে। এরপর ১৯৮০ সালে আমি লন্ডন যাই। কারণ রেহানা চলে গিয়েছিল, সেখানে তার বিয়ে হয়েছিল। সে তখন অন্তঃস্বত্ত্বা, তার পাশে দাঁড়ানোর জন্য গিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানেও গিয়েও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করি এবং এই হত্যার প্রতিবাদ করি। বিভিন্ন কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হই।
ইনকোয়ারি (তদন্ত) কমিশনও করি। কিন্তু সেই কমিশনের স্যার টমাস উইলিয়ামসকে কিন্তু জিয়াউর রহমান ভিসা দেয়নি বাংলাদেশে আসতে।’

দুঃসহ লড়াই-সংগ্রামের পথ চলার কথা বলতে বলতে গিয়ে আবেগআপ্লুত হয়ে কণ্ঠ ভারী হয়ে ওঠে প্রধানমন্ত্রীর। তিনি বলেন, ‘আমার মা কিন্তু জীবন ভিক্ষা চায়নি। আমার মা যখন জেনেছেন আমার বাবাকে হত্যা করেছেন সোজা বলে দিয়েছেন, ওনাকে হত্যা করেছ আমাকেও হত্যা কর। আমি এখান থেকে এক পাও নড়ব না। তিনি নিজের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। ভেবেছিলেন তিনি থাকলে বোধহয় কামাল-জামালের স্ত্রী, রাসেল, জামাল রক্ষা পাবে। কিন্তু তাকে সেখানে গুলি করে একে একে সবাইকে হত্যা করে এবং সবশেষে রাসেলকে নিয়ে যেয়ে হত্যা করে তারা।’

‘এই হত্যাকাণ্ড ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধে আমরা যে বিজয় অর্জন করেছি, সেই বিজয়ের প্রতিশোধ নেওয়া এবং সেই বিজয়কে ধুলিসাৎ করে দিয়ে স্বাধীনতাবিরোধীদের আবার ক্ষমতায় পুর্নবাসিত করা। আবার ওই পাকিস্তানি ভাবধারা নিয়ে আসা। যে কারণে খুনিরা এই হত্যার পরে পরেই প্রথম ঘোষণা দিয়েছিল ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ। যেটা পরবর্তীতে আর তারা রাখতে সাহস পায় নাই, পরিবর্তন করে’, যোগ করে প্রধানমন্ত্রী।

তিনি আরও বলেন, ‘আর দুঃখের বিষয়, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত, তারা তো চেনা। বাংলাদেশ খুব ছোট জায়গা। দিনরাত যারা আমাদের বাড়িতেই ঘোরাঘুরি করত, তারাই তো সেই খুনি রূপেই বিরাজমান হল। জিয়াউর রহমান একটা মেজর ছিল, তাকে প্রমোশন দিয়ে দিয়ে মেজর জেনারেল করা হয়েছিল। মাসে একবার করে হলেও সে আমাদের বাড়িতে আসত। কখনো একা আর কখনো খালেদা জিয়াকে সঙ্গে নিয়ে। কারণ খালেদা জিয়াকে সঙ্গে নিয়ে এলে মার সাথে দেখা করার উছিলায় ওপরে আসতে পারত। আর আমাদের ওই লবিতে দুইটা মোড়া পেতে বসত। ঘন ঘন তার যাতায়াত ছিল। ডালিম, ডালিমের শাশুড়ি, ডালিমের বউ, দিনরাত আমাদের বাসায় ঘোরাঘুরি করত। জেনারেল ওসমানিকে যখন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তাকে যখন আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর অধিনায়ক করা হলো তখন তার এডিসি হিসাবে কামালকে নিয়োগ দেওয়া হল। তার সঙ্গে মেজর নূর একই সঙ্গে একই রুমে থেকেছে। একই সঙ্গে তারা এডিসি ছিল। আর এরাই এই হত্যাকাণ্ডটা চালাল।’

বিজ্ঞাপন

পিতার স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার প্রতিজ্ঞা শেখ হাসিনার

‘মোশতাক তো মন্ত্রী ছিল এবং পরবর্তীতে অনেক তার চেহারা দেখেছেন। যারা বিএনপিতে যোগ দিয়েছে, অনেক বড় বড় কথা এবং অনেক নীতিকথা শোনায়। তারা কে ছিল? তারা কি এই সমস্ত ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিল না! এবং তারা ভেবেছিল এইভাবেই বোধহয় ক্ষমতায় ঠিকে থাকতে পারবে, কিন্তু সেই ক্ষমতা টেকেনি। মোশতাক নিজে অবৈধভাবে সংবিধান লংঘন করে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দেওয়ার পরপরেই জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করল। জিয়াউর রহমান কিভাবে তার এতো বিশ্বস্ত হলো যে তাকেই সেনাপ্রধান করল। সেটা কর্ণেল ফারুক, রশিদ বিবিসিতে যে ইন্টারভিউ দিয়েছিল, সেই ইন্টারভিউ থেকেই আপনারা জানতে পারেন। তারা যে জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন এবং জিয়ার কাছ থেকে ইশারা পেয়েছেন, জিয়া যে তাদের আশ্বস্ত করেছে, এগুলো করলে পরে তাদের সমর্থন পাবে, সেটা তো তারা নিজেরাই বলে গেছে।’

স্বাধীনতার পর ষড়যন্ত্র করে খাদ্য সংকটের কারণে দুর্ভিক্ষ তৈরি করার পিছনে তৎকালীন খাদ্য সচিবও জড়িত ছিল দাবি করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘যে লোক সেই সময় খাদ্য সচিব ছিল, সেও এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত। এই জিয়াউর রহমান কিন্তু তাকে মন্ত্রী করেছিল। কাজেই বুঝতে পারছেন চক্রান্তটা কত সূদুরপ্রসারী।‘

আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন- দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিম, আবদুল মতিন খসরু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানকসহ অন্যরা।

এছাড়াও বঙ্গবন্ধুর স্মরণে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য মেরিনা জাহান। যৌথভাবে সভা পরিচালনা করেন আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ও উপ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন।

সারাবাংলা/এনআর/এমও

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন