বিজ্ঞাপন

স্বজনপ্রীতি, নিয়মনীতি না মানায় খেলাপি ঋণ বাড়ছে

August 24, 2019 | 4:49 pm

গোলাম সামদানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: চলতি বছরের জুন পর্যন্ত দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ কিছুটা কমলেও বেড়েছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে। বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত সর্বশেষ প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকারদের মতে, বেসরকারি খাতের ব্যাংকের ঋণ বিতরণ ও আদায়ে নীতিমালা অনুসরণ না করা এবং স্বজন প্রীতির কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ঋণ বিতরণ ও আদায়ে কিছুটা কঠোরতা এবং কখনো কখনো পূন:তফসিলের কারণে কিছুটা কমেছে বলেও তাদের অভিমত।

বিজ্ঞাপন

এ ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, সরকারি ব্যাংক নিয়ে কথাবার্তা বেশি হওয়ায় ঋণ বিতরণ ও আদায়ের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো কিছুটা কঠোরতা অবলম্বন করছে। এছাড়াও সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট ও ৯ শতাংশ সরল সুদে সরকারি ব্যাংকগুলো নানাভাবে ঋণ আদায় করার চেষ্টা করছে। ফলে এই খাতে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমছে।

আরও পড়ুন- দেশে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা

অন্যদিকে বেসরকারি খাতের ব্যাংকে স্বজনপ্রীতি বেশি। এতে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ উদ্ধারে চাপ সৃষ্টি করতে পারছে না এবং করছেও না। বিশেষ করে বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের ঋণ দেওয়ায় তা আদায় করতে চাপ সৃষ্টি করা যাচ্ছে না। এসব কারণে বেসরকারি খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে।

বিজ্ঞাপন

মির্জ্জা আজিজ বলেন, সার্বিকভাবে এখনো দেশে খেলাপি ঋণ কমার পরিবর্তে বাড়ছে। এটা বড় উদ্বেগের কারণ। গত তিন মাসে ঋণ বিতরণের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় খেলাপি ঋণ বাড়ার শতকরা হার কিছুটা কমেছে। কিন্তু মোট খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এটা ব্যাংক খাতের জন্য অশনী সংকেত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী গত ৩০ জুন পর্যন্ত সময়ে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। এর আগে গত মার্চ পর্যন্ত সময়ে দেশে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা। গত তিন মাসে দেশে খেলাপি ঋণ বাড়ার পিছনে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো প্রধান ভূমিকা রেখেছে। সর্বশেষ তিন মাসে রাষ্ট্রায়ত্ত, বিশেষায়িত ও বিদেশি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমেছে। কিন্তু একই সময়ে বেসরকারি খাতের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ৯৭৪ কোটি টাকা। ফলে গত মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে দেশে খেলাপি ঋণ ১ হাজার ১২৭ কোটি টাকা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেসরকারি খাতের ৪২টি ব্যাংকে গত জুন-২০১৯ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা। গত মার্চে এর পরিমাণ ছিল ৪৯ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। সর্বশেষ তিন মাসে বেসরকারি খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ৯৭৪ কোটি টাকা।

বিজ্ঞাপন

অন্যদিকে গত জুন শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৩ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। গত মার্চ পর্যন্ত এর পরিমাণ ছিল ৫৩ হাজার ৮৭৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। সর্বশেষ তিন মাসে খেলাপি ঋণ কমেছে ১৩৫ কোটি টাকা।

বিশেষায়িত খাতের দুই ব্যাংকের গত জুন পর্যন্ত খেলাপি হয়েছে ৪ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা। গত মার্চ পর্যন্ত ছিল ৪ হাজার ৭৮৭ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। তিন মাসে খেলাপি কমেছে ৯১ কোটি টাকা। এছাড়াও বিদেশি খাতের ৯টি ব্যাংকের জুন-১৯ পর্যন্ত খেলাপি হয়েছে ২ হাজার ৫৭ কোটি টাকা। গত মার্চ পর্যন্ত এর পরিমাণ ছিল ২ হাজার ২৫৬ কোটি ৫১ লাখ টাকা। গত তিন মাসে খেলাপি কমেছে ১৯৯ কোটি টাকা।

অন্যদিকে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, খেলাপি ঋণ একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এটা সরকারি বেসরকারি ব্যাংক বলে কোনো কথা না। আমরা যদি দ্রুত সময়ের মধ্যে লিগ্যাল অ্যাকশন নিতে না পারি তাহলে তা উদ্ধার করা কঠিন। তাই আমাদের জুডিশিয়াল অ্যাকশন যেতে হবে। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু করে খেলাপি ঋণ আদায় করা যাবে না।

এবিবি‘র চেয়ারম্যান বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো অনেক ক্ষেত্রে ঋণ পূন:তফসিল করে থাকে। বিষয়টা হলো তাদের নগদ আদায় হয়েছে কিনা, তা দেখা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আরো বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো যেভাবে ঋণ পূন:তফসিল করতে পারে সেক্ষেত্রে আমরা তা পারি না।

বিজ্ঞাপন

সিপিডি’র সিনিয়র গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সারাবাংলাকে বলেন, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে অনেক সময় ব্যাংকগুলো নীতিমালা অনুসরণ করে না। এতে করে তাদের খেলাপি ঋণ উদ্ধারে ঝুঁকির পরিমাণও বেশি।

তিনি আরো বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলোকে নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা দেওয়ার ঘোষণায় খেলাপি ঋণ উদ্ধার কিছুটা সহজ হচ্ছে। ফলে তাদের ঋণ কিছুটা কমছে।

উল্লেখ্য, চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত সময়ে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। এটি বিতরণকৃত ঋণের ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। বছরের প্রথম প্রান্তিকে বিতরণকৃত মোট ঋণের খেলাপি ছিল ১১ দশমিক ৮৭ শতাংশ।

চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৮ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ১৬ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা এবং মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত বেড়েছে ১ হাজার ১২৭ কোটি টাকা। চলতি বছরের ৩০ জুন শেষে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত মোট ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ৭১ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা। গত মার্চে এর পরিমাণ ছিল ৯ লাখ ৩৩ হাজার ৭২৭ কোটি ১৪ লাখ টাকা।

সারাবাংলা/জিএস/জেএএম

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন