বিজ্ঞাপন

ডেঙ্গু: পরিচ্ছন্নতায় হাসপাতালগুলোই সবচেয়ে পিছিয়ে!

August 25, 2019 | 8:18 am

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি ক্রমশই যেন ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে। হাসপাতালগুলো রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। ডেঙ্গুর থাবা থেকে মুক্তি মিলছে না ডাক্তারদেরও। রাজধানীর সব হাসপাতালেই মিলছে ডেঙ্গুর চিকিৎসা। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালও এর ব্যতিক্রম নয়। রাজধানীর অন্যতম একটি হাসপাতাল যেখানে প্রতিদিনই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রোগীরা ভর্তি হচ্ছেন। শুধুমাত্র ঢাকা শহরেরই নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও এখানে রোগীরা আসছেন বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা নিতে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় হাসপাতালটির আশেপাশেই আছে ডেঙ্গু ভাইরাসের জন্য দায়ী এডিস মশার চারণভূমি।

বিজ্ঞাপন

হাসপাতালটির মূল ফটক পার হয়ে একটু সামনে এগুলেই দেখা যায় রাস্তার দুই পাশেই বিভিন্ন ফলের দোকান, ডাব, ঝালমুড়িসহ নানা রকমের পসরা সাজিয়ে বসে আছেন কিছু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। পাশেই খেলার মাঠ। আর নজর দিতেই দেখা যায় সেখানে পড়ে আছে ডাবের খোসা আর সেখানে জমে আছে পানি। সেগুলো দেখে মোটেও বলা যাবে না যে সেগুলো খুব সম্প্রতি ফেলা হয়েছে। বৃষ্টির পানি জমে আছে সেই খোসাগুলিতে। পড়ে আছে আরও নানা রকমের প্লাস্টিকের বোতল থেকে শুরু করে নানা রকমের ময়লা।

বিজ্ঞাপন

একটু ভেতরে গেলেই দেখা যায় হাসপাতালের সামনে ভ্যানগাড়িতে করে বিক্রি করা হচ্ছে ডাব। তাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই আছে কিছু বস্তা। ক্রেতারা সেখানে খেলে সেগুলো সেই বস্তায় পুরে ফেলা হচ্ছে। আর বাইরে নিয়ে গেলেই সেগুলো ফেলা হচ্ছে হাসপাতালের বিভিন্ন প্রান্তে। এসব ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা যদি তাদের সামনে কেউ ডাব খায় তবে তার খোসা একটা বস্তায় পুরে রাখে কিন্তু বাইরে নিয়ে যাওয়া ক্রেতাদের যেখানে সেখানে ফেলা ডাবের খোসার দায় তারা নিতে রাজি নন। কিভাবে তারা হাসপাতাল প্রাঙ্গণে এমন পসরা সাজিয়ে বসেছেন এই প্রশ্ন করা হলে তা এড়িয়ে যান ব্যবসায়ীরা। এভাবে ভ্যানে করে ডাব বিক্রি করতে দেখা যায় বেশ কয়েকজনকে। তবে কিভাবে তারা এখানে বসে এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজী হয়নি কেউই।

মেডিকেল কলেজ ভবনের দিকে এগুতেই দেখা গেল হাসপাতাল ভবনের পাশেই পড়ে আছে নানা রকমের ময়লা। ছোটখাটো প্লাস্টিকের কাপ থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকমের পাতিল সহ অন্যান্য ময়লা। পাশেই থাকা হাসপাতালের জানালা দেখা যায় খোলা। পাশে আরও দেখা মিলল একটি পরিত্যক্ত ভ্যান গাড়ি, আর সেই ভ্যানে জমে আছে পানি। স্থানটি সাধারণ মানুষের দেখে ভাল না লাগলেও এডিস মশার প্রজননের জন্য আরামদায়কই।

বিজ্ঞাপন

গত ৫ আগস্ট বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের প্রধান কীটতত্ত্ববিদ ডা. ভুপেন্দর নাগপাল বলেছিলেন, ‘এডিস মশা বছরের ৩৬৫ দিনই ডিম পাড়ে। এক বছরেও এসব ডিম নষ্ট হয় না। আর পানি পেলে সেই ডিম থেকেই মশা জন্ম নেয়। তাই ভেক্টর কন্ট্রোল করা ছাড়া এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। মাত্র এক চা-চামচ পানিতেও এডিস মশা ডিম পাড়ে। যে ডিম পানি ছাড়াও প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে পারে।’

আগস্টের শুরুর দিকে দেশজুড়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে হাসপাতালটিতে নতুন ২০০ টি বেড সংযোজন করা হয়। তবে রোগীর সংখ্যা কমতে থাকলেও হাসপাতালটির বাইরের এমন পরিবেশে উদ্বিগ্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরাও।

বিজ্ঞাপন

হাসপাতালের চারদিকে কেন এমন অবস্থা তা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা সবসময়ই বলে আসছি ডেঙ্গু মোকাবিলার জন্য সবচাইতে জরুরি বিষয় হলো জনগণের সচেতনতা। অথচ দেখা যায় অনেকেই এমন খোসা ফেলছে বিভিন্ন দিকে, আবার কেউবা বোতল ফেলে রাখছে যেখানে সেখানে। তবে এটা বলে আমাদের নিজেদের চেষ্টার কোনো কমতি আমরা রাখি না। তবে তিনদিন ধরে ডাবের খোসা বা বোতল পড়ে থাকবে বিষয়টা কিন্তু তাও না। হাসপাতালের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য আমরা সবসময়ই সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাই। আমাদের হাসপাতালে আমরা প্রতিদিন ৬ জন লোককে নিয়োগ করেছি শুধুমাত্র বাইরের দিক পরিষ্কার করার জন্য। তাদের আমরা আলাদাভাবে পেমেন্ট করছি শুধুমাত্র বাইরের দিক পরিষ্কার করার জন্য। যদি বাইরে কোনো ময়লা জমেও যায় তাহলে সেটা পরিষ্কার করাই তাদের কাজ। সুতরাং ময়লা জমে থাকা সুযোগ খুবই কম।’

হাসপাতাল প্রাঙ্গণে থাকা ভ্যানে করে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তাদের আমরা বের করার চেষ্টা করি, তারা বেরও হয়ে যায় কিন্তু পরে দেখা যায় আবার এসে দোকান শুরু করে। তবে একটা বিষয় হলো যেখানে ডিমান্ড থাকবে সেখানে সাপ্লাইও থাকবে। আর তাই হয়তো সেই দোকানিরাও বারবার আসে। জনগণ যদি সচেতন না হয় তবে আসলে এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ খুবই কঠিন।’

হাসপাতালের পাশে থাকা ময়লা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালের মাঝামাঝি স্থানে কিছু ময়লা আছে। তবে সেগুলো আমাদের কিছু নির্মাণাধীন বিল্ডিংয়ের কাজ চলছে সেগুলোর ময়লা।’

এ সময় তিনি ময়লার সঙ্গে এডিসের কোনো সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেন এবং বলেন পানি জমে থাকার সুযোগও খুব বেশি নেই।
তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে আমরা রোগীদের সেবা দেওয়াকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। তাও আমরা চেষ্টা করি সব দিক থেকে হাসপাতালকে নিরাপদে রাখার জন্য।’

হাসপাতালের চিকিৎসক সহ স্বাস্থ্য কর্মীরাও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন। এই ক্ষেত্রে কি হাসপাতালের পরিবেশ কোনো ভাবে দায়ী কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া বলেন, ‘এমন হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। আমরা হাসপাতালের সকলকেই নোটিশ দিয়ে বলেছি সবাই যেনো ফুলহাতা শার্ট, ফুলহাতা প্যান্ট, জামা ও মোজা পরে আসে। প্রচুর পরিমাণে অ্যারোসল দেওয়া সহ প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থায় নিয়েছি। তবে যারা আক্রান্ত হচ্ছেন তারা যে হাসপাতালেই আক্রান্ত হবেন এমন কোনো কথা নেই। কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে হাসপাতালের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত কর্মীরা বিভিন্ন এলাকায় থাকেন। সেখানেও আক্রান্ত হতে পারেন।’

এ সময় এডিস মশা মারার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এডিস মশা বেশি হয় ক্রাউডেড প্লেইসে। স্কুল, কলেজ, হাট-বাজার, হাসপাতালগুলোতে সিটি করপোরেশনের যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। আমি আজকেও উত্তরের সিটি করপোরেশনের সঙ্গে কথা বলেছি যেনো আমাদের হাসপাতালের আশেপাশে মশক নিধনের ঔষধ দেওয়া হয়। ওরা কোনো একদিন আসে। এর পরে আবার ১০-১৫ দিন পরে তাদের দেখা যায়। শুধু আমাদের হাসপাতাল বলছি না, যেসব হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী আছে সেসব স্থানে গুরুত্ব দিয়ে মশক নিধন কর্মসূচি চালানো দরকার।’

এ সময় স্বচ্ছ পানিতে এডিস মশা জন্মায় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বৃষ্টি হচ্ছে আর এমন পরিস্থিতিতে পানি জন্মাতে পারে। কিন্তু যদি আমরা লার্ভিসাইট ধ্বংস করতে না পারি তবে সেটা বিপদ হতে পারে। আর সিটি করপোরেশনের এই মুহূর্তে সেই লার্ভিসাইট ধ্বংস করার জন্যেই প্রয়োজনীয় ভূমিকা নেওয়া দরকার।’

এই বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও মুঠোফোনে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় নি। উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) সেন্ট্রাল জোন ভলিবল চ্যাম্পিয়নশিপ টুর্নামেন্টের সমাপনীতে যোগ দেওয়ার জন্য তিনি নেপাল গেছেন।

মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তহমিনা সাংবাদিকদের জানান, ‘হাসপাতালগুলোকে রোগীর শুশ্রূষায় মনোযোগ দিতে হচ্ছে আর তাই রোগীর চাপ বেশি হওয়ায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পরিচ্ছন্নতার দিকে সেভাবে দৃষ্টি দিতে পারছে না। তবে পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে আবারও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিভিন্ন স্থান থেকে আসা রোগীরা সেবার মান নিয়ে প্রশংসা করলেও আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব ময়লা নিয়ে নিজেদের আশংকার কথা জানান। এ সময় তারা সিটি করপোরেশনকে দায়ী করার পাশাপাশি পরিচ্ছন্ন পরিবেশের জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের জোরালো ভূমিকা আশা করেন।

উল্লেখ্য, স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের হিসাব থেকে জানা যায়, চলতি বছরের ডেঙ্গু মৌসুমে ২৫৩৭ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এর মধ্যে ২১৯৫ জন রোগী সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। বর্তমানে চিকিৎসাধীন আছেন ৩৪২ জন রোগী। এই হাসপাতালে রোগীদের সেবাদানে ব্যস্ত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরাও আক্রান্ত হচ্ছেন ডেঙ্গু রোগে। এই হাসপাতালের ১১ জন চিকিৎসক, ১৩ জন নার্স ও ৬ জন স্বাস্থ্যকর্মীসহ মোট ৩০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। বর্তমানে একজন নার্স হাসপাতালটির নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন আছেন।

সারাবাংলা/এসবি/এসএস

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন