বিজ্ঞাপন

কোঁকড়া চুলে প্রাণ এনে দেয় সিজিএম

August 29, 2019 | 10:53 am

সিরাজুম মুনিরা, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর

এইতো কিছুদিন আগেও দেশে চুল স্ট্রেট বা সোজা করার চল এসেছিল। যত কোঁকড়া আর ঢেউ খেলানো চুলের অধিকারীরা সব নানান রকম রাসায়নিক ব্যবহার করে চুল সোজা করতে শুরু করলেন। বিশেষ প্রক্রিয়া অবলম্বনের পর সেই চুল হয়ে উঠতো নরম, সিল্কি আর ঝরঝরে সোজা।

বিজ্ঞাপন

সময়ের সঙ্গে এখন চুল সোজা করার সেই ট্রেন্ডে কিছুটা ভাটা পড়েছে। এখন বরং নিজের প্রাকৃতিক চুলের গঠনের ওপরেই আস্থা রাখছেন নারীরা। সেইসঙ্গে প্রকৃতিগতভাবে পাওয়া চুলের ধরনের কোনো ক্ষতি না করে কিভাবে স্বাস্থ্যবান চুল পাওয়া যায় সেদিকেই মনোযোগী তারা।

কোঁকড়া বা ঢেউ খেলানো চুলের অধিকারীদের চুলের যত্নে গোটা বিশ্বে নতুন একটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। এর নাম কার্লি গার্ল মেথড বা সংক্ষেপে সিজিএম। ২০০১ সালে হেয়ার স্টাইলিস্ট লরেইন ম্যাসি প্রথম এই মেথড সম্পর্কে বলেন। পরে ২০১১ সালে কোঁকড়া চুলের যত্ন নিয়ে একটি বইও লেখেন তিনি। সেই বইটির নাম কার্লি গার্ল: দ্য হ্যান্ডবুক।

বিজ্ঞাপন

লরেইন ম্যাসিই প্রথম জানান যে, কোঁকড়া বা ঢেউ খেলানো চুলের যত্ন অন্যভাবে করা উচিত। ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করে চুল সাময়িকভাবে সোজা করে ফেলা কোনো সমাধান নয়। তিনি জানান, কোন ধরনের রাসায়নিক থাকলে সেসব শ্যাম্পু, কন্ডিশনার, হেয়ার জেল বা ক্রিম ব্যবহার করা চুলের প্রাকৃতিক গঠনের জন্য ভালো নয়। কিংবা কোঁকড়া চুল কিভাবে শুকাতে হবে বা কিভাবে মুছতে হবে সেটাও।

বাংলাদেশে এখন অনেক নারী সিজিএম মেথড ব্যবহার করে চুলের যত্ন নেন। আর দেশে এই পদ্ধতি জনপ্রিয় করেছেন কাযরিয়া কায়েস। যদিও পেশাগতভাবে তিনি ব্র্যান্ড ও মার্কেটিং নিয়ে কাজ করেন তবে সিজিএম নিয়ে নিজ উদ্যোগেই পড়াশোনা করেছেন বিস্তর। কার্লি গার্ল বাংলাদেশ বাই কাজরিয়া কে নামে একটি ফেসবুক গ্রুপের অ্যাডমিন তিনি। সেখানেই তিনি সহজ বাংলায় বুঝিয়ে বলেন কার্লি গার্ল মেথডের নানা দিক। জানিয়ে দেন কোন শ্যাম্পু বা কন্ডিশনর কখন কিভাবে ব্যবহার করতে হবে সেই তথ্য।

চুলের যত্নের নতুন এই পদ্ধতি নিয়ে সারাবাংলার সঙ্গে কথা হয় কাযরিয়া কায়েসের। তার সঙ্গে কথা বলে সারাবাংলার পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো সিজিএমের আদ্যোপান্ত।

বিজ্ঞাপন
কাযরিয়া কায়েস

কাযরিয়া কায়েস

কাযরিয়া বলেন, ‘আপাতদৃষ্টিতে দেখলে চুল আমাদের শরীরের একটি বাহ্যিক অংশ মাত্র। কিন্তু যদি একটু সময় নিয়ে চিন্তা করে দেখলে বোঝা যাবে, চুল কিন্তু প্রতিটি স্বতন্ত্র মানুষের ব্যক্তিত্বের অপরিহার্য অংশ। আপনার চুল, চুলের স্টাইল এবং সেই চুলকে কিভাবে ক্যারি করছেন সেটাই আপনাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে। আপনার নিজের একটা পারসোনাল স্টেটমেন্ট দাঁড় করায়। চুল পরিপাটি থাকলে এক অন্যরকমের আত্মবিশ্বাসও কাজ করে নিজের ভেতর।’

তিনি বলেন, গতকয়েক দশকধরে সোজা চুলের ফ্যাশন থাকলেও ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে বাংলাদেশের বেশিরভাগ নারীরই ছিল ঢেউ খেলানো চুল। যুগ যুগ ধরে কত শত কবি আর সাহিত্যিকের লেখাতেও পাওয়া যাবে এই চুলের বন্দনা। মুশকিল হলো, এই ঢেউ খেলানো কোঁকড়া চুল নিয়েই আমাদের দেশের নারীদের যত সমস্যা! গরম ও আদ্রতাপূর্ণ আবহাওয়ার এই দেশে যতই পরিপাটি হয়ে বাড়ি থেকে বের হন না কেন, বাইরের হাওয়া লাগা মাত্রই চুলের অবস্থা ১২টা। এসব সামলাতে তখন একটাই উপায় মাথায় আসে হলো হিট কেমিক্যাল ট্রিটমেন্ট, রিবন্ডিং, ব্লো ড্রাই অথবা ফ্ল্যাট আইরনিং। এর মাধ্যমে পাওয়া যায় সিল্কি ঝরঝরে চুল। প্রথম প্রথম দেখতে ভালো লাগলেও ধীরে ধীরে বোঝা যায় এই অতিরিক্ত তাপ আর রাসায়নিক ব্যবহারের অপকারিতা। চুল পড়া, চুলের আগা ফেটে যাওয়া, রুক্ষ ও প্রাণহীন হয়ে যাওয়া, খুশকি এসব নানা লক্ষণ দেখা যায়।

প্রচলিত পদ্ধতি অনুযায়ী সব সমস্যার সমাধার হিসেবে নারকেল তেলের নাম চলে আসে উল্লেখ করে কাযরিয়া বলেন, কিন্তু ঢেউ খেলানো বা কোঁকড়া চুল এর যত্নের পদ্ধতি একদম আলাদা। সোজা চুল এর তুলনায় কোঁকড়া চুলের দরকার বাড়তি যত্ন ও পর্যাপ্ত পরিমান আদ্রতা। কোঁকড়া চুল নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণার পর যুক্তরাষ্ট্রের নামকরা হেয়ার স্টাইলিস্ট এবং লেখক লরেইন ম্যাসি এই কার্লি গার্ল মেথড আবিস্কার বরেন। তার লেখা কার্লি গার্ল: দ্য হ্যান্ডবুক বইটিকে সারাবিশ্বে কোঁকড়া চুলের বাইবেল বলা হয়।

এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে যে শুধু চুলের সৌন্দর্য বাড়ে তা নয়, খুশকি দূর হওয়া, চুল পড়া বন্ধ হয় আবার মাথার ত্বকও সুস্থ থাকে।

বিজ্ঞাপন
সিজিএম পদ্ধতি অনুসরণ করেন শাতিল মাহমুদ

সিজিএম পদ্ধতি অনুসরণ করেন শাতিল মাহমুদ

গত বছর পুরো বিশ্বজুড়ে গতানুগতিক সৌন্দর্যের মানদণ্ডের বিরুদ্ধে ও নিজের প্রকৃতি প্রদত্ত সৌন্দর্যকে গ্রহণ করার উদ্দেশে ‘কার্ল ইজ বিউটিফুল’ স্লোগান নিয়ে একটি আন্দোলনও হয়। এই আন্দোলনের পর সিজিএম মেথড সম্পর্কে বিশ্বের মানুষ আরও বেশি করে জানতে পারেন।

কাযরিয়ার কাছে জানতে চাই এই পদ্ধতির খুঁটিনাটি সম্পর্কে। তিনি বলেন, ‘সিজিএম সম্পর্কে আপনি ইন্টারনেট ঘাঁটলেই প্রচুর ভিডিও এবং আর্টিকেল পাবেন। ইন্সটাগ্রাম ও ইউটিউবে অনুসরণ করতে পারেন বিভিন্ন কার্লি গার্ল মেথড ফলো করা বিউটি ব্লগারদের। এছাড়া আছে ফেসবুকে বিভিন্ন সাপোর্ট গ্রুপ এবং কার্ল কমিউনিটি আছে যেখানে আপনি পাবেন এই মেথড সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য, অনুসরণ করার পদ্ধতি ও গাইডেন্স।’

২০১৭ সালে নিজে এই মেথড অনুসরণ শুরু করেন কাযরিয়া। নিজে উপকার পাওয়ার পর তার মনে হয় এটা বাংলাদেশের অন্য নারীদেরও জানানো উচিত। সেই ভাবনা থেকেই খোলেন কার্লি গার্ল বাংলাদেশ বাই কাযরিয়াক নামের ফেসবুক গ্রুপটি।

কাযরিয়া জানালেন, সিজিএম এ আগ্রহীদের জন্য এই মেথড এর মূল ধাপগুলো এরকম:

  • সালফেট ও সিলিকন ফ্রি শ্যাম্পু ব্যবহার করতে হবে
  • সিলিকন ফ্রি কন্ডিশনার ব্যবহার করতে হবে
  • গোসলের পর চুল শুকানোর জন্য গামছা, মাইক্রোফাইবার টাওয়েল বা টিশার্ট ব্যবহার করতে হবে, চুল ঝাড়া যাবেনা
  • শুকনা চুল আঁচড়ানো যাবে না
  • চুল ব্লো ড্রাই, আয়রন করা যাবে না
  • কোন ধরনের কেমিক্যাল ট্রিটমেন্ট করা যাবে না
  • চুলকে পরিপাটি রাখতে ভেজা চুলে অ্যালকোহল ফ্রি জেল ব্যবহার করতে হবে

নিয়মিত সিজিএম ব্যবহার করলে চুল পড়া বন্ধ হবে, খুশকি দূর হবে, চুল নরম, ঘন ও উজ্জ্বল হবে, ম্যানেজ করা সহজ হবে। একইসঙ্গে মাথার তালু ও চুলের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে।

যারা চুলে সিজিএম করতে চান তাদের শুরুতেই প্রচলিত সালফেট সমৃদ্ধ শ্যাম্পু ব্যবহার বন্ধ করে দিতে হবে। যে কন্ডিশনার, হেয়ার ক্রিম বা জেলে সিলিকন আছে সেটিও বন্ধ করতে হবে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সিলিকন চুলের ওপর একটি আলগা আবরণ সৃষ্টি করে তা মসৃণ করে, তাই সিলিকন সমৃদ্ধ পণ্য ব্যবহার বন্ধ করে দিলে প্রথম কিছুদিন নিজের কাছেই চুলের মান খারাপ হয়ে গেছে বলে মনে হতে পারে। কিন্তু সিজিএমের উপকারিতা পেতে হলে কিছুদিন অপেক্ষা করতেই হবে।

নাতাশা পারভেজ নাবিলা ও সুমাইয়া ইকবাল সিজিএম অনুসরণ করে পেয়েছেন দারুণ ঝলমলে চুল

নাতাশা পারভেজ নাবিলা ও সুমাইয়া ইকবাল সিজিএম অনুসরণ করে পেয়েছেন দারুণ ঝলমলে চুল

এবার একটু বিস্তারিতভাবে দেখি সিজিএমের ধাপগুলো।

এই পদ্ধতি ব্যবহারের শুরুতেই সালফেট আছে কিন্তু সিলিকন নেই এমন একটি শ্যাম্পু দিয়ে চুল পরিস্কার করতে হবে। এতোদিন বিভিন্ন পণ্য ব্যবহার করার ফলে চুলে এসবের যে অবশিষ্টাংশ জমেছিল সেগুলো ধুয়ে দেবে এই শ্যাম্পু। পুরো মেথডে এই শ্যাম্পুটি আর ব্যবহার করা যাবে না।

এরপর চুলে কার্লি গার্ল মেথড সাপোর্ট করে এমন ডিপ কন্ডিশনার বা প্যাক দিতে হবে। প্যাক লাগিয়ে চুল ৪৫ মিনিটের জন্য শাওয়ার ক্যাপ দিয়ে ঢেকে রাখলে ভালো। তারপর স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানি দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলতে হবে।

কোঁকড়ানো আর ঢেউ খেলানো চুলের জন্য বেশি আর্দ্রতা প্রয়োজন। সে কারণে চুলকে জটমুক্ত আর সুন্দর রাখতে বিশেষ পদ্ধতিতে চুলের পানি ঝরানো দরকার। এর নাম স্কুইজ। এ পদ্ধতিতে হাতকে কাপের মতো করে তার ভেতরে অল্প অল্প চুল নিয়ে ওপরের দিকে চাপ দিয়ে পানি ঝরাতে হয়। পুরো মাথার চুলের প্রাথমিক পানি এভাবে ঝরাতে হয়। পুরো পদ্ধতি দেখতে চাইলে ইউটিউবের বিভিন্ন ভিডিও দেখে নিতে পারে।

এরপর মাইক্রোফাইবার তোয়ালে বা পুরোনো টিশার্ট দিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে চুলের বাড়তি পানি শুষে নিতে হয়। এই পদ্ধতির নাম প্লপিং। ২০ মিনিটের জন্য প্লপিং করতে হয়।

এরপর তোয়ালে খুলে অ্যালকোহল ফ্রি জেল হাতে নিয়ে ডিফাইন কার্ল পেতে স্ক্রানচ করতে হয়। এই পদ্ধতিও দেখে নিতে পারবেন ইউটিউবে। এই পর্যায়ে চুল শুকাতে হবে। সেক্ষেত্রে আপনি সাধারণ বাতাসেই চুল শুকাতে পারবেন। তবে যদি হেয়ার ড্রায়ার ব্যবহার করতে চান সেক্ষেত্রে ডিফিউজার ব্যবহার করে অল্প তাপে চুল শুকাতে হবে।

সিজিএমে প্রতিদিন শ্যাম্পু করা নিষেধ। খুব প্রয়োজন হলে লো-পু শ্যাম্পু বা সিজিএম সাপোর্টেড কন্ডিশনার দিয়ে শ্যাম্পুর কাজ সারতে হবে। এছাড়া প্রতিদিন চুল ভেজাতেও নিরুৎসাহিত করা হয়। কেননা প্রতিদিন চুল ভেজালে মাথার ত্বর থেকে যে প্রাকৃতিক তেল বের হয় তা বাধাপ্রাপ্ত হয়।

এরকম বেশকিছু ছোট ছোট বিষয় নিয়েই সিজিএম। যারা নিয়মিতভাবে এই পদ্ধতি পালন করেত পেরেছেন তারা পেয়েছেন মনমতো চুল। তাদের চুল পড়া কমেছে, চুলের মানও ভালো হয়েছে। আর সে কারণেই সিজিএম এখন জনপ্রিয় একটি পদ্ধতি।

ছবি: কার্লি গার্ল বাংলাদেশ বাই কাজরিয়া কে ফেসবুক গ্রুপ থেকে

সারাবাংলা/এসএমএন

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন