বিজ্ঞাপন

‘কে চালাবে আমার সংসার’

August 29, 2019 | 11:10 pm

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ‘পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ ছিলাম। আমার স্বামী শিক্ষকতা করতেন, এখন তিনি অবসরে। এক ছেলে ও এক মেয়ে। দুজনই পড়াশোনা করে। আমি এখনো জানি না পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে পারবো কি না? সড়ক দুর্ঘটনায় পা হারানোর যে যন্ত্রণা তার চাইতেও বেশি কষ্ট পাচ্ছি আমার পরিবারের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। কে চালাবে আমার সংসার? অনিরাপদ সড়ক যেনো এভাবে আর কেড়ে না নেয় কোনো পরিবারের একমাত্র সম্বলকে’—হাসপাতালের বেডে শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন সড়ক দুর্ঘটনায় পা হারানো কৃষ্ণা রায় চৌধুরী।

বিজ্ঞাপন

বৃহস্পতিবার (২৯ আগস্ট) রাজধানীর শের-ই বাংলা নগরের জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) গিয়ে দেখা যায় সেখানে একটি কেবিনে চিকিৎসাধীন আছেন তিনি। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) সহকারী ব্যবস্থাপক (অর্থ) কৃষ্ণা রায় চৌধুরী। স্বামী অবসরপ্রাপ্ত সহযোগী অধ্যাপক রাধেশ্যাম চৌধুরী ব্যস্ত সহধর্মিনীর সেবা শুশ্রুষায়। কৃষ্ণা রায় চৌধুরীর ছোট বোন শুক্লা রায় ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা এসময় সঙ্গেই ছিলেন।

আহত কৃষ্ণা রায় চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘দুপুরে অফিস থেকে বের হয়ে পায়ে হেঁটে ব্যাংকের দিকে যাচ্ছিলাম। ঘড়ির কাঁটায় তখন দুইটা বাজে। ফুটপাথ দিয়ে যখন হেঁটে যাচ্ছিলাম তখনই হঠাৎ করে খেয়াল করলাম বাসটি আমার দিকে আসছে। কোনো মতে নিজেকে একটু সরিয়ে নিতে পারলেও পারিনি পুরোপুরি সরে যেতে। আর তার পরেই মনে হলো আমার পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে আসছে। যদি নিজেকে সেই পরিমাণও সরাতে না পারতাম তবে আমি প্রাণে বাঁচতে পারতাম না কখনোই। মাথায় আঘাত পেলেও সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। এক পা উঠাতে পারলেও আরেক পা কোনোভাবেই মনে হচ্ছিল নাড়াতে পারছিলাম না। কেনো যেনো মনে হচ্ছিল পা আমার আলগা কোনো কিছু।’

বিজ্ঞাপন

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশের সড়কে চলা যাত্রীবাহী গাড়িগুলোতে আমি ভয়ে উঠতাম না সড়ক দুর্ঘটনার ভয়ে। অফিসের স্টাফ বাসেই তাই যাওয়া আসা করতাম। সেদিনও আমি নিয়ম মেনে ফুটপাত দিয়েই হেঁটে যাচ্ছিলাম। সেখানেও আমাকে এই দুর্ঘটনার শিকার হতে হলো। বাস তো চলার কথা রাস্তায়। সেটা ফুটপাথে কেনো? ফুটপাথও যদি নিরাপদ না হয়ে থাকে তবে মানুষের নিরাপত্তা কোথায়?’

এ সময় তিনি বলেন, ‘পাশে থাকা দুইজন তরুণ এগিয়ে আসে আমাকে সাহায্য করতে। তাদের বলি আমাকে ঘটনাস্থলের পাশেই থাকা হলিফ্যামিলি হাসপাতালে নিয়ে যেতে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়। এরপরেই হলিফ্যামিলি হাসপাতালের নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্স করে আমাকে এই হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।’

এই সময় তিনি দ্রুত এই দুর্ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি দাবি করে বলেন, ‘গাড়ির কোম্পানির পক্ষ থেকে নাকি এই ঘটনায় ২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে চেয়েছিল। যেখানে আমার একটি পা আমি হারিয়েছি সেখানে এই ২ লাখ টাকা দিয়ে কি করবো? ওরা কি পারবে আমার পা ফিরিয়ে দিতে?’

বিজ্ঞাপন

কৃষ্ণা রায় চৌধুরীর স্বামী রাধেশ্যাম চৌধুরীর গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার উচ্চঙ্গা গ্রামে। ঢাকার মাণিকনগরে ভাড়া বাসায় থাকেন বলে জানালেন। স্ত্রীর পাশেই সেবা শুশ্রুষাতে ব্যস্ত থাকা উনার চোখ থেকে অশ্রুফোটা ঝরছিল।

তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে প্রতিদিনই কেউ না কেউ প্রাণ হারাচ্ছেন। তাও কেউ সচেতন হচ্ছে না। আমি একজন অবসরপ্রাপ্ত সহযোগী অধ্যাপক। আমার ছেলে কৌশিক ঢাকা বিজ্ঞান কলেজ থেকে অনার্স শেষ করেছে এবং মেয়ে জগ্ননাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। আমার পরিবারের সবকিছুই দেখাশোনা করতো আমার স্ত্রী। ওর কষ্ট দেখে আর সহ্য হচ্ছে না। ট্রাস্ট কোম্পানি থেকে এসেছিল টাকা দিয়ে ঘটনা মিটমাট করতে। কিন্তু আমরা রাজি হইনি। মামলা করেছি। আমরা অপরাধীদের দ্রুত শাস্তি দেখতে চাই।

আহত কৃষ্ণা রায় চৌধুরীর ছেলে কৌশিক চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘মার পা কেটে ফেলতে হয়েছে। আর কখনো পায়ে ভর দিয়ে হাঁটবেন না। এ কথা মনে আসলেও আর কোনো সান্ত্বনা দিয়ে মনকে বোঝাতে পারি না। আমার মা তো ফুটপাতেই হাঁটছিলেন। সেখানে কেনো গাড়ি উঠবে?’

বিজ্ঞাপন

কৃষ্ণা রায় চৌধুরীর বোন শুক্লা রয়। তিনি জানান, ‘চার বোনের মধ্য সবার বড় কৃষ্ণা রায় চৌধুরী। মানিকগঞ্জে আমাদের বাড়ি। আমাদের পরিবারের সকল সিদ্ধান্ত দিদিই নিতেন। আমরাও উনার সিদ্ধান্ত মেনে চলতাম। দুর্ঘটনার খবর শুনে সিলেট থেকে এসেছি। ফুটপাতেও যদি মানুষের নিরাপত্তা না থাকে তবে মানুষ যাবে কোথায়? দিদির পরিবারের কি হবে?’

জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম চিকিৎসাধীন কৃষ্ণা রায় চৌধুরীকে দেখতে যান। তিনি বলেন, ‘কোনো ধরণের সংক্রমণ না হলে খুব দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠবেন তিনি। ড্রেসিংটা করতে হবে সময়মতো।’

পা কেটে ফেলার সঙ্গে কোনো প্রাণ ঝুঁকি থাকে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘মানুষের রক্তে যেমন হেমোগ্লোবিন থাকে ঠিক তেমন মাসলে থাকে মায়োগ্লোবিন। সেই মায়োগ্লোবিনের অভাবে মাসলে অনেক ধরণের সমস্যা দেখা দিতে পারে। আর তাই অনেক ক্ষেত্রে রোগীদের সঙ্গে ঝুকি নেওয়া যায় না। কারণ আগে মানুষের জীবন বাঁচাতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটে। দেখা যায় অনেক দিন ধরে ড্রেসিং করতে করতে রোগীর পা কোনো এক সময় স্বাভাবিক হয়ে আসতে পারে কিন্তু সেটা অনেক দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। সবাই আসলে সেই সময় অপেক্ষা করতে চায় না কারণ সেটা ব্যয়বহুলও। তবে যদি যথাযথ প্রক্রিয়ায় মনিটরিং করা হয় লাইফ রিস্ক তেমন থাকে না।’

উল্লেখ্য, মঙ্গলবার (২৭ আগস্ট) দুপুর আড়াইটার দিকে ট্রাস্ট পরিবহনের একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফুটপাতে উঠে গেলে আহত হন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) সহকারী ব্যবস্থাপক (অর্থ) হিসেবে কর্মরত কৃষ্ণা রায় চৌধুরী।

এই ঘটনায় বুধবার (২৮ আগস্ট) সন্ধ্যায় পা হারানো ওই নারীর স্বামী রাধেশ্যাম বাদী হয়ে থানায় মামলা দায়ের করেন। রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় মামলা দায়ের করা হয় বলে নিশ্চিত করেন হাতিরঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বজলুর রশিদ। এতে বাসটির চালক-মালিক এবং হেলপারকে আসামি করা হয়েছে।

সারাবাংলা/এসবি/এমআই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন