বিজ্ঞাপন

বিএনপি: উত্থানের তিন দশক, পতনের এক যুগ

September 1, 2019 | 1:56 pm

আসাদ জামান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের মধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জিয়াউর রহমানের আবির্ভাব। এর পর ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিএনপি গঠন করেন তিনি। পরের তিন দশক ছিল বিএনপির উত্থানের দশক। আর শেষ এক যুগ বিএনপির পতনের যুগ— এমনটিই বিশ্লেষণ রাজনীতি সংশ্লিষ্টদের।

বিজ্ঞাপন

বিএনপি গঠনের মাত্র তিন বছরের মাথায় ১৯৮১ সালে ৩০ মে সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন জিয়াউর রহমান। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে বিএনপির রাজনীতিতে জিয়া পর্বের সমাপ্তি ঘটে। এর কিছুদিন পরেই দলের হাল ধরেন খালেদা জিয়া। ১৯৮৪ সালের ১০ মে বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন তিনি।

বিশ্লেষকদের মতে, সেনা ছাউনিতে জন্ম নেওয়া বিএনপিকে গণতান্ত্রিক মোড়কে নিয়ে আসার কাজটি মূলত খালেদা জিয়াই করেছেন। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর চরম সংকটকালে বিএনপির দায়িত্ব নিয়ে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন তিনি। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে দলের কাছ থেকে ‘আপসহীন’ নেত্রী উপাধি পান। তার নেতৃত্বেই বিএনপি তিনবার ক্ষমতায় আসীন হয়।

ধারণা করা হয়, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর থেকে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর— এই ৩১ বছর ছিল বিএনপির উত্থান পর্ব। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত— এই ছয় বছর বাংলাদেশের বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠী বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানক নেতা হিসেবে গ্রহণ করেছে। তাকেই ভেবেছে জাতির ত্রাণকর্তা। ফলে তার হাতে গড়া দল বিএনপিকে দিয়েছে অকুণ্ঠ সমর্থন। রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্যারালাল শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে জিয়াউর রহমানের বিএনপি।

বিজ্ঞাপন

জিয়াউর রহমানের অবর্তমানে ১৯৮১ থেকে ২০০৬— এই ২৫ বছর বিএনপিকে অনেক সংকটকাল পাড়ি দিতে হয়েছে। কিন্তু দলটির জনপ্রিয়তা, সাংগঠনিক শক্তি, ভোট, জনসমর্থন, নেতৃত্ব দেওয়ার মতো নেতার অভাব হয়নি। নব্বুয়ের ছাত্রআন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের অনেকেই ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কেউ কেউ প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রীও হন। তাদের দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে নতুন প্রজম্মের হাজার হাজার তরুণ বিএনপির রাজনীতিতে ভেড়ে। খালেদা জিয়া হয়ে ওঠেন তাদের আদর্শ।

তবে এক সময় ক্ষমতার রাজনীতি ও পূত্রস্নেহের কাছে হেরে যান খালেদা জিয়া—এমনটিই মনে করেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতেই স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের সঙ্গে জোট বাঁধেন খালেদা জিয়া। জামায়াত নেতাদের ‘ভুল’ দিক-নির্দেশনায় পরিচালিত হতে থাকেন তিনি। তার মন্ত্রিসভায় স্থান পায় চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহ্সান মুহাম্মদ মুজাহিদ। স্বাধীন বাংলায় স্বাধীনতাবিরোধীদের দাপটে কোণঠাসা হতে থাকে স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি।

মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দলের তকমা হারিয়ে বিএনপি পরিণত হতে থাকে চরমপন্থী দলে। সারাদেশে সিরিজ বোমা হামলা, ব্রিটিশ হাই কমিশনারের ওপর গ্রেনেড হামলা, বাংলা ভাইয়ের উত্থান, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এস এম কিবরিয়াকে গ্রেনেড মেরে হত্যা, সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার দায় নিতে হয় বিএনপিকে। শুরু হয় বিএনপির পতনের যুগ।

বিজ্ঞাপন

অনিবার্য পরিণতি হিসেবে ৪১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এসে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া রয়েছেন কারাগারে, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নির্বাসনে— এমনটিই মনে করছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা। তাদের ধারণা, চলমান সংকট থেকে শিগগিরই উত্তরণ ঘটছে না বিএনপির। কারণ, নিজেদের ভুল-ক্রটিগুলো না শুধরিয়ে প্রতিপক্ষের ‘বিমাতাসূলভ’ আচরণকেই পতনের প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন বিএনপি নেতারা।

বিএনপির দাবি, এক/এগারোর সেনা সমর্থিত সরকারের উদ্দেশ্য ছিল বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। এজন্য তারা খালেদা জিয়াকে ‘মিথ্যা’ মামলা দিয়ে গ্রেফতার করে। আটক করে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোকে। বিএনপির সিনিয়র নেতারাও গণগ্রেফতারের শিকার হন। সংস্কার ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে কারাগারের বাইরে থাকা নেতাদের দুই ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারও বিএনপিকে ধ্বংস করার জন্য ষড়যন্ত্র করছে। এরই অংশ হিসেবে জিয়া অর্ফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে খালেদা জিয়াকে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকেও মুদ্রাপাচার মামলা, জিয়া অর্ফানেজ ট্রাস্ট মামলা এবং ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় সাজা দেওয়া হয়েছে।  কৌশলে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে তার দেশে ফেরার পথ।

তবে বিএনপি নেতাদের এই সরলীকরণ চিন্তার সঙ্গে খোদ বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীরাও একমত নন। এদের অনেকেই মনে করেন, ব্যাপক জনসমর্থন ও জনভিত্তি থাকা সত্ত্বেও দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, চৌর্যবৃত্তির এবং স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে আজন্ম সম্পর্কের কারণে বিএনপি ধীরে ধীরে তার স্বকীয়তা হারাচ্ছে। খাদের কিনারে চলে যাচ্ছে দলটি। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সঠিক নেতৃত্ব খুঁজে নিতে হবে বিএনপিকে। কারাবন্দি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং নির্বাসনে থাকা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিকল্প খুঁজতে হবে এখনই।

এ প্রসঙ্গে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া দল বিএনপির গঠনতন্ত্র পড়লেই বোঝায় যায়, এটি অনেক বেশি গণতান্ত্রিক। সেই গণতান্ত্রিক দল আজ শুধু খাদের কিনারে নয়, কবরের কিনারে চলে গেছে। এটি বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য দুঃসংবাদ। দলটিকে বাঁচাতে হবে। আর এ জন্য প্রয়োজন জিয়াউর রহমানের মতো একটি ক্যারেক্টার খুঁজে বের করা। একজন কারাগারে, আরেকজন থাকবেন লন্ডনে- এভাবে দল চলে না। একজন সৎ লোক দরকার, সাহসী লোক দরকার। আমি মনে করি, সেই লোকটি হতে পারেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।’

বিজ্ঞাপন

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সভাপতি ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটা সত্য, একজন সেনাশাসকের হাতে বিএনপির জন্ম। কিন্তু বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান মানুষের ভালোবাসা অর্জন করতে পেরেছিলেন। তার দল বিএনপি মানুষের সমর্থন কুড়াতে সক্ষম হয়েছিল। এ দলটির জনসমর্থন আওয়ামী লীগের কাছাকাছি। ৪১বছরে এটিই বিএনপির সবচেয়ে বড় অর্জন। আর স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক দুঃখজনক। এটা থাকা উচিত নয়।’

এ ব্যাপারে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘৪১ বছরে বিএনপির সব চেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে বহুদলীয় গণতন্ত্র, সংসদীয় গণতন্ত্র এবং বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের অকুণ্ঠ সমর্থন। বিপুল এবং ব্যাপক জনসমর্থন আছে বলেই এই প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও বিএনপি টিকে আছে এবং থাকবে।’

বর্তমান সংকট উত্তরণে বিএনপির করণীয় ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি সকল গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে গণতন্ত্র এবং বিএনপির চেয়ারপারস, যিনি গণতন্ত্রের মা’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন, তাকে মু্ক্ত করতে। আগামী দিনে এই দু’টি বিষয়-ই হচ্ছে বিএনপির জন্য সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।’

বিএনপির নেতৃত্ব পরিবর্তন সম্পর্কে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এ ধরনের চিন্তা বিএনপির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। আমাদের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। বিএনপি তথা গোটা বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য তিনি পরীক্ষিত নেত্রী। তার অবর্তমানে তারেক রহমান আমাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।’

সারাবাংলা/এজেড/পিটিএম

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন