বিজ্ঞাপন

শিশুদের জন্য মুক্ত এক সকাল

September 6, 2019 | 4:15 pm

রাজনীন ফারজানা, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর

ঢাকা: ‘ঢাকায় বড় হলেও আমাদের শৈশব ছিল উন্মুক্ত। স্কুলব্যাগ কী জিনিস, চিনতাম না। গুটিকয়েক বই বগলদাবা করেই স্কুলে যেতাম। বৃষ্টি নামলে গায়ের শার্ট খুলে বইগুলো পেচিয়ে বুকে ধরে বাড়িতে ফিরতাম। এভাবে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে বড় হয়েছি দেখেই সহজে জ্বর হতো না আমাদের। শুধু জ্বর নয়, অন্য অসুখ-বিসুখও কম হতো আমাদের। কিন্তু সামান্য রোদ-বৃষ্টিতেই জ্বর-সর্দি বাঁধিয়ে ফেলে আমাদের সন্তানেরা। এর কারণ, বাইরের মুক্ত পরিবেশে তাদের খেলাধূলা করার সুযোগ আমরা করে দিতে পারছি না। পরিবেশের সঙ্গে তাদের সেই সম্পর্কটাই তৈরি হচ্ছে না।’

বিজ্ঞাপন

রাজধানী ঢাকার রাজপথ ফাঁকা পেয়ে যখন শিশুরা নানা ধরনের খেলায় মত্ত, তখন একপাশে তৈরি স্টেজে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিলেন ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটির (ডিটিসিএ) অতিরিক্ত সচিব জাকির হোসেন মজুমদার। শুক্রবার (৬ সেপ্টেম্বর) সকালে ইউনিলিভারের ব্র্যান্ড সার্ফ এক্সেলের সঙ্গে ডিটিসিএ’র আয়োজন ‘কার ফ্রি স্ট্রিট’ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

সার্ফ এক্সেলের ‘মুক্ত হোক শৈশব’ ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবে প্রতি মাসের প্রথম শুক্রবার মানিক মিয়া এভিনিউয়ের দক্ষিণ প্লাজার কিছু অংশের রাস্তা খুলে দেওয়া হবে শিশুদের জন্য। এই সময়ে ওই রাস্তায় চলবে না কোনো গাড়ি। মুক্ত সড়কে শিশুরা খেলবে, ছুটে বেড়াবে— এটিই এই আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য।

শুক্রবার সকাল থেকেই ভাদ্রের আকাশে হালকা রোদ আর মিঠে বাতাসে শুভ্র মেঘের ওড়াউড়ি। এমন দিনে ঘরে থাকতে কে চায়! ইচ্ছে করে মেঘের ডানায় পাল উড়িয়ে ছুটে চলতে। কিন্তু কংক্রিট, যানবাহন আর অতিরিক্ত মানুষের চাপে ধুঁকতে থাকা এই ঢাকায় সেই সুযোগটুকুই বা মেলে কয়জনের।

বিজ্ঞাপন

স্কুল, কোচিং আর চার দেয়ালে বন্দি শিশুদের কাছে শৈশবের আনন্দ মানেই তাই ছয় ইঞ্চির ট্যাবে আটকে থাকা চোখ, মন, মস্তিষ্ক। তারা জানে না কখন শরত, কখন বসন্ত আর কখন হেমন্ত এসে উঁকি মেরে যায় প্রকৃতিতে। সপ্তাহজুড়ে ট্রাফিক জ্যাম আর কাজের চাপে ক্লান্ত মা-বাবাদের ইচ্ছা থাকলেও তারা জানেন না, সন্তানকে নিরাপদে খেলতে কোথায় নিয়ে যাবেন।

এমন দমবন্ধ সময়ে ‘কার ফ্রি স্ট্রিট’ তাই অনেক অভিভাবকের কাছে স্বস্তির নিঃশ্বাস। রাস্তার এখানে ওখানে শিশুদের জন্য নানারকম খেলাধূলার আয়োজন। কেউ ব্যস্ত ক্রিকেট খেলায়, কেউ লাইন দিয়েছে মিনি সাইজ ভলিবল কোর্টে, কেউ ব্যস্ত ঘুড়ি ওড়ানোয়, কেউ আবার লাইনে দাঁড়িয়ে ভলান্টিয়ারদের সাহায্যে তীর ছোঁড়ার প্র্যাকটিস করছে।

এখানে-সেখানে পাতা রঙিন কার্পেট। সেখানে চলছে লুডু, দাবা, ক্যারম, ছবি আঁকা, প্রশিক্ষকের সাহায্যে কাগজ দিয়ে নানারকম খেলনা বানানোর ‘কর্মব্যস্ততা’। একদিকে একটা কার্পেটে প্লাস্টিকের ফেন্স দিয়ে ঘেরা বলের রাজ্য। নিতান্ত শিশু, যারা হাঁটতে পারে কি পারে না, তাদের জন্য এই আয়োজন। এদিকে যে শিশুটি দৌড়াতে পারে, সেও কান্না জুড়েছে ওই বলের রাজ্যে ঢোকার! তার বিব্রত মা-বাবাকে অন্য শিশুদের মা-বাবা বলছেন, ‘দিন, দিন। কিছু হবে না।’ লাজুক মুখে সন্তানের জুতো খুলে বসিয়ে দিচ্ছেন সেই বলের রাজ্যে। ভেতরে নেমেই কথা না ফোটা বাচ্চাদের সঙ্গে বল খেলায় মেতে উঠছে ‘বড়’ শিশুটি। নির্মল সেই দৃশ্য ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন অভিভাবকরা। সবার মুখেই হাসি। মানসিক চাপের যে রেখা থেকে রাজধানীবাসীর মুক্তি নেই, এদিন শিশুদের ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা মা-বাবাদের মুখ থেকে যেন সেই চাপই উধাও।

বিজ্ঞাপন

চারদিকে এমনই উৎসবমুখর পরিবেশ। টয় কার, সাইকেল, ট্রাই-সাইকেল, স্কুটি, ছোট আকারের দোলনা, স্লাইড— সবই আছে। সেদিকে অবশ্য একটু মান-অভিমানও চলছে ক্ষণে ক্ষণে। নিজের শরীরের তুলনায় ছোট সাইকেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে একটি শিশু। আরও কয়েকজন উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে। তাদের মা-বাবা টেনেও অন্যদিকে নিতে পারছেন না। এদিকে যে বসে আছে, তাকেও ওঠাতে পারছেন না। দুই পক্ষের অভিভাবকই কিছুটা বিব্রত। কিন্তু কেউই বিরক্ত নন। মান-অভিমান, জেদ, চঞ্চলতা, কাড়াকাড়ি, হুড়োহুড়ি— এসব নিয়েই না শৈশব।

শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোহিত কামাল বলছিলেন শিশুদের বাইরে খেলার গুরুত্বের কথা। তিনি বলেন, ‘অনেক মা-বাবাই দেখছি শিশুদের হাত ছাড়ছেন না। কিন্তু ছাড়তে হবে। দৌড়ে চলে যেতে দিন, ও নিজেই ফিরে আসবে। এভাবেই একজন আত্মবিশ্বাসী মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে আপনার সন্তান।’

বাবা শিহাবের সঙ্গে ‘ক্যাম’ (ক্যারম) খেলছিল প্লে গ্রুপে পড়ুয়া তুবা। শিহাব এবারই প্রথম এসেছেন এই আয়োজনে। এমন খোলামেলা জায়গায় তুবার আনন্দ দেখে এখন থেকে নিয়মিত এমন আয়োজনে আসতে চান তিনি। ততক্ষণে তুবা উঠে পড়েছে বাবার হাত ধরে, টানছে দোলনার ওদিকে যাওয়ার জন্য।

বিডি সাইক্লিস্টের আয়শা লিপি তার সাত বছরের ছেলে অভিকে নিয়ে এসেছেন। সকাল ৮টা বাজতেই হাজির তারা। অভি কিছুতেই বাসায় যাবে না। স্কেটিং, সাইকেল চালানো থেকে শুরু করে সব খেলায় তাকে অংশ নিতেই হবে। ছেলের আনন্দে আনন্দিত মা তাই ১১টা পর্যন্ত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আজ কিছুটা মেঘের ছায়া থাকায় তিনিও নিশ্চিন্ত মনে ছেলেকে ছুটতে দিয়েছেন। জানালেন, পরেরবার মেয়েকেও নিয়ে আসবেন।

লিপি জানান, আগেও এসেছেন এখানে। সন্তানদের একটু খোলামেলা পরিবেশে খেলতে নিয়ে আসার জন্য বন্ধু-বান্ধব মিলে গ্রুপ করেই আসেন এখানে।

মুক্ত প্যানেল আলোচনায় ইউনিলিভার বাংলাদেশের ফ্যাব্রিক সলিউশনের ক্যাটাগরি হেড জিশান বায়েজিদ রহমান বলছিলেন, একটি শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য মুক্ত পরিবেশে খেলাধূলা করা খুব দরকার। কিন্তু আমাদের শিশুদের শৈশব আজ হুমকির মুখে। অবকাঠামোগত ও সামাজিক কারণেই শিশুরা বাইরে যেতে পারে না। তারা মোবাইল বা অন্য কোন ডিভাইসে ব্যস্ত থাকে।

‘কার ফ্রি স্ট্রিট’ ক্যাম্পেইনের উদেশ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, শিশুদের খোলামেলা পরিবেশে বেড়ে ওঠার গুরুত্ব সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করা— এটুকুই আমাদের উদ্দেশ্য।

মোহিত কামাল বলেন, অনেক মা-বাবাই সন্তানের লেখাপড়ায় খারাপ হয়ে যাওয়ার সমস্যা নিয়ে আমার কাছে আসেন। তার মতে, এর পেছনের অন্যতম কারণ সঠিক বয়সে পৌঁছানোর আগেই সন্তানের ডিভাইস নির্ভরতা তৈরি হয়ে যাওয়া।

তিনি বলেন, রাত জাগার ফলে বাচ্চার ঘুম কম হয়। এতে তার মনোযোগ নষ্ট হয়ে যায় এবং স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে যায়। অন্তত ১৬ বছর বয়সের আগে ডিভাইস হাতে তুলে দিলে তাদের মোটিভেশনাল স্পিরিট নষ্ট হয়ে যায়। তারা কোনোকিছু শেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তাই সন্তানের সুস্থ বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করতে তাদের উন্নত প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত করালেও বয়স অনুযায়ী ডিভাইসের ব্যবহার সীমিত করে দেওয়ার কথা বলেন তিনি।

সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশের ডেপুটি ডিরেক্টর সৈয়দ মাতিন হাসান বলেন, আধুনিক নগরের শিশুরা অনেক সুবিধা পেলেও তারা আসলে নানা দিক থেকে বঞ্চিত। মুক্ত আকাশ, খোলামেলা পরিবেশ দেখার আনন্দ থেকে বঞ্চিত তারা। এই শহরে শিশুদের নিরাপদ খেলার জায়গা নেই বললেই চলে। এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদদের সঙ্গে আমরা কাজ শুরু করেছি। মানিকনগর অ্যাভিনিউয়ের প্রতি শুক্রবারের এই তিন ঘণ্টার আয়োজন ঢাকার অন্য এলাকার পাশাপাশি অন্য শহরগুলোতেও ছড়িয়ে পড়বে— এমন আশাবাদ তার।

ডিটিসিএ’র পক্ষ থেকে জাকির হোসেন মজুমদার বলেন, ২২ সেপ্টেম্বর সারাবিশ্বেই ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবস পালন করা হয়। ঢাকায় ২০১৬ সালে প্রথম সেই আয়োজন হয়েছিল। এখন প্রতি মাসের প্রথম শুক্রবার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ আর শনিবার মোহাম্মাদিয়া হাজিংয়ের তিন নম্বর রাস্তায় একই আয়োজন করা হয়। ব্যক্তিগত গাড়ির পরিবর্তে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বাড়ানোর পদক্ষেপের একটি অংশ এই আয়োজন। ঢাকার যেকোনো এলাকার কমিশনার তার এলাকায় এই আয়োজন করতে চাইলে ডিটিসিএ’র পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হবে বলেও জানান জাকির হোসেন।

মঞ্চে বসানো ডিজিটাল পর্দায় একটি অডিও-ভিজ্যুয়ালের মাধ্যমে দেখানো হয়, বর্তমান সময়ে একটি শহুরের শিশুর প্রকৃত অবস্থা। প্রতিটা ঘরেই নানা বয়সী শিশু একেকটি ডিভাইস নিয়ে ব্যাস্ত। প্রতিটা ঘরই যেন একেকটি কারাগারের আদলে গড়া।

কোন শিশুই আর ‘কারাগারে’ বড় না হোক, মুক্ত পরিবেশে খেলাধুলা করে বেড়ে উঠুক তারা— এই আহ্বানে শেষ হয় আজকের আয়োজন। এই অনুষ্ঠানেই আগামী ২২ সেপ্টেম্বর ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবস আয়োজনের ঘোষণা দেওয়া হয়।

ছবি: হাবিবুর রহমান

সারাবাংলা/আরএফ/টিআর

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন