বিজ্ঞাপন

ক্যাসিনো কাণ্ড… সাংবাদিকতার জন্য আরেক শিক্ষা!

September 24, 2019 | 5:10 pm

মাহমুদ মেনন, নির্বাহী সম্পাদক

ঘুরে ফিরে আঙ্গুল ওই মিডিয়ার দিকেই উঠেছে। মিডিয়া যখন একের পর এক ক্যাসিনো অভিযানের খবর দিচ্ছিলো, জুয়ার বোর্ড, কাড়ি কাড়ি টাকা, জুয়াড়ি আর জুয়াবাজদের খবর দিচ্ছিলো তখন পাঠক, দর্শক শ্রোতা নতুন কিছু জানলো বলে খুব একটা খুশি থাকতে পারলো না। তারা বরং আঙ্গুল তুললো মিডিয়ার দিকে- এই সাংবাদিকেরা এতদিন কী করেছে?

বিজ্ঞাপন

আঙ্গুল তুলে তারা এটাই দেখিয়ে দিতে চেয়েছে- সংবাদ মাধ্যম, সাংবাদিকতা তথা সাংবাদিকরা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। আর সে কারণেই ঢাকার বুকে এমন ডজন ডজন ক্যাসিনো গড়ে উঠতে পেরেছে। তাতে কোটি কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। পুলিশ কেনো এতদিন ধরতে পারেনি? সে প্রশ্ন একটু কমই শোনা গেছে বা যাচ্ছে।

এই যে মিডিয়ার দিকে আঙ্গুল তোলা হলো- সেখানেই আশার আলো দেখছি। আশার আলো এই জন্য যে, সাধারণ মানুষ মিডিয়ার কাছে এমন প্রত্যাশাই করে। মিডিয়া খবর বের করে আনবে বড় বড় কেলেঙ্কারির, দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজ, জুয়াবাজরা মিডিয়ার মাধ্যমে এক্সপোজড হবে আর তাতে দেশ বাঁচবে, মানুষ বাঁচবে।

সাধারণরা এবার রাজনীতিবিদদেরও খুব দুষেছে বলে স্যোশাল মিডিয়ায় চোখ রেখে চোখে পড়লো না। তারা কী তবে তাদের কাছেও প্রত্যাশা ছেড়ে দিয়েছে? যদি তাই হয় তাহলে মিডিয়াকেই বুঝি মূল ভূমিকাটি নিতে হবে। তার জন্য চাই দক্ষ সংবাদকর্মী আর যোগ্য সংবাদমাধ্যম।

বিজ্ঞাপন

পক্ষপাতহীনতা সাংবাদিকতার অন্যতম দিক। সাংবাদিকতার নীতি সেটাই বলে। তবে সংবাদ চর্চার ভেতরে কিংবা বাইরেও একটা কথা আমরা খুব বলতে পছন্দ করি। তা হচ্ছে- আমাদের পক্ষপাত সাধারণ জনগণের প্রতি। সে কারণেই বুঝি আমাদের প্রতি সাধারণ মানুষের ভালোবাসা বেশি, প্রত্যাশাও বেশি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এত প্রত্যাশা পূরণ আমরা করতে পারছি কী?

একটি প্রশ্ন সামাজিক মাধ্যমে গত কয়েকদিন ধরে ঘুরপাক খাচ্ছে- আচ্ছা গত দু’বছরে সংবাদ মাধ্যমে ঢাকার ক্যাসিনো নিয়ে কোনো খবর বের হয়েছে কী? সাধারন প্রশ্নে সাধারণেরই উত্তর বেশি এসেছে। তারা বলেছেন- না তেমনটা তারা দেখতে পাননি। কেবল যে দেখতে পাননি বলে জানালেন, তা নয়, সঙ্গে বেশ গালাগালও পারলেন। কেউ কেউ তো বলেই ফেললেন- বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় অনুসন্ধানী রিপোর্ট কথাটিই এখন মৃত।

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বস্তুত মৃত নয় কী জীবিত রয়েছে তা নিয়ে এখন আলোচনা নয়, তবে একটু বলে রাখি সত্যিই হয়তো এখন মৃত, কিংবা আমরা হয়তো এই সাংবাদিকতাকে নির্বাসনে পাঠিয়েছি। তবে ঢাকার ক্যাসিনো নিয়ে দেশের সংবাদ মাধ্যম গত দুই বছরে একদম কথা বলেনি, তা কিন্তু নয়। সাধারনের চাপে পড়ে হোক কিংবা নিজেদের গা বাঁচাতে হোক, অনেক সংবাদকর্মীই এই সময়ে ক্যাসিনো কিংবা ঢাকায় জুয়ার আসর নিয়ে তাদের করা বিভিন্ন প্রতিবেদনের কথা তুলে ধরেছেন। স্যোশাল মিডিয়ায় তারা হয় লিংক নয়তো প্রকাশিত খবরের স্ক্রিন শট শেয়ার করেছেন। রাজধানীর ৬০ স্থানে চলছে ক্যাসিনো, রাজধানীতে ক্যাসিনোর ফাঁদ, ঢাকায় ক্যাসিনো: ৮ লাখ টাকা হাওয়া এক শিক্ষার্থীর এমন সব শিরোনামে খবরগুলো ছাপা হয়েছে ২০১৭-২০১৮’র বিভিন্ন সময়ে। তবে সবচেয়ে নজর কেড়েছে বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজামের একটি পোস্ট। তিনি ২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তারিখে তার সম্পাদিত দৈনিকে প্রকাশিত ‘জুয়ায় ভাসছে রাতের ঢাকা’ শিরোনামে করা একটি খবরের স্ক্রিনশট শেয়ার করেছেন তার ফেসবুক পেজে। রিপোর্টটি ছিলো সাঈদুর রহমান রিমনের। অ্যাওয়ার্ডজয়ী রিপোর্টার তিনি। এবং এই শহরের অনেক সন্ত্রাস, অপরাধ তার রিপোর্টিংয়ে উঠে এসেছে নানা সময়ে। এক সময়ের সহকর্মী হিসেবে সাঈদুর রহমান রিমনের ওপর আমার আস্থাও রয়েছে। তার সেই রিপোর্টে সে সব তথ্যই পাওয়া যায়, আজ আবার উদঘাটিত হলো। যেমন একটি লাইন- ‘রাজধানীর মতিঝিল আরামবাগে খেলাধুলা চর্চার জন্য গড়ে ওঠা নামিদামি ক্লাবগুলো বাস্তবে পরিণত হয়েছে জুয়ার আস্তানায়।’

বিজ্ঞাপন

তখনই তিনি তথ্য দিয়েছিলেন- রাজধানীতে অন্তত দেড়শ’ জুয়ার স্পট রয়েছে। যাতে দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা জুয়ার আসর চলে। আর একেকটি স্পটে প্রতিদিন দুই থেকে তিন কোটি টাকার জুয়া খেলা হয়। এসব জুয়ায় গিয়ে অনেকেই স্বর্বশান্ত হচ্ছেন, পারিবারিক কলহ বাড়ছে এসব কথাও সে রিপোর্টে ছিলো। আর সর্বোপরি ছিলো যারা এই জুয়ার নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার কথাও।

ওই রিপোর্টের একটি অনুচ্ছেদ ‘দেশেই চলছে ক্যাসিনো’ সাবহেডে প্রকাশ করা হয়েছিলো। তাতেও বলা হয়েছিলো- এখন আর ইউরোপ, আমেরিকা, সিঙ্গাপুর নয়, ক্যাসিনো জুয়ার আসর বসছে খোদ ঢাকাতেই। নেপালী যে প্রতারক চক্রের খবর এবার জেনে আমরা বেশ বিষ্মিত হলাম, সে কথাও ঠিক এক বছর আগে প্রকাশিত ওই রিপোর্টে উল্লেখ ছিলো।

ঢাকায় কেবল ক্যাসিনোয় গুটি ঠুকেই নয়, অনলাইনে জুয়ার সাইটগুলোতে ব্যাপক হারে জুয়া চলে, সে নিয়ে সারাবাংলা.নেট এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে একটি দীর্ঘ ও সবিস্তার রিপোর্ট প্রকাশ করে। এমদাদুল হক তুহিনের সে রিপোর্টেও উঠে এসেছিলো কারা কোথায় কিভাবে জড়িত। অতএব মিডিয়া যে কিছু করে না, কিংবা করেনি এসব বক্তব্য ধোপে টিকবে না। হ্যাঁ হয়তো প্রত্যাশায় যতটা ছিলো ততটা হয়নি। এখন যখন একের পর এক ক্যাসিনো অভিযান চলছে তখন যতটা গুরুত্বে সকল মিডিয়া একযোগে প্রকাশ ও প্রচার করছে তেমনটা হয়নি। প্রশ্ন হচ্ছে- তেমন কী খুব প্রয়োজনও ছিলো? মিডিয়াতো নিজে গিয়ে এগুলো বন্ধ করবে না। আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর অ্যাকশনের জন্য ওইসব রিপোর্ট যথেষ্ট নয়?

কিন্তু সেটা হয় নি? হয়নি তার কারণ নানাবিধ। যার অন্যতম হচ্ছে এর সঙ্গে রাঘব বোয়াল জড়িত। আরও কারণ- পুলিশ নিজেই এর সঙ্গে জড়িত, যা এখন প্রমাণিত। হ্যাঁ সাংবাদিকরাও ধোয়া তুলশি পাতা তা নয়, তাদেরও কেউ কেউ হয়তো ক্যাসিনোতে গিয়ে পয়সা খোয়ান। কিন্তু যারা লুটেরা, যারা এই ক্যাসিনোকে তাদের অর্থ লুটে নেওয়ার পথ হিসেবে নিয়ে, সে অর্থ বিদেশে পাচার করে দিচ্ছেন তাদের ধরা হয়নি। বিদেশিরা এখানে এসে ক্যাসিনোর ফাঁদ পেতেছে, ক্যাসিনোগুলোয় যেসব জুয়ার বোর্ড বসানো হয়েছে সেগুলোও এসেছে বিদেশ থেকে। কাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব হয়েছে, হচ্ছে তা সকলের অনুধাবনের মধ্যেই।

বিজ্ঞাপন

তার পরেও যখন মিডিয়ার দিকে আঙ্গুল তা হলে বুঝতেই হবে, মিডিয়ার কাছে সাধারণের প্রত্যাশাটি আগের মতোই রয়েছে, কিংবা কোনও কোনও ক্ষেত্রে বেড়েছে। ভালো লাগছে এই ভেবে জনগণ এখনো সংবাদমাধ্যমকে সমাজের চতূর্থ স্তম্ভ হিসেবে দেখতে চায়। ফলে আমাদের দায়িত্ব বুঝি বেড়েছে। তাহলে ক্যাসিনোর এই ঘটনাকে আমাদের শিক্ষা হিসেবে নিতে হবে। নির্বাসন থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা।
সারাবাংলা/

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন