বিজ্ঞাপন

সম্মানিত উপাচার্যদের ভূমিকা এতো বিতর্কিত কেন?

October 9, 2019 | 12:51 pm

রেজানুর রহমান

এতদিন জেনে এসেছি শিক্ষক হলেন পিতার সমান। অথচ বর্তমান সময়ের বাস্তবতায় জানা কথাটিই কেন যেন অজানা ঠেকছে। কারও বাড়িতে যখন কোনো সমস্যা দেখা দেয় তখন সমস্যার সমাধানে বাড়ির প্রধান ব্যক্তি, হয় বাবা না হয় মা সবার আগে সেই সমস্যার সমাধানে তৎপর হন। আমরা স্কুল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলে-মেয়েদেরকে পড়াশুনা করার জন্য পাঠানোর আগেই ভরসা করি প্রতিষ্ঠান প্রধানের ওপর। তিনি হতে পারেন প্রধান শিক্ষক, অধ্যক্ষ অথবা উপাচার্য। তাঁদের ওপর ভরসা করেই তো আমরা ছেলে-মেয়েদেরকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠাই। অথচ তাঁদের কারও কারও ভূমিকা এতটাই রহস্যজনক হয়ে উঠেছে যে, সম্মানিত শিক্ষকদের প্রতি ছাত্র-ছাত্রী এমনকি অভিভাবকদেরও আস্থা কমে যাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

বুয়েটের নিরীহ মেধাবী শিক্ষার্থী আবরারের হত্যাকান্ডের ঘটনা শুধু দেশে নয়, বিভিন্ন দেশেও ব্যাপক আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকৌশল শিক্ষার মতো একটি গুরুত্বপুর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে পড়াশুনা নিয়েই ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যস্ত থাকার কথা সেখানে ঘটে গেল ইতিহাসের নির্দয় ও নিষ্ঠুরতম একটি হত্যাকান্ড। আবরার নামে একজন নিরীহ মেধাবী ছাত্রকে একটি ছাত্র সংগঠনের নেতা কর্মীরা পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। এ ধরনের ঘটনার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক হিসেবে উপাচার্যেরই তো প্রথম এগিয়ে আসার কথা। অথচ অবাক করা বিষয় হলো, আবরার হত্যাকান্ডের দিন বুয়েটের গোটা ক্যাম্পাস জুড়ে বিক্ষুদ্ধ ছাত্র-ছাত্রীদেরকে শান্ত করা তো দূরের কথা আবরারের লাশ দেখতেও আসেননি বুয়েটের ভিসি ড. সাইফুল ইসলাম। এমনকি আবরারের জানাজাতেও শরিক হননি তিনি।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং এ বিষয়ে উষ্মা প্রকাশ করে বলেছেন, ‘উনি কেমন ভিসি? একটা ছাত্র মারা গেল আর এতটা সময় তিনি ক্যাম্পাসের বাইরে ছিলেন?’

এই ঘটনায় একজন সম্মানিত উপাচার্যের দায়িত্ববোধ ও কর্তব্য পরায়নতা নিয়ে জনমনে ব্যাপক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ড. সাইফুল ইসলামের ব্যাপারে অনেকেই ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। বিশিষ্ট নাট্যকার মাসুম রেজা ফেসবুকে তার টাইম লাইনে লিখেছেন, “বুয়েটের ভিসির বুয়েটে থাকার কোনো অধিকার নাই। তার এক সন্তান মারা গেছে, সন্তানের জানাজাতেও তিনি আসেননি। ভীরু, কাপুরুষ, দলবাজ একজন শিক্ষক সকলের অভিভাবক হতে পারেন না। তীব্র ঘৃণা তার প্রতি।”
জনসংযোগ ব্যক্তিত্ব মির্জা তারেকুল কাদের তার টাইম লাইনে লিখেছেন, “বুয়েটের ভিসি ড. সাইফুল ইসলাম, আপনি কেমন ভিসি? আপনি বুয়েটের অভিভাবক, ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবক। ওরা আপনার সন্তানতূল্য। আপনার ছাত্র আবরারকে নির্মম, নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলল আপনার ভার্সিটির ছাত্রলীগের কিছু পাষন্ড। আর আপনি বসে আছেন বাসায়? আপনি দেখি দায়িত্ব জ্ঞানহীন-দয়ামায়াহীন আরেক পাষন্ড। ভিসি পদে থাকার যোগ্যতা আপনার আছে কী?”

বিজ্ঞাপন

বুয়েটের ভিসি ড. সাইফুল ইসলামকে ঘিরে এই ধরনের অভিযোগের ভিত্তি আছে বলে মনে হয়। তারই প্রতিষ্ঠানে একজন নিরীহ ছাত্রকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। অথচ তিনি হতভাগ্য ছাত্রের লাশটিও একবার দেখতে আসেননি। কিন্তু কেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্যের কাছ থেকে এটা আশা করা যায় না।

আবারও শ্রদ্ধার সাথেই বলছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ভিসি শুধু তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়েই নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও একজন গুরুত্বপুর্ণ এবং সম্মানীয় ব্যক্তি। তাঁর বা তাঁদের উচিৎ এই সম্মান ধরে রাখা। অথচ বাস্তব ক্ষেত্রে ঘটছে তার উল্টোটা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরাই সম্মান শ্রদ্ধা অর্জনের চেয়ে নানাভাবে বিতর্কের জন্ম দিচ্ছেন।

কিছুদিন আগে গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির পদত্যাগের দাবীতে সাধারন ছাত্র-ছাত্রীরা ক্যাম্পাসে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। ভিসির পদত্যাগের দাবীতে ছাত্র-ছাত্রীরা ঝাড়ু মিছিল পর্যন্ত বের করে। গোটা ক্যাম্পাস কার্যত অচল হয়ে পড়লেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি সাধারন ছাত্র-ছাত্রীদের দাবীর প্রতি মোটেই কর্নপাত করেননি। বরং তিনি ক্যাম্পাসে তার বাসভবনে বসে আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীদের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে মেতেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জরী কমিশনের একটি প্রতিনিধি দল ক্যাম্পাসে গিয়ে সরেজমিনে ঘটনার তদন্ত শেষে ভিসির অপসারনের ব্যাপারে প্রস্তাব তুললে ভিসি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ততদিনে প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনিক কর্মকান্ড সহ শিক্ষা ব্যবস্থার অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। প্রশ্ন উঠেছে, একজন ভিসিকে ঘিরে সাধারন ছাত্র-ছাত্রীদের এত মারমুখি আন্দোলন হবেই বা কেন? তাঁর মানে তিনি নিশ্চয়ই সাধারন ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা জীবনের ব্যাপারে সঠিক দায়িত্ব পালন করছিলেন না। চূড়ান্ত বিক্ষোভের মুখেও তিনি কেন দায়িত্ব আঁকড়ে ছিলেন?

বিজ্ঞাপন

প্রশ্ন উঠেছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত উপাচার্যের বিরুদ্ধেও। ক্যাম্পাসে ভবন নির্মাণ বাবদ কোটি টাকা চাঁদা দাবী করায় ছাত্রলীগের সাবেক সাধান সম্পাদককে তার পদ হারাতে হয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, ভিসির বাসভবনেই নাকি চাঁদার টাকা ভাগাভাগি হয়েছে। যদি সেটাই সত্যি হয় তাহলে সম্মানিত ভিসিরও তো পদত্যাগ করা উচিত।

আগেই বলেছি, আবারও বলছি একটি পরিবারের ভাবমূতি নির্ভর করে পরিবার প্রধানের ওপর। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ও এক-একটি পরিবার। ভিসি অর্থাৎ উপাচার্য হলেন এই পরিবারের প্রধান। কাজেই পরিবারের প্রধান হিসেবে তার উচিৎ দল মত নির্বিশেষে প্রতিটি ছাত্র ছাত্রীর প্রতি সমান দৃষ্টি দেওয়া। যারা এই কাজটি করছেন না তারা বোধকরি ভুল করছেন। কথায় আছে একটি মিথ্যাকে ঢাকতে হলে অসংখ্য মিথ্যা বলতে হয়। তেমনি একটি ভুল সংশোধনের জন্য আরও অনেক ভুল করার প্রয়োজন পড়ে। আমরা কি এ ধরনের ভুল করতেই থাকব?

রেজানুর রহমান: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/পিএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন