বিজ্ঞাপন

অদম্য মনোবলে হার মেনেছে স্তন ক্যানসার

October 10, 2019 | 10:20 am

তিথি চক্রবর্তী

‘কেউ যদি আমাকে বলে আপনি এখন সুস্থ আছেন তো? আমি তাদের উল্টো প্রশ্ন করি, কবে আমি অসুস্থ হয়েছিলাম?’ বলছিলেন শিক্ষক ও লেখক ইয়াসমীন রাব্বানী। বছর তিনেক আগে স্তন ক্যানসার ধরা পড়ার পর চিকিৎসা শেষে শুধু সুস্থ হয়েছেন তাই নয়, বিপুল উদ্যমে ফিরে এসেছেন কর্মযজ্ঞে।

বিজ্ঞাপন

মজা করে বলছিলেন, ‘ক্যানসারকে মেহমানের মতোই ভেবেছি। বাসায় মেহমান এলে যেমন আপ্যায়ন করে বিদায় দেই, সেভাবে ক্যানসারও আমার কাছে বেড়াতে এসেছিল, অ্যাপায়ন করে বিদায় জানিয়েছি।’

স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েও তিনি একদিনের জন্যও হারাননি তীব্র মনোবল। মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন, কিন্তু অত্যন্ত নির্লিপ্তভাবে। স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত নারীদের জন্য তিনি একজন অনন্য প্রেরণা।

বিজ্ঞাপন

বাসাবো বৌদ্ধ মন্দিরের কাছেই ক্রিসেনথিমাম স্কুলের প্রধান শিক্ষক ইয়াসমীন রাব্বানী। তিন বছর আগে স্তন ক্যানসার আক্রান্ত হলেও নিজের হাতে গড়া এই স্কুল, লেখালিখিতে কাটাচ্ছেন ব্যস্ত সময়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করার পর পাড়ার কিছু বাচ্চাদের পড়াতে শুরু করেন। তখনই স্কুল করার ভাবনা মাথায় আসে। নিজের প্রতিষ্ঠান গড়ার স্বপ্ন পূরণের কারিগর তিনি হলেও, পেয়েছিলেন বাবার পূর্ণ সহযোগীতা।

তিন সন্তানের মা ইয়াসমীন বলেন, সবকিছু ভালোই চলছিল। কিন্তু ২০১৬ সালের শেষ দিকে হঠাৎ একদিন তার স্তনে অন্যরকম একটা কিছুর উপস্থিতি বুঝতে পারেন। চিকিৎসকের কাছে গেলেন। বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানলেন তার স্তনে খুব ছোট কিছু একটা আছে যা অপারেশন করতে হবে। আরও ভালো চিকিৎসার জন্য কলকাতা গেলেন। চিকিৎসক জানান ক্যানসার না, একটি সিস্ট হয়েছে। সিস্ট অপারেশন শেষে বাড়ি ফেরার পালা।

ইয়াসমীন রাব্বানী

বিজ্ঞাপন

কিন্তু তখনই পাল্টে যায় পরিস্থিতি। অপারেশনের জায়গা ড্রেসিং করার সময় অনেকটা পুঁজ বের হয়। দেখে চিকিৎসকও ঘাবড়ে যান। এরপর প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করে জানা গেল, তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত। চিকিৎসক কেমো থেরাপি নেওয়ার পরামর্শ দেন। দেশে ফিরে শুরু করেন কেমো দেওয়া।

ইয়াসমীন বলেন, পরিবারের সব সদস্য বিশেষত, তার ছেলের যত্নের কারণেই তিনি এই কঠিন পরিস্থিতি সামলে নিতে পেরেছেন। ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধে এক মূহুর্তের জন্যও ভেঙ্গে পড়ার ফুসরত পাননি। কোমো থেরাপির শারীরিক কষ্ট ভয়ংকর। কিন্তু সেই কষ্টও জয় করেছেন দৃঢ় মনোবলে।

নিজেকে অসুস্থ ভেবে গৃহবন্দী করে রাখেননি। চেষ্টা করেছেন কাজের মধ্যে ডুবে রোগশোক ভুলে থাকতে। থেরাপি নেওয়ার পর একটু সুস্থ বোধ করলেই তাই ছুটে যেতেন স্কুলে। মাঝেমধ্যে ক্লাসও নিতেন। স্কুলের সমস্ত কাজের খোঁজ-খবর রাখতেন নিয়মিত। কেমো দিলে অস্বাভাবিক হারে চুল ঝরা স্বাভাবিক ঘটনা। মাথার সব চুল ঝরে যাওয়ার আগেই চুল কেটে ফেলেন তিনি। তাকে দেখলে অন্যরা যেন বিব্রত না হয়, এজন্য তখন মাথায় স্কার্ফ পরে স্কুলে যেতেন।

স্কুলের পর সময় কাটে কীভাবে জানতে চাইলে ইয়াসমীন বলেন, কোন কোন বিকেলে আত্মীয়-স্বজন অথবা বন্ধুদের বাসায় বেড়াতে যান। তবে, সুযোগ পেলেই লেখালেখি করেন। মূলত শিশুদের জন্য গল্প, কবিতা লেখেন। লেখালেখি চলে, বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত। তিনি বলেন, ‘আলাদা করে সময়কে বন্দী করতে হয় না, বরং সময় আমাকে বন্দী করে ফেলে।’

বিজ্ঞাপন

অসুস্থতার দিনগুলোতেও লেখালেখি চালিয়ে গেছেন। কষ্ট ভোলার জন্য স্কুলে গেছেন বাচ্চাদের দেখতে। ইয়াসমীন বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, আমার কষ্টের ভার কাউকে দিতে পারবো না। আমাকে দেখে কেউ বুঝতো না, কতটা অসুস্থ আমি।’ তিনি বলেন, সেই সময় কখনো সন্ধ্যার পরে মায়ের বাড়িতে যেতেন। মা, ভাই, বোনদের সঙ্গে গল্প করতেন। বাসায় ফিরে চলতো লেখালেখি। তখন তার একটি বই বের হয় ‘অন্দরমহল ও আমার ক্যান্সার’ নামে। ইয়াসমীন জানান, বই বিক্রির সব টাকা ক্যানসার আক্রান্ত রোগীদের বিতরণ করেছেন।

ইয়াসমীন রাব্বানী

ছোটবেলা থেকেই ইয়াসমীন ছিলেন ভীষণ সাহসী। পুতুল কিংবা হাড়িপাতিল নিয়ে খেলেননি কখনও। সমাজে যা ছেলেদের খেলাধূলা হিসেবে বিবেচিত সেগুলোতেই আগ্রহ ছিলো তার। বাজার করা থেকে শুরু করে সাইকেল চালানো, দৌড়ঝাঁপ কি সাঁতার কাটা- করেন নি এমন কোন কাজ নাই।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যে নারীরা স্তন ক্যানসারের মতো রোগে আক্রান্ত হন, অনেক সময় পরিবার ও সমাজ এই নারীদের অত্যন্ত অসম্মানের চোখে দেখে। এমনকি জীবনসঙ্গীও মেনে নিতে না পেরে স্ত্রীর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন এবং বিয়ে বিচ্ছেদের কথা ভাবেন। এই প্রসঙ্গে ইয়াসমীন রাব্বানী বলেন, ‘এই সমাজ আমরাই তৈরি করেছি। এর কর্ণধার হলো পুরুষ।’ তিনি বলেন, ‘একজন পুরুষ টাকা উপার্জন করে আর দশজন মিলে তা ভোগ করে। একজন ব্যক্তির উপর এতগুলো মানুষের নির্ভরশীলতার কারণে একজন পুরুষের ভেতরেও কিছুটা দমনমূলক আচরণ তৈরি হয়, যা স্বাভাবিক না। ছেলেমেয়েরাও ছোট থেকে দেখে বাবাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। তাই তারাও এটা শিখেই বড় হয়। এভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এই দমনমূলক আচরণ পরিবার থেকে সমাজে ছড়িয়ে পড়ে।

ইয়াসমীন রাব্বানী

তিনি বলেন, ‘স্তন ক্যানসার, জরায়ুর রোগসহ নানারকম ‘মেয়েলি রোগে’ আক্রান্ত হলে নারীরা দিকশূন্য হয়ে যান। তারা চিন্তা করতে থাকেন সংসার টিকবে কিনা, স্বামী বিপথগামী হবেন কিনা এসব নিয়ে। অনেক নারীর মনেই তখন বিশাল এক শূন্যতা সৃষ্টি হয়।’ স্তন ক্যনসার নারী ও পুরুষ উভয়ের হলেও নারীরাই বেশি আক্রান্ত হন। তাই আমাদের মতো পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে যার বেশিভাগ শিকার নারীরাই।

নারীরা যাতে নিজেদের শরীর ও রোগ নিয়ে হীনমন্যতায় না ভোগে তার জন্য পুরুষদের এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন ইয়াসমীন। তিনি বলেন, ‘আজ যদি স্বামীর এই অবস্থা হতো, আমি তাকে ফেলে যেতে পারতাম না। অনেক মেয়েই এভাবে ভাবে। আমার স্বামী আমাকে সহযোগিতা করলেও অনেকের জীবনেই এমনটা ঘটে না।’ তিনি বলেন, ‘এমন অনেক স্বামীর কথা আমি জানি, যারা তাদের স্ত্রীকে শারীরিক, মানসিক বা অর্থনৈতিকভাবে নির্যাতন করেন।’ এসব থেকে মুক্তির জন্য তিনি মনে করেন, ‘নারীদের সচেতন হতে হবে। নিজের দায়িত্ব নিজে নেওয়ার মতো সক্ষম হতে হবে।‘

ইয়াসমিন বলেন, অনেক পুরুষ মনে করেন, অসুস্থ স্ত্রী তার দয়ার ওপর নির্ভরশীল। এই ধরনের মনোভাব যাদের নাই, তারাই সত্যিকারের শিক্ষিত। এই শিক্ষা কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেটে মেলে না, পারিবারিকভাবে বা নিজেকে আলোকিত করার মাধ্যমেই সম্ভব সত্যিকারের এই শিক্ষা লাভ। সমাজের নারীদের দুর্দশা দূর করতে এই সত্যিকারের শিক্ষার বিকল্প নাই বলেই মনে করেন ক্যানসারকে হারিয়ে দেওয়া এই শিক্ষক ও সংগঠক।

প্রকৃতির সান্নিধ্য খুব পছন্দ তার। প্রকৃতির কাছে গেলে সব ভুলে শিশুর মতো হয়ে যান। পাহাড় আর সমুদ্র তাকে ভীষণভাবে টানে। সময় পেলেই ঘুরতে যান। পরিবারের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করে সীমাহীন আনন্দ পান, জানান ইয়াসমীন।

ইয়াসমীন রাব্বানী

বয়স কিংবা মরনব্যাধি কাবু করতে পারেনি একজন ইয়াসমীন রাব্বানীকে। বয়স কেবল একটি সংখ্যা তার কাছে। ক্যানসার আক্রান্ত রোগীদের ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে দেখা উচিৎ বলেই মনে করেন তিনি। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কেমো থেরাপি দেওয়ার সময় ক্যানসার আক্রান্ত রোগীদের মাথার চুল ঝরে যায়। এতে চেহারা যতই বেমানান লাগুক, তাদের সামনে এমন ভঙ্গি প্রকাশ করা যাবে না, যাতে তারা কষ্ট পায়। ভয় পেয়ে যায়। বরং তাদের সামনে ইতিবাচক কথাগুলো তুলে ধরতে হবে।’

একইভাবে যারা ক্যানসার আক্রান্ত হন তাদেরও ভয় না পেয়ে সাহসের সঙ্গে মোকাবেলা করা উচিৎ, বলেন তিনি। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা শুরু করলে তার মতো সুস্থ হওয়া সম্ভব। তিনি মনে করেন মানসিক শক্তি মানুষকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যায়। তাই মনের জোর থাকলে স্তন ক্যানসার, কী কোনকিছুই সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথে কোন বাঁধা নয়।

সারাবাংলা/টিসি/আরএফ

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন