বিজ্ঞাপন

নৈরাজ্যের সড়কে ফেরেনি শৃঙ্খলা, বাস্তবায়ন নেই নির্দেশনার

October 22, 2019 | 8:52 am

সাদ্দাম হোসাইন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বেশ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী নিজেও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে পাঁচটি নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কিন্তু বছর পেরিয়ে গেলেও নেই সেসব নির্দেশনার দৃশ্যমান বাস্তবায়ন। ফলে এখনও নৈরাজ্যের সড়কে ফেরেনি শৃঙ্খলা। এতে প্রতিনিয়ত অনিয়মের সড়কে ঝরছে প্রাণ, বরণ করতে হচ্ছে পঙ্গুত্বকে। নিঃস্ব হচ্ছে পরিবার।

বিজ্ঞাপন

বিভিন্ন সংস্থার তথ্য মতে, দেশে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান গড়ে ৭ হাজারের বেশি মানুষ। আর এতে আহত হয়ে পঙ্গু হয়ে যায় প্রায় ১৭ হাজারের মতো মানুষ। আর এসব দুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, অতিরিক্ত গতি এবং অদক্ষ চালক ও সড়কের অব্যবস্থাপনা। কিন্তু এসব নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা উদাসীন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাই নৈরাজ্যের সড়কে শৃঙ্খলা এখনো বহুদূর বলে মনে করেন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত এবং আহতদের পরিবার।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য বলছে, ২০১৫ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত চার বছরে সারাদেশে ২১ হাজার ৩৮৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ২৯ হাজার ৩১৫ জন। আর এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে ৬৯ হাজার ৪২৮ জন। শুধু ২০১৫ সালে ৬ হাজার ৫৮১টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৮ হাজার ৬৪২ জন। আর আহত হয়েছে ২১ হাজার ৮৫৫ জন। ২০১৬ সালে ৪ হাজার ৩১২টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৬ হাজার ৫৫ জন। আহত হয়েছে ১৫ হাজার ৯১৪ জন। ২০১৭ সালে ৪ হাজার ৯৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৭ হাজার ৩৯৭জন। আহত ১৬ হাজার ১৯৩ জন। আর ২০১৮ সালে ৫ হাজার ৫১৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৭ হাজার ২২১ জন এবং আহত ১৫ হাজার ৪৬৬ জন।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউশনের (এআরআই) তথ্য বলছে, শুধু চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সারাদেশে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩ হাজার ৩৪৬টি। আর এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩ হাজার ৭১৫ জন। আহত হয়েছেন ৬ হাজার ৯০ জন। শুধু রাজধানীতেই চলতি বছরে ২১৫টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ২২৭ জন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৮ সালের ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই সড়কে নৈরাজ্য বন্ধে ঐদিন মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে আলোচনা করেন। আলোচনার এক পর্যায়ে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে তিনি পাঁচটি নির্দেশনাও দেন। নির্দেশনাগুলো হলো- টানা পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাড়ি না চালাতে দূরপাল্লার যানবাহনে বিকল্প চালক রাখা, চালকদের জন্য বিশ্রামাগার করা গাড়ির চালক ও তার সহকারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া, সিগন্যাল মেনে পথচারীদের জেব্রা ক্রসিং ছাড়া অবৈধভাবে রাস্তা পারাপার বন্ধ করা এবং চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধা নিশ্চিত করা।

নিরাপদ সড়ক দিবস: সড়কে দুর্ঘটনা কাঙ্ক্ষিত হারে কমিয়ে আনার প্রত্যয়

এরপর গতবছরের ২৯ জুলাই বাসচাপায় রমিজ উদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনের তোপে পড়ে ১৬ আগস্ট আরও ১৭টি নির্দেশনা আসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। সেগুলোর বাস্তবায়নেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।

বিজ্ঞাপন

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ১৭টি নির্দেশনা ছিল-
১. গণপরিবহন চলাকালে সবসময় দরজা বন্ধ রাখা এবং বাস স্টপেজ ছাড়া যাত্রী ওঠা-নামা সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা।
২. গণপরিবহনে দৃশ্যমান দুটি স্থানে চালক ও হেলপারের ছবিসহ নাম, চালকের লাইসেন্স নম্বর, মোবাইল নম্বর প্রদর্শন নিশ্চিত করা।
৩. সব মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীকে বাধ্যতামূলক হেলমেট পরিধান এবং সিগন্যালসহ ট্রাফিক আইন মানতে বাধ্য করা।
৪. সব পরিবহনে (বিশেষত দূরপাল্লার বাসে) চালক এবং যাত্রীর সিটবেল্ট ব্যবহারের নির্দেশনা দেওয়া এবং পরিবহন মালিকদের সিটবেল্ট সংযোজনের নির্দেশনা দেওয়া এবং আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।
৫. যেসব স্থানে ফুটওভার ব্রিজ বা আন্ডারপাস রয়েছে সেসব স্থানের উভয় পাশে ১০০ মিটারের মধ্যে রাস্তা পারাপার সম্পূর্ণ বন্ধ করা।
৬. ফুটওভার ব্রিজ বা আন্ডারপাসসমূহে প্রয়োজনীয় পরিচ্ছন্নতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
৭. ফুটপাত হকারমুক্ত রাখা, অবৈধ পার্কিং এবং স্থাপনা উচ্ছেদ করা।
৮. ট্রাফিক সপ্তাহে চলমান সব কার্যক্রম পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত যথাসম্ভব অব্যাহত রাখা।
৯. আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮ এর মধ্যে স্বয়ংক্রিয় বৈদ্যুতিক সিগন্যাল ব্যবস্থা চালু করার বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দেওয়া।
১০. ঢাকা শহরে রিমোট কন্ট্রোলড অটোমেটিক বৈদ্যুতিক সিগন্যালিং পদ্ধতি চালুর নির্দেশ।
১১. ৩০ অক্টোবর ২০১৮ এর মধ্যে ঢাকা শহরের সব সড়কের রোড ডিভাইডারের উচ্চতা বৃদ্ধি করে বা স্থানের ব্যবস্থাপনা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ।
১২. মহাখালী ফ্লাইওভারের পর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত ন্যূনতম দুটি স্থানে স্থায়ী মোবাইল কোর্ট পরিচালনা এবং নিয়মিত দৈব চয়নের ভিত্তিতে যানবাহনের ফিটনেস ও ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা করা।
১৩. ঢাকা শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি বা আরম্ভ হওয়ার সময় জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থী, স্কাউট এবং বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোরের (বিএনসিসি) সহযোগিতা নিয়ে শিক্ষার্থীদের রাস্তা পারাপারের উদ্যোগ নিতে হবে।
১৪. অবৈধ পরিবহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং ফিটনেস দেওয়ার প্রক্রিয়ায় অবশ্যই পরিবহন দেখে ব্যবস্থা নিতে হবে।
১৫. রুট পারমিট/ফিটনেসবিহীন যানবাহন দ্রুত ধ্বংস করার সম্ভাব্যতা যাচাই করতে হবে।
১৬. লাইসেন্স দেয়ার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ‘লারনার’ দেওয়ার প্রাক্কালে ড্রাইভিং টেস্ট নেওয়া যেতে পারে এবং উত্তীর্ণদের দ্রুততম সময়ে লাইসেন্স দেওয়ার নির্দেশ।
১৭. কর্মকর্তা-কর্মচারীর ঘাটতি থাকলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ঘাটতি পূরণের ব্যবস্থা নেওয়া।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘এতো আন্দোলন, সভা-সমাবেশ করেও যখন সড়কে নৈরাজ্য বন্ধ হচ্ছিল না। তখনই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা দেওয়ার খবর শুনে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিলাম। কিন্তু দুঃখের কথা হলো প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয়নি এখনও। প্রথমে তিনি যে পাঁচটি নির্দেশনা দিয়েছিলেন তার মাত্র দুইটি নির্দেশনা চালক প্রশিক্ষণ এবং বিশ্রামাগার তৈরির নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য চলমান রয়েছে কার্যক্রম। যা এখনও শেষ হয়নি। হতাশা বাকি যে তিনটি নির্দেশনা রয়েছে সেগুলো একটু সদিচ্ছা থাকলেই বাস্তবায়ন সম্ভব।’

বুয়েটের এআরআই’র পরিচালক ড. মিজানুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর কিছুদিন সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামলেও এখন আবারও সেই পুরোনো অবস্থা। নিয়মের তোয়াক্কা করছে না কেউই। জেব্রা ক্রসিং থাকলে সেখানে যেনো গাড়ির গতি আরও বেড়ে যায়। যাত্রী উঠানো-নামানোর চিত্র তো আরও ভয়ংকর। আর দুই বাসের প্রতিযোগিতা দেখলে আতঙ্ক ছড়ায় যাত্রীদের মাঝেই। এসবের জন্য পরিবহনের মালিকরাই দায়ী। তারাই চালকদের বাধ্য করে এসব পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে।’

বিজ্ঞাপন

তিনি আরও বলেন, ‘এই নৈরাজ্য বন্ধে মালিকদের নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। আর এজন্য সরকারের শক্ত অবস্থান থাকা দরকার পরিবহন মালিকদের বিরুদ্ধে। মালিকরা যতই শক্তিশালী হোক রাষ্ট্র বা সরকার এর থেকে তো তারা ততো বেশি শক্তিশালী না। তাহলে তাদের কেন নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। আমার মনে হয় গভমেন্টের একটা স্ট্রং স্টেটমেন্ট থাকা দরকার। এই যে পরিবহনের নৈরাজ্য এটা নিয়ে মানুষের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। এমনকি এর কারণে সরকারের অনেক সাফল্য ম্লান হচ্ছে। এটা সরকারের বোঝা উচিত এবং একটা কঠোর অবস্থানে গিয়ে উদ্যোগ যেন বাস্তবায়ন করা যায় সেই কাজ করা উচিত সরকারের‌।‍‍‌’

গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে এসব নির্দেশনা বাস্তবায়ন হলে অনেকের আর্থিক বাণিজ্য সুবিধা কমে যাবে। আবার দেখা যাচ্ছে যে, নির্দেশনাগুলোর মধ্যে যেগুলোতে আর্থিক বাণিজ্য সুবিধা রয়েছে কিংবা প্রকল্প নির্ভর নির্দেশনা সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য কাজ চলছে। কিন্তু যেগুলোতে টাকা লাগবে না শুধুমাত্র প্রয়োজন সদিচ্ছা এবং জবাবদিহিতা সেগুলোতে কারো নজর নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘এমন বেহাল অবস্থার মূল কারণ সরকারের কঠোর অবস্থান না থাকা। সরকার প্রধান যদি জবাবদিহি নিশ্চিত করতেন যে, নির্দেশনা কেন বাস্তবায়ন হয়নি। তাহলে যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তারাও সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করত। কিন্তু সরকার প্রধানও জবাবদিহিতা চাচ্ছেন না। তাই যাদের কাজের দায়িত্ব দিয়েছেন তারাও জবাবদিহির মধ্যে নেই। কারণ তারাও জানে কেউ কিছু বলবে না। নির্দেশনা কেন বাস্তবায়ন হয়নি সে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। তবেই নির্দেশনা আলোর মুখ দেখবে।’

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার বাস্তবায়নের বিষয়ে জানতে মুখ্য সচিব মো. মুজিবুর রহমানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও মন্তব্য পাওয়া যায়নি। বিষয় উল্লেখ করে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি।

সারাবাংলা/এসএইচ/এমও

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন