বিজ্ঞাপন

স্মরণ: হুমায়ুন সাধু, ‘বড়’দের পৃথিবী ছেড়ে ‘ঊনমানুষ’র মুক্তি

October 25, 2019 | 1:31 pm

রাজীব নন্দী

‘যারা স্বপ্ন দেখে না, তারা স্বপ্ন দেখার লোকগুলোকে সরিয়ে দিতে চায়’- বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের বিখ্যাত সিনেমা ‘উত্তরা’য় বামন রেলগার্ডের সংলাপ এটি। স্বপ্নহীন এই পৃথিবীতে একে একে স্বপ্নবাজদের স্বেচ্ছা-বিদায়ক্ষণে বা অপঘাতে বিদায় নেয়ার সময়ে তীব্র হাহাকার জেগে উঠলো আরো একটি খবরে- ‘অবশেষে না ফেরার দেশে চলে গেলেন নির্মাতা ও অভিনেতা হুমায়ুন সাধু’!

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের সমকালীন চলচ্চিত্র পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ভিডিওকাজগুলোয় উনার প্রায় সব অ্যাসিস্ট্যান্টকে দিয়ে অভিনয় করিয়েছেন। ফারুকীর টিভি ফিকশন কিংবা সিনেমায় সকলের অংশ নেয়ার মধ্যে যুথবদ্ধতার একটি ব্যাপার ফুটে উঠতো। সবমিলিয়ে একটা ‘ভাই-ব্রাদার’ কালচার! ভাই-ব্রাদারদের হাতে নির্মিত ‘ঊন-মানুষ’ টেলিছবিতে অভিনয় করেছিলেন হুমায়ূন সাধু। তীব্র আঘাত আর অন্তক্ষরা ছিলো সেই অভিনয়। সমাজের পদে-পদে একজন বামন মানুষকে হেয় করা, তাঁকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা-তিরস্কার। এমন বৈরিতার সমাজে টিকে থাকার অদম্য সেলুলয়েড গল্প ঊন-মানুষ। বলা বাহুল্য, এই অভিনয় ছিলো তাঁর অন্তর্জাত। সেই অভিনয় ছিলো তাঁর অব্যক্ত বোবাকান্নার স্যালুলয়েড যন্ত্রণা। সেই অভিনয় ছিলো তাঁর হাহাকারের প্রতিধ্বনি।

চারপাশে ‘বড়’দের পৃথিবীতে এক কঠিন বাস্তবতা, আশা, আকাঙ্ক্ষা নিয়েই হুমায়ুন সাধু বেঁচেছিলেন। সেসব অভিজ্ঞতা নিয়েই গল্প লিখেছেন হুমায়ূন সাধু নিজে। পরে চিত্রনাট্য ও পরিচালনা করেছেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। ফারুকীর চলচ্চিত্রের ভাষা নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা। সেসব এক পাশে সরিয়ে আজ শুধু হুমায়ুন সাধুকে স্মরণ করার দিন। চট্টগ্রামের সন্তান এই হুমায়ুন ২০০১ সালে ঢাকায় চলে যান, অন্য দশ জনের মতো, ভাগ্যের অন্বেষণে। ফারুকীর ছবিয়াল পরিবার বা ভাই-ব্রাদার তাঁকে নতুন জীবন দেয়। সেই ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয়। তারপর বামন মানুষটি একে একে অসংখ্য নাটক, টেলিছবি, চলচ্চিত্র ও বিজ্ঞাপনচিত্রে অভিনয় করেছেন। দক্ষতার ব্যাপার এই যে, একটি চলচ্চিত্র টিমে কাজ করে তিনি কাহিনি ও চিত্রনাট্য লেখার পাশাপাশি নাটক পরিচালনাও করেছেন। ফেসবুকের বিখ্যাত ‘ট্রোল’ হিসেবে ‘চিকন পিনের চার্জার’ নামে একটি ঊন-সংলাপ দেখা যায়। নাট্য পরিচালক হিসেবে তার অভিনীত ও পরিচালিত নাটক চিকন পিনের চার্জার বেশ আলোচিত হয়েছে এই দেশে।

হুমায়ুন সাধুর সাথে প্রথম সাক্ষাত হয় চট্টগ্রামের জামালখানের বিখ্যাত শিকদার হোটেলের সামনে এক আড্ডায়। পথচারীদের দৃষ্টি থমকে দিয়ে মাথা নত করে দিতে পারতেন তিনি। চলতিপথে তাঁকে যেন আরো একবার ঘুরে দেখতেই হবে। কিন্তু তুলনামূলক বড়দের বা লম্বাদের দিকে তিনি মাথা উঁচু করে তাকালেও, সবাই তাঁর দিকে তাকাতো তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে। সমাজের সবাইকে গড়ে পাঁচ ফিট হতে হবে- এমন গড় ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন তিনি, সেই ছোটবেলা থেকেই। দ্বিতীয় শ্রেণিতে ১৩০ জন ছেলে-মেয়েকে পেছনে ফেলে প্রথম স্থান অধিকার করে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন হুমায়ুন সাধু।

বিজ্ঞাপন

আমাদের চট্টগ্রামের জামালখানের হুমায়ুন সাধু থেকে চোখ ফেরাই পুরানের দিকে। ত্রেতাযুগে আবির্ভুত বিষ্ণুর প্রথম অবতারের নাম বামন। পুরাণের ভাষ্যমতে, অসহিষ্ণু দৈত্যরাজ বলিকে দমন করা যাচ্ছিলো না কোনভাবেই। অগত্যা, বিষ্ণু এই ধরাধামে বামনরূপে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। পুরাণে যার নাম বামনাবতার। দৈত্যের হাত থেকে জগৎ উদ্ধারে দেবতাদের ব্যর্থতার পাশাপাশি ভগবানের শিক্ষা এই যে, ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত ‘বামন’। সাইজ ডাজন্ট ম্যাটার!

এই বামন অবতারের মতো আমি এক অভিনব জাদুকর প্রেমিকের খোঁজ পেয়েছিলাম। এমন এক বিচিত্র প্রেমিক সে, যে প্রেমিকার জন্য দুনিয়া জয় করতে ছিলো দ্বিধাহীন, সাহসী কিন্তু বোকা। বলাবাহুল্য, প্রেমের উতল হাওয়া যদি প্রেমিককে একই সঙ্গে যুদ্ধজয়ী, সাহসী আর বোকা করতে না পারে, সে আর কেমন বুনো-প্রেম? অন্য সকলের মতো সেই প্রেমিকের জীবনে একদিন ঘোরলাগা এক বসন্ত এসেছিলো। একদিন দেখি, প্রেয়সীর ভ্রু-পল্লবের ইশারায় বনশ্রীর সবুজল্লবিত চন্দনের বনে গিয়ে হাজির প্রেমিক। প্রেমিকার সামনে হাঁটু মুড়ে অভিনব ভঙ্গিতে প্রেম নিবেদন করছে যুবক। প্রেমিকার মনে বিদ্যুৎ খেলে গেল। যুগপৎ কৌতুহল এবং আশঙ্কার হাই ভোল্টেজ ছড়িয়ে গেলো শরীর আর মনজুড়ে। কারণ, জটিল প্রেমের সমীকরণে তখন প্রেমিকার একপায়ে শিকল, অন্যপায়ে কৌতুহল। তবুও প্রেমিকা তার সৎ প্রেমিকের প্রেমনিবেদনের উত্তরে বলেছে- ‘আমার ইচ্ছে করছে, আকাশে উড়ি। তুমি আমারই সত্ত্বা। তোমার কাছে আমার আলাদা করে কিছু চাওয়ার নেই। এমন অভিনব সুদর্শন যুবক তুমি, যার আছে আকাশসম হৃদয়; আমার মতো অবলা নারীর আর কী দরকার বলো?’ হ্যাঁ, প্রেয়সীর সামনে নতজানু বামন হয়ে প্রেম নিবেদনের এমন অভিনব পদ্ধতিকে অগ্রাহ্য করতে পারেনি প্রেমিকা। কৌতুহল আর আশঙ্কা মেশানো প্রেমিকার মন উষ্ণ আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়। আমি চোখ ফিরিয়ে ঘন বনের দিকে তাকাই। দূর থেকে সবুজ বন দেখে ভাবতে থাকি, উঁচু ইমারতের সামনে এভাবেই কি নতমুখি হয়ে বিশাল কিছু জয় করতে হয়? এটাই কি বামনের নতজানু যুদ্ধনীতি?

চলুন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের বিখ্যাত সিনেমা ‘উত্তরা’য় ফিরে যাই। সিনেমার প্লট রাঢ় বাংলার বিহার অঞ্চলে। নিরালা-নির্জন রেলস্টেশন লাগোয়া একটি গির্জায় আর কয়েকজন মানুষকে ঘিরে ঘটে নানা ঘটনা। সেই সিনেমায় বামন সম্প্রদায়কে প্রতীকরূপে সাম্যবাদী পৃথিবীর দর্শন তুলে ধরেছেন বুদ্ধদেব। ‘উত্তরা’ সিনেমায় বামন রেলগার্ডের সংলাপটি এরকম–
বামন গার্ড: ‘লম্বা মানুষ তো দেখলে এতকাল। কিছু করতে পারল তারা? পৃথিবীটা বদলাল? খালি যুদ্ধ, যুদ্ধ আর যুদ্ধ। জানো, আমাদের গ্রামে আমরা একটা স্বপ্ন দেখি।
উত্তরা: কী স্বপ্ন?
বামন গার্ড: দেখি আশপাশে সব আমাদের মতো বামনে ভরে গেছে। তারাই চালাচ্ছে সব। মানুষ ভালো আছে।’

বিজ্ঞাপন

কিন্তু প্রশ্ন, লম্বা লম্বা মানুষদের জটিল এই বিশ্বব্যবস্থায় বামনরা কি পারবে নতুন একটি পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতে? কারণ, স্বার্থের দুনিয়ায় প্রেমের ঘাটের মাঝি হয়েও নিরুপায় প্রেম ভিক্ষা করতে করতে প্রেয়সীর মুখ থেকে শুনতে হয়- ‘বামন হইয়া চাঁদের পানে হাত বাড়াইয়ো না, মাঝি গো, ও আমি ফুলের বালা ফুলে, আমার দিকে নজর দিয়ো না’। অথচ কী অদ্ভুত বৈপরীত্য দেখুন- প্রেম নিবেদনে কিন্তু হাঁটু মুড়ে নতজানু বামন-ই হতে হয়!

অবাক হতে হয়, আমাদের এই ’বড়’দের গরিমার দেশে একজন খর্বাকৃতি ‘ঊনমানুষ’ হুমায়ুন সাধু কী ভাবে লম্বা লম্বা পায়ের প্রতিযোগীদের সঙ্গে পাল্লা টেনেছিলেন? সে ছিল শরীরের দৌড় নয়, মনের দৌড়। যে দৌড়ে বরাবর অক্লান্ত ছিলেন তিনি। বিদায় ঊন-মানুষ! ‘বড়’দের পৃথিবীতে আর কেউ নিচুচোখে তাকাবে না তঁকে!


লেখক:
রাজীব নন্দী
সহকারী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এমএম

বিজ্ঞাপন

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন