বিজ্ঞাপন

ভুয়া বিলে টাকা নেন হ্যানয়ের রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজ

October 30, 2019 | 5:22 pm

এমএকে জিলানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ভৌতিক কর্মকাণ্ড ঘটছে ভিয়েতনামের বাংলাদেশ দূতাবাসে। সেখানে ভুয়া ভাউচার দিয়ে সরকারি অর্থ তোলা, নিয়ম না মেনে নিয়োগ, কারসাজি করে মেডিকেল বিল হাতিয়ে নেওয়া, মালি-ক্লিনার-কেয়ারটেকার-গাড়ি-পেট্রলসহ নানা খাত থেকে অনিয়ম ও অনৈতিকভাবে অর্থ তুলে নেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। আর এসব অনিয়ম ও অনৈতিক কাজের নেতৃত্ব দিচ্ছেন রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজ নিজেই। তিনি নিজেই ভুয়া ভাউচার দিয়ে টাকা নেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজের এমন অনিয়ম ও অনৈতিক কাজ-কারবার সম্পর্কে বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) নিরীক্ষা প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে, ‘ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে অর্থ গ্রহণ; এখানে টাকার অঙ্কের চেয়ে নীতির প্রশ্ন জড়িত। যিনি রাষ্ট্রদূত হয়ে দেশকে রিপ্রেজেন্ট করছেন তিনিই এসব করলে কিভাবে দেশ এগিয়ে যাবে?’

হ্যানয়ের বাংলাদেশ দূতাবাসের ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত সময়ের আর্থিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে। সিএজি কার্যালয়ের করা নিরীক্ষা প্রতিবেদনসহ সংশ্লিষ্ট সব তথ্য-প্রমাণ সারাবাংলার হাতে রয়েছে।

সারাবাংলার অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ৭ জুন রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজ ক্ষমতার অপব্যবহার করে যোগ্য প্রার্থীকে বাদ দিয়ে মিশনের স্থানীয়ভিত্তিক রিসিপসনিস্ট পদের কর্মচারি হিসেবে মোহাম্মদ মঈন উদ্দিনকে নিয়োগ দেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২০১৮ সালের ২৩ অক্টোবরের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ‘বিদেশের বাংলাদেশ মিশনে স্থানীয়ভিত্তিক পদের বিপরীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়/মিশনে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারিদের আত্মীয় বা পূর্ব পরিচিত ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। এছাড়া বাংলাদেশি কোনো ব্যক্তিকে নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা থাকলে তার ওই দেশে কাজ করার বৈধ ওয়ার্ক পারমিট থাকতে হবে।’

বিজ্ঞাপন

নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ভিয়েতনামের একটি পত্রিকায় মিশনের জন্য রিসিপসনিস্ট পদের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। বিজ্ঞাপন প্রকাশের তারিখে মোহাম্মদ মঈন উদ্দিন মুম্বাই ডেপুটি হাইকমিশনে কর্মরত ছিল। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং ভিয়েতনামে কাজ করার ওয়ার্ক পারমিট না থাকলেও রাষ্ট্রদূতের পূর্ব পরিচিত হওয়ায় তাকে সেখানে নিয়োগ দেওয়া হয়।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজ ও মোহাম্মদ মঈন উদ্দিন এর আগে মুম্বাই ডেপুটি হাইকমিশনে একসাথে কাজ করেছেন। সামিনা নাজ মুম্বাই মিশনে যত অনিয়ম করেছেন তার সঙ্গে মঈন উদ্দিনের যোগসূত্র ছিল। মুম্বাইয়ের মত অনিয়ম চালিয়ে যেতেই তিনি ভিয়েতনামে মঈন উদ্দিনকে নিয়োগ দিয়েছেন।

নিরীক্ষা প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ থেকে ১৮ মে আসেম সম্মেলনের সময় সামিনা নাজ মিশনের কর্মচারি মো. আকমল উদ্দিনকে অনৈতিকভাবে সফরসঙ্গী করেন। ওই সময়ে মিশনে জনবল স্বল্পতা ছিল। এই ঘটনায় সরকারের ৭৩ হাজার ৪৫৮ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। এছাড়া অর্থনৈতিক কূটনীতি শক্তিশালী করতে গত ১৩ থেকে ১৬ এপ্রিল ভিয়েতনামের কেন জিয়াঙ প্রদেশ সফর করেন। ওই সফরের বিল ভাউচার ঘেঁটে দেখা গেছে, রাষ্ট্রদূত বিমানভাড়া হিসেবে ৫৯ হাজার ৮৬৬ টাকা, হোটেলভাড়া ৫৮ হাজার ১৩৩ টাকা (৩ জনের) (যার মধ্যে ২১ দশমিক ৪২ মার্কিন ডলার রাষ্ট্রদূত ব্যক্তিগতভাবে পরিশোধ করেন), ৩ দিনের হাত খরচ ২১ হাজার ৯৮৯ টাকা, ডিএ ৮ হাজার ২৫৭ টাকা এবং টার্মিনাল চার্জ বাবদ ৩ হাজার ৩০২ টাকা নেন রাষ্ট্রদূত। অথচ তার দেওয়া এই বিলের একটি ভাউচার (নম্বর ৩৫) ভুয়া পাওয়া গেছে। এছাড়া বিলের সঙ্গে বোর্ডিং পাস ও টিকেট নম্বরও নেই।

বিজ্ঞাপন

নিরীক্ষা প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজ ২০১৮ সালের ৬ নভেম্বর লাওসের রাষ্ট্রপতির কাছে ক্রেডেনসিয়াল পেশ করেন। ক্রেডনেসিয়াল পেশের জন্য তিনি ওই বছরের ৪ থেকে ৭ নভেম্বর লাওসের রাষ্ট্রপতি ভবন ‘হোকাম’ সফর করেন। ওই সফরে রাষ্ট্রদূত ভুয়া ভাউচার দিয়ে অর্থ নেন। নিয়ম অনুযায়ী, এই ধরনের সফরে স্বামীকে সফরসঙ্গী করা যায়। রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজও তাই করেছেন; কিন্তু তার কোনো প্রমাণপত্র দেখাতে পারেননি। শুধু তাই নয়, ওই সফরের বিল-ভাউচার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বিলের সঙ্গে ভাউচারের নানান অসঙ্গতি রয়েছে। হোটেল বিলের ভাউচারটি (নম্বর ৩৬) ত্রুটিপূর্ণ এবং ওভাররাইটিং করা, যা আর্ন্তজাতিক হোটেল ভাউচারের ক্ষেত্রে বেমানান। এছাড়া ওই বিলে হোটেলের নাম একেক জায়গায় একেকভাবে লেখা। এছাড়া পোস্ট বক্সের নম্বর দুইরকম ইতাদি।

দূতাবাসের ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত সময়ের হিসাব পর্যালোচনা করে আরও দেখা গেছে, ওই সময়ে মালি-ক্লিনার-কেয়ারটেকারদের ওভারটাইমবাবদ খরচ হয়েছে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৫৭০ টাকা। আর পেট্রল-তেল ও লুব্রিকেন্ট-মোটরযান খাতে খরচ হয়েছে ৮ লাখ ৩৯ হাজার ৩৫৩ টাকা। রাষ্ট্রদূতসহ মিশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও তাদের স্ত্রী কিংবা স্বামীদের পেছনে ওই আর্থিক বছরের ছয়মাসে দাঁতসহ আরও কিছু চিকিৎসায় খরচ হয় ১৫ লাখ টাকা।

হ্যানয়ের বাংলাদেশ দূতাবাসের আর্থিক নিরীক্ষায় কোটি টাকারও বেশি আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। রাষ্ট্রদূতের বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ব্যয়, ভ্রমণ খরচসহ মোট ৩১ টি খাতে এই আর্থিক অনিয়ম পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে মন্তব্য জানার জন্য পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক এবং ভিয়েতনামে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

হ্যানয়ের ঢাকা মিশনে দাঁত সারাতেই বছরে খরচ অর্ধকোটি টাকা
হ্যানয়ের ঢাকা মিশনের বাড়িভাড়ায় অনিয়ম, অর্ধকোটি টাকার ক্ষতি
অনিয়মের বাসা হ্যানয়ের ঢাকা মিশন
হ্যানয়ের ঢাকা মিশনে কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম
হ্যানয়ে কোটার গাড়ি বিক্রয় ৪ সাবেক রাষ্ট্রদূতের, সংকটে দূতাবাস

সারাবাংলা/জেআইএল/পিটিএম

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন