বিজ্ঞাপন

‘বিদ্যুৎ অপরিহার্য কিন্তু পরিবেশ, প্রকৃতি ধ্বংস করে নয়’

November 7, 2019 | 2:26 am

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, বিদ্যুৎ অপরিহার্য কিন্তু এটা পরিবেশ, প্রকৃতি ধ্বংস করে নয়। নিজেদের পায়ে কুঠারি দিয়ে আঘাতের মতো কয়লা-নির্ভর অপরিণামদর্শী বিদ্যুৎ প্রকল্পের আগ্রাসী বিকাশ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

বিজ্ঞাপন

বুধবার (৬ নভেম্বর) রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর-রুনি মিলনায়তনে আয়োজিত ‘কয়লায় শ্বাসরুদ্ধ: কার্বন বিপর্যয়ের মুখে বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশকালে তিনি এ সব কথা বলেন।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদার কারণে যৌক্তিকভাবেই এটি সরকারের প্রাধান্য পেয়েছে। অনেক সফলতাও এসেছে এ খাতে। কিন্তু মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ আমাদের একটাই। আর তাই প্রকৃতি পরিবেশ ধ্বংস করে বিদ্যুৎ উৎপাদন টেকসই হবে না।

তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে ২১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব শুধু বাতাস থেকেই। অথচ সরকার ঝুঁকছে কয়লার দিকে। ভারত, চীন, জাপান ও আমেরিকার আগ্রাসী বিনিয়োগের শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। অথচ ওইসব দেশ কয়লা থেকে সরে এসেছে। মূলত ক্ষমতার অপব্যবহার করে তারা এসব আমাদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

বিদ্যুতের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকারের কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না দাবি করে তিনি আরও বলেন, সরকারের ২৯টি কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ-কেন্দ্র বাস্তবায়িত হলে বর্তমানের চেয়ে ৬৩ গুণ বেশি কয়লা ব্যবহার হবে। আর তাই কয়লা-নির্ভর বিদ্যুৎ প্রকল্প সরকারের জাতীয় অঙ্গীকার, এসডিজি ও প্যারিস চুক্তির পরিপন্থী। ২০২০ সালের মধ্যে সরকারের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রতিশ্রুতি দিলেও বর্তমানে এ হার চার শতাংশের কম। দেশের ৪ কোটি ২০ লাখ জনগণ এখন ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ও দ্রুত দূষণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। একই সঙ্গে সরকারের অঙ্গীকার অনুযায়ী ২০৫০ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে নবায়নযোগ্য পদ্ধতি অনুসরণ করার কথা। অথচ সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকারের দৃশ্যমান কোনো কৌশলগত উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

কয়লা-ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই জানিয়ে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সব কয়লাই দূষণ ছড়ায়। এগুলোর কোনোটারই আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নেই। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ীও বেআইনি। দেশে যেগুলো হচ্ছে সেগুলো ক্ষমতার অপব্যবহার। স্বল্পমেয়াদী স্বার্থে দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিচ্ছে। আমরা ২৮ মাস আগে সরকারকে ১৩টি গবেষণা প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সরকারের উচিত কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ-কেন্দ্র স্থগিত করা ও নবায়নযোগ্য বিদুৎকেন্দ্র স্থাপন করা।

বিজ্ঞাপন

এর আগে ‘কয়লায় শ্বাসরুদ্ধ: কার্বন বিপর্যয়ের মুখে বাংলাদেশ’ নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে মার্কেট ফোর্সেস ও থ্রিফিফটি নামের দুটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশে প্রতিবেদনটির সার-সংক্ষেপ উপস্থাপন করেন ওয়াটারগেট বাংলাদেশের কো-অর্ডিনেটর শরিফ জামিল। বাংলাদেশে এর সহ-প্রকাশক বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), টিআইবি ও ওয়াটার কিপার্স বাংলাদেশ। একইদিন অস্ট্রেলিয়াতেও এটি প্রকাশিত হয়েছে।

অনুষ্ঠানে ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক শরীফ জামিল বলেন, কয়লা-ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের জলবায়ু, অর্থনীতি ও পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।

অনুষ্ঠানে বাপার সাধারণ সম্পাদক ডা. মো. আব্দুল মতিন বলেন, সারা বিশ্ব যখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার ব্যবহার বন্ধ করছে, বাংলাদেশ তখন কয়লা আঁকড়ে ধরছে। এর জন্য আমরা প্রবল ক্ষতির সম্মুখীন হবো।

অনুষ্ঠানে লিগ্যাল ইকোনোমিস্ট এম. এস সিদ্দিকী বলেন, সরকার ২০১০ সালে একটি নীতিমালা করেছিলেন, যেখানে নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে হলে আবেদনকারীকে প্রয়োজনের ৩০ শতাংশ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে। বাস্তবে এই সিদ্ধান্তের কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।

বিজ্ঞাপন

আলোচনায় অংশ নিয়ে ব্রতীর নির্বাহী প্রধান শারমীন মুরশিদ বলেন, ভুল নীতিমালা গ্রহণের ফলে পরিবেশ ধ্বংস হওয়ার উদাহরণ হলো আর্সেনিকের দ্বারা ভূগর্ভের পানি। কয়লা নির্ভরতায় ভূ-পৃষ্ঠের পানি ধ্বংস হতে চলেছে। কয়লা নীতিমালা বিদ্যমান জাতীয় পানি নীতিমালার সাথে সাংঘর্ষিক যা, আইনি জটিলতার সৃষ্টি করবে। একইসঙ্গে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অনেকগুলো সূচক অর্জনকে বাধাগ্রস্ত করবে। আমরা চাই একটি সবুজ নীতিমালা হোক, যা সরকার তার প্রতিটি প্রকল্পের সাথে প্রকাশ করবে।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে দেশে একটি কয়লা বিদ্যুৎ-কেন্দ্র থেকে ৫২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। সরকার এ সংখ্যা বাড়িয়ে ৩০টি করার উদ্যোগ নিয়েছে যা থেকে ৩৩ হাজার ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করার লক্ষ্যমাত্রা আছে। যা বাস্তবায়িত হলে বায়ুমণ্ডলে বার্ষিক ১১ কোটি ৫০ লাখ মেট্রিক টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করবে। এটি বাংলাদেশের দুর্দশাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বকে চরম হুমকির মুখে ফেলবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবজনিত বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণেই বাংলাদেশ তার স্থলভাগের ১১ শতাংশ হারাবে এবং চার ও পাঁচ মাত্রার ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার ঝুঁকি ১৩০ শতাংশ বাড়িয়ে দেবে, যা উপকূলে বসবাসরত ১ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষের জীবন ও জীবিকা হুমকির মুখে ফেলবে।

এছাড়াও প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশকে বার্ষিক দুই শত কোটি ডলার মূল্যের ৬ কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন কয়লা আমদানি করতে হবে। কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ-কেন্দ্রগুলো বিদেশি ঋণ-নির্ভর হওয়ায় ঋণের বোঝা বহুগুণে বাড়িয়ে দেবে , যেটি কিনা নতুন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শঙ্কাও তৈরি করবে। । এতে বৈদেশিক বাণিজ্য ভারসাম্য আরও প্রকট হবে। আবার তিনটি বাদে বাকি সব বিদ্যুৎ-কেন্দ্র নদীর তীরবর্তী হওয়ায় পানি ও জীব-বৈচিত্র্যে বড় প্রভাব ফেলবে। এটা আইনেরও পরিপন্থী।অথচ সৌরশক্তি ব্যবহার করেই ৫৩ গিগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে বাংলাদেশের। প্রস্তাবিত ও চলমান কয়লা-বিদ্যুৎ প্রকল্প সমূহের পরিবর্তে স্বল্প খরচে সৌরশক্তি বা বিকল্প পদ্ধতি ব্যবহার করে বাংলাদেশ চাইলেই তার প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা অর্জন করতে পারে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিশ্বে কয়লা-ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ সবচেয়ে ক্ষতিকর ও নোংরা জ্বালানী হিসেবে বিবেচিত। যা বিষাক্ত নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফার অক্সাইড, পিএম ২.৫, কয়লার ছাই ও এসিড নির্গমনের মাধ্যমে বায়ু ও পানি দূষণে বড় ভূমিকা পালন করে। এছাড়া, পারদ, সিসা ও ক্রোমিয়ামের মতো ভারি ধাতু নির্গমন করে, যা দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে শুরু করে অকাল মৃত্যুরও কারণ। এই বিবেচনায় এটি পরিবেশের জন্য বিপর্যয়কর একটি পরিকল্পনাও।

কয়লা ভিত্তিক নতুন বিদ্যুৎ-কেন্দ্র নির্মাণের আগ্রাসী এই পরিকল্পনা বাংলাদেশকে একটি অসম্মানজনক স্থানে নিবে যেখানে মাত্র ৫টি দেশকে বিবেচনা করা হয়। দেশগুলো হলো চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক ও ভিয়েতনাম। নতুন এই ২৯টি বিদ্যুৎ-কেন্দ্র নির্মাণের পেছনে সবচে বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে বিদেশি অর্থায়ন, যেটি বাংলাদেশকে মাত্র তিন বছরের মধ্যে কয়লা বিদ্যুৎ-কেন্দ্র নির্মাণের দিক থেকে ১২তম অবস্থান হতে ষষ্ঠ অবস্থানে উন্নীত করেছে। বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ যখন বিকল্প জ্বালানী ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করছে সেখানে বাংলাদেশ কয়লা-নির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন, মূলত আত্মহননের নামান্তর বলে জানানো হয় প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউনিসেফ ইতোমধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে সংঘটিত বন্যা ও সাইক্লোনসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশের ১ কোটি ৯০ লাখ শিশুর ভবিষ্যৎ হুমকির সম্মুখীন বলে সতর্কতা দিয়েছে। আর এক্ষেত্রে প্রস্তাবিত কয়লা-নির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্রসমূহ বাংলাদেশকে গভীর সঙ্কটে ফেলে দেবে।

প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, বর্তমানে বাংলাদেশে স্থাপিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রসমূহের মোট উৎপাদন সক্ষমতা ১৯ হাজার মেগাওয়াট, যার মধ্যে মাত্র তিন শতাংশ কয়লা-নির্ভর। সেই হিসেবে দেশের বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আসা ৯০ ভাগ মানুষ উপকৃত হচ্ছে কোনো ধরনের কয়লা আমদানি নির্ভরতা ছাড়াই। মূলত চীনা ব্যাংক ও কোম্পানি প্রস্তাবিত কয়লা-নির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্রসমূহ নির্মাণে বড় ভূমিকা পালন করছে। প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলোর অর্ধেকই অর্থায়ন করছে চীনারা। যুক্তরাজ্য ও জাপান নিজেদের দেশে পরিবেশ-বান্ধব বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনকে উৎসাহিত করলেও বাংলাদেশে প্রত্যেকে তিনটি করে কয়লা-নির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে অর্থের যোগান দিচ্ছে। যদিও যুক্তরাজ্য ২০২৫ সালের মধ্যে কয়লা-নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে সম্পূর্ণ সরে আসার ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে, ভারত বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত সুন্দরবনের অদূরে রামপালে কয়লা-নির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করছে।

সারাবাংলা/এসবি

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন