বিজ্ঞাপন

সঙ্গী যখন পোষা প্রাণী

November 22, 2019 | 10:30 am

আমাদের বাসায় ছোট্ট একটি কুকুরছানা এলো ২০০২ সালে। সেসময় অফিসের একটি কাজে আমাকে দুই মাসের জন্য জার্মানি যেতে হলো। আমার মেয়ের বয়স তখন মাত্র ৭ বছর। ঠিক একই সময় ওর বাবাকেও দেশের বাইরে যেতে হলো। মেয়ে থাকবে নানি-দাদির কাছে। কিন্তু মেয়ে বায়না ধরলো একটি কুকুর ছানা তাকে দিয়ে যেতে হবে। তখন ১ মাসের পাপ্পি এলো আমাদের বাসায়। পাপ্পি ছিল ল্যাপডগ- জার্মান স্পিৎজ। পাপ্পিকে মেয়ের কাছে রেখে আমরা চলে গেলাম। বাবা-মাকে ছেড়ে থাকা ঐ সময়টি পাপ্পিই ছিল ওর সারাদিনের সঙ্গী। খুব ভাল সময় কাটিয়েছে পাপ্পির সঙ্গে। ওর সব দায়িত্ব পালন করেছে আমার মেয়ে অনসূয়া।

বিজ্ঞাপন

আমি কুকুর বিড়াল ভালবাসলেও কখনো এসব নাড়াচাড়া করিনি। দুইমাস পর বাসায় ফিরে দেখলাম পাপ্পি অনেকটাই বড় হয়েছে। চেহারা এত মিষ্টি হয়েছে যে ওকে দেখলেই আদর করতে ইচ্ছা করতো। এইভাবেই পাপ্পি আমার মন দখল করে নিল। ধীরে ধীরে পাপ্পির ওপর থেকে সব বিধিনিষেধ উঠে গেল। আমরা সবাই ওর দখলে চলে গেলাম। পাপ্পি আমাদের নয়নমণি ছিল। কুকুর হলেও ও আমাদের কথা বুঝতো, আমরা ওর কথা বুঝতাম। ও বুটের হালুয়া খেতে খুব ভালবাসতো। আমাদের ধারণা ছিল, যেকেউ বুটের হালুয়া দিয়ে ওকে বগলদাবা করে নিয়ে যেতে পারবে। ২০১৩ সালে একটি দুর্ঘটনায় পাপ্পি মারা গেল। পাপ্পির চলে যাওয়া আমাদের জীবনে একটি ভয়াবহ কষ্টের স্মৃতি।

বাসার সবাই টানা ৬/৭ দিন কেঁদেছি। ওর খেলনা, বালিশ সব বুকে নিয়ে বসে ছিলাম। সত্যি বলতে ২/৩ দিন বাসায় ঠিকমতো রান্নাও হয়নি। জুলেখা ছিল রান্নার দায়িত্বে। পাপ্পির মৃত্যুতে সেও খুব ভেঙে পড়েছিল। আমার মনে হয়েছিল বাবার মৃত্যুর পর পাপ্পির মৃত্যুতে আমি এতটা কষ্ট পেয়েছিলাম ।

আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম বাসায় আর কুকুর আনা হবে না। প্রিয় প্রাণীটির চলে যাওয়ার কষ্ট সহ্য করা কঠিন। কিন্তু কোন পোষা কুকুর ছাড়া কয়েকদিন কাটানোই আমাদের জন্য কষ্টকর হয়ে দাঁড়ালো। ব্যস, এসে ঢুকলো তিব্বতী লাসা মংক। ভোতা মুখের পাগল পাগল চেহারা ‘মংক’ এর নাম আসলে হওয়া উচিত ছিল পাগলা জগাই।

বিজ্ঞাপন
পোষা কুকুর - মংক, ছবি: লেখক

পোষা কুকুর- মংক, ছবি: লেখক

মংক আসার পর আমাদের বাসায় জন্ম হলো নয়নতারার, জুলেখার মেয়ে। ছোট্ট একটি বাচ্চাকে ছোট্ট মংক বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করলো। প্রথমদিকে খুব ভয় পেতাম আমরা প্রথম। মনে হতো এই বুঝি মংক নয়নতারাকে ব্যথা দেবে, কামড়ে দেবে। কিন্তু ব্যাপারটি ছিল একেবারেই উল্টো। প্রায় সমবয়সী একটি মানব শিশু ও একটি কুকুর ছানা একসঙ্গে বেড়ে উঠলো বন্ধুর মতো। পাপ্পিকে পেয়ে যেমন আমার মেয়ের একাকীত্ব কেটেছিল, ঠিক তেমনি মংককে পেয়ে নয়নতারাও একজন বন্ধু পেয়েছিল। একবারও মংক ওকে ছোট্ট একটু আঘাতও করেনি। বরং ওকে রক্ষা করেছে।

নয়নতারার খেলার সাথী মংক, ছবি: লেখক

নয়নতারার খেলার সাথী মংক, ছবি: লেখক

যারা কুকুর পালেননি বা যারা কুকুর ভালোবাসেন না তাদের কাছে এসব কথা খুব বাড়াবাড়ি মনে হবে। কিন্তু আমি দেখেছি একটি পোষা প্রাণী কীভাবে বাচ্চাদের একাকীত্ব দূর করে, কীভাবে পরিবারে আনন্দের উৎস হয়ে ওঠে। এই নগর জীবনে কুকুর, বিড়াল বা অন্যকিছু পালা খুবই অসুবিধাজনক ব্যাপার। এছাড়া কুকুর বিষয়ে অধিকাংশ মানুষের পাপ-তাপ বিষয়ক আপত্তি আছে। কাজেই এসব যদি কেউ পালতে চান, মনস্থির করেই পালবেন। ঝোঁকের মুখে পালতে শুরু করে আবার বিদায় করে দেয়াটা খুব কষ্টের। আমি মনে করি এটা করা রীতিমতো অন্যায়।

নয়নতারা ও মংক, ছবি; লেখক

নয়নতারা ও মংক, ছবি: লেখক

মংকের একজন সাথী হিসেবে আবার আমাদের বাসায় আনা হলো জুডুকে- জার্মানি ডসহাউন্ড। ছোটখাট হাত পায়ের কুকুর জুডুকে দেখে আমি প্রবল বিরক্ত হয়েছিলাম। একটি কুকুর থাকতে আবার আরেকটি কেন। এতো ঝামেলা সহ্য করতে হয়। বিশেষ করে পটি ট্রেনিং, খাওয়া দাওয়া, গোসল করানো, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, ডাক্তার দেখানো খুব ঝামেলার ও ব্যয়সাধ্য ব্যাপার।

বিজ্ঞাপন

তারপরও ইদুঁরের মতো চেহারার জুডুও ঢুকে গেল অনায়াসে। দখল করে নিল আমার মন। জুডু যে প্রকৃতির কুকুর, ওদের কাজ চাষিদের ক্ষেতের ভিতর থেকে ইঁদুর খুঁজে আনা। তাই ছোট্ট জুডু সারাদিন জুতা, কাপড়, চাদর, বালিশ, তার সব জিনিস কাটাকুটি করতো। একবার সে মানিব্যাগ থেকে দুইহাজার টাকা বের করে কুটি কুটি করেছিল। আরেকবার অনসূয়ার বন্ধুর পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে ফেলেছিল।

বাসার নতুন সদস্য জুডু, ছবি: লেখক

মংক, জুডু আর নয়নতারা সারাদিন বাড়ি মাথায় করে রাখতো। সেই পাপ্পির সময় থেকেই প্রতিবেশি ও বেড়াতে আসা বাচ্চাদের একটা বড় আকর্ষণ ছিল আমাদের বাসা। এখানে এলে কুকুর দেখা যেতো। কোন কোন সাহসী বাচ্চা কুকুরগুলোর সাথে বন্ধুত্বও করে ফেলতো।

এছাড়াও আমাদের বাসায় ফরিদপুরের রাস্তার ধার থেকে এসেছিল একটি ভেড়ার বাচ্চা পিপি। যে ঘাসের বদলে চা, স্যান্ডউহচ খেতো। এসেছিল একটি ময়নার বাচ্চা এবং একপট পেঁচার বাচ্চা। এরা সবাই পথের পাশে কুড়িয়ে পাওয়া। যত্নআত্তি করে এদের জায়গামতো ছেড়ে দিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু এরা যে কয়দিন ছিল, সেই কয়দিন বাসায় উত্তেজনার কোন শেষ ছিল না।

আমার মেয়ে এই কুকুরগুলোকে বাসায় আমদানি করলেও এদের দেখাশোনার ভার আমার আর নয়নতারার ওপর দিয়ে সে বিদেশে পড়তে গেল। ও যাওয়ার পর মংকের দু:খের কোন শেষ ছিল না। কারণ মংক এখনো আমার মেয়েকেই মূল মালিক বলে মনে করে। কুকুরদের মধ্যে প্রভু প্রীতি সাংঘাতিক। ওরা একবার যাকে প্রভু বলে মনে করে তাকেই মনের মধ্যে রেখে দেয়। একবার যাকে চিনে ফেলে, কোনদিন তাকে ভুলে যায়না। কুকুর শত্রু-মিত্র চেনে গন্ধ দিয়ে।

বিজ্ঞাপন
জুডু আর নয়নতারার অপার বন্ধুত্ব, ছবি; লেখক

জুডু আর নয়নতারার অপার বন্ধুত্ব, ছবি: লেখক

কুকুর কথা বলতে পারেনা কিন্তু ওদের অভিব্যক্তি প্রখর। মানুষের সব নির্দেশনা তারা বুঝতে পারে। ২০১৪ সালে মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে আমি যখন হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরলাম, তখন এই মংক, জুডু আর নয়নতারাকে নিয়ে আমি খুব ভাল সময় পার করেছি। একমাত্র মেয়ে বাইরে পড়তে চলে গেলেও আমি কখনও একাকিত্ববোধ করিনি শুধুমাত্র ওদের জন্য। আমার খুব ভয় ছিল এই বুঝি কুকুরগুলো আমার কাটা জায়গায় ব্যথা দিবে। কিন্তু না ওরা কেমন করে জানি বুঝে গিয়েছিল আমি অসুস্থ। বাসার কেউ অসুস্থ হলে ওরা ঠিকমতো খাওয়াদাওয়াও করেনা।

এরপর আবার অনসূয়ার হাত ধরে আমাদের বাসায় এসেছে মাস্কা নামের ছোট্ট একটা বিল্লু বাচ্চা। ওকে রাস্তার পাশ থেকে তুলে আনা হয়েছে। বিড়াল আমার খুব একটা পছন্দ না। কিন্তু তারপরও সে এই পরিবারের সদস্য হয়ে গেল। দিব্যি কুকুর আর নয়নতারার সাথে খেলাধুলা করে দিন কাটাচ্ছে। অবসর সময়ে ওর কাজ দরজার এপারে বসে বারান্দায় পাখির আনাগোনা দেখা। বেশ বুঝতে পারি ওর মনের ইচ্ছা, এক-দুইটা পাখি ধরে খেয়ে ফেলা।

ছোট্ট বেড়াল বাচ্চা- মাস্কা, ছবি; লেখক

ছোট্ট বেড়াল বাচ্চা- মাস্কা, ছবি: লেখক

কুকুর, বিড়াল সবাই ভালবাসেন না। অনেকে ভালবাসলেও ঝামেলার কারণে পালার দায়িত্ব নেন না। বিশেষ করে ওদের একা রেখে বাসার সবাই একসাথে বেড়াতে যাওয়াটা বেশ ঝামেলার ব্যাপার। তাই এখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে যাদের কাছে মূল্যের বিনিময়ে আপনি কুকুর-বিড়াল রেখে বেড়িয়ে আসতে পারবেন।

আমার মনে হয় সম্ভব হলে কুকুর বা বিড়াল পাললে খুব একটা মন্দ হয় না। ওরা থাকলে বাচ্চারা খুব আনন্দে থাকে। শহরের এই বন্দী জীবনে এই প্রাণীগুলোই ওদের সময় কাটানোর উৎস হয়ে উঠে। আমি লক্ষ্য করেছি বাচ্চাদের মনখারাপ হলে ওদের নিয়ে শুয়ে থাকে, ওদের সাথে কথা বলে। এমনকি বড়রাও ওদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারে। এছাড়া পাহারাদার হিসেবেও এরাই সেরা। কারো সাধ্য নেই ওদের অজান্তে ঘরে এসে ঢোকার।

অফিস থেকে ফিরে ঘরে এসে ঢুকলে ওরা আমার কাছে ছুটে আসে, এটাই খুব আনন্দের। মনটা খুব ভাল হয়ে যায়। এতো টানাপোড়েন, চাপ, অশান্তি, দু:খ-কষ্টের মধ্যে সুখি হতে চাইলে নিজের উপায় নিজেকেই খুঁজে বের করতে হয়। পোষা প্রাণীর সাথে সময় কাটানো এর একটি উপায় হতে পারে।

সারাবাংলা/টিসি

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন