বিজ্ঞাপন

যৌন হয়রানিতে শাস্তির বিধান চাই সড়ক পরিবহন আইনে

November 23, 2019 | 1:31 pm

‘পৃথিবীতে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর,অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’- নারী ও পুরুষকে এভাবেই দেখেছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। আজ পুরুষের সাথে পাল্লা দিয়ে প্রায় সমান তালে সমাজ ও অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন নারীরা। আজ কোথাও তাদের পিছিয়ে থাকার বা পিছনে রাখার সুযোগ নেই । কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি সড়কে, গণপরিবহনে, অফিসে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও নারীদের পূর্ণ নিরাপত্তা দিতে আজ আমরা ব্যর্থ।

বিজ্ঞাপন

আমরা দেখছি, বিগত কয়েক বছরে অসংখ্য খবরের শিরোনাম হয়েছে গণপরিবহনে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার নারী। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী কিংবা নারী শ্রমিক অনেকেই নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং হচ্ছেন। অফিস, আদালত, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে প্রতিদিন নারী ব্যবহার করছে গণপরিবহন। এতে চালকের সহকারী থেকে শুরু বাসে চলাচল করা যুবক থেকে মধ্যবয়সী সবার কাছে প্রতিনিয়ত যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন নারীরা। যৌন হয়রানির ঘটনা এতটাই অহরহ ঘটে যে, তা বলে শেষ করা যাবে না। সবগুলো ঘটনার সাথে যুক্ত পরিবহন শ্রমিক। কিছু আলোচিত ঘটনার মামলা হয়েছে কিন্তু বেশিরভাগই রয়ে যায় আড়ালে।

তবে কিছুদিন হল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিপীড়ণের শিকার হয়ে নারীরা এখন ঘটনাগুলোকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসছেন। প্রতিদিনই ফেসবুকে এ ধরনের স্ট্যাটাস পাওয়া যায়। অনেকে ভয় পেয়ে ফেসবুকে লেখার পরে ফের স্ট্যাটাস তুলে নিচ্ছেন বা প্রাইভেসি পরিবর্তন করছেন। কারণ, জানাজানি হওয়ার পরপরই তাঁরা বিভিন্নজনের হুমকি পাচ্ছেন। নির্যাতনের শিকার হওয়া যাত্রী লোকলজ্জার ভয়ে ঝামেলা এড়াতে পুলিশের কাছে কোন অভিযোগ করেন না। আবার করেও অনেক সময় ফল পান না । আমরা এটাও জানি, এই অপরাধের সাথে যুক্ত পরিবহন শ্রমিকদের অনেকেই মাদকাসক্ত এবং মাদক ব্যবসায়ী । কিন্তু কোন শ্রমিক কিংবা মালিক সংগঠনের নেতাদের কাছ থেকে প্রতিবাদ বা প্রতিকার পাওয়া যায়না । বরং বেশিরভাগ সময় এইসব হিংস্র অপরাধীদের বাঁচাতে মরিয়া হয়ে ওঠে তারা।

২০১৮ সালে প্রকাশিত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক পরিচালিত ‘নারীর জন্য যৌন হয়রানি ও দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে দেশে গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় ৯৪ শতাংশ নারী মৌখিক, শারীরিক বা অন্যান্যভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। যার ৮১ শতাংশ কোনো প্রতিবাদ না করে চুপ থাকেন আর ৭৯ শতাংশ তাদের জায়গা পরিবর্তন করেন।

বিজ্ঞাপন

আরেক বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশন এইড তাদের পরিচালতি জরিপে বলছে, ৫৩ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হন পরিবহন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দ্বারা আর ৪২ শতাংশ নারী বাসে যাতায়াত করা পুরুষ যাত্রী দ্বারা ভিন্নভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার। এই জরিপ আরও বলছে,বাংলাদেশে ভীড়ের মাঝে ৫৭ শতাংশ নারী যৌন হয়রানি এবং ৮৪ শতাংশ নারী অশ্লীল মন্তব্য, ইঙ্গিতের শিকার হন।

গণপরিবহন বা জনসমাগম এলাকায় এসব যৌন হয়রানি, অশ্লীল মন্তব্য, অনৈতিক ইঙ্গিত রোধে আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই বললেই চলে।

দুঃখজনক হলেও সত্য এই আইন ঘোষণার পর কোন ব্যক্তি কিংবা সংগঠনের বক্তব্য কিংবা বিবৃতি চোখে পড়েনি। বিগত দুইদশকে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে এবং শিশু সুরক্ষায় বাংলাদেশে আইনী কাঠামো শক্তিশালী হয়েছে এবং সরকারি বেসরকারি নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে; কিন্তু সামগ্রিক বিবেচনায় ও পরিস্থিতি বিশ্লেষণে দেখা যায়,নারীদের প্রতি যৌন নির্যাতন ,নিপীড়ন, সহিংসতা খুব একটা কমেনি।

বিজ্ঞাপন

সড়ক পরিবহন আইন ২০১৯-এ যৌন নির্যাতন বা হয়রানির শাস্তির বিষয় কোন বিধান রাখা হয়নি! নতুন আইনের উল্লেখযোগ্য ১৪টি বিধানে চোখ রাখলে আরো স্পষ্ট হবে-

 সড়কে গাড়ি চালিয়ে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে হত্যা করলে পেনাল কোডের ৩০২ ধারা অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
 সড়কে বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালালে বা প্রতিযোগিতা করার ফলে দুর্ঘটনা ঘটলে তিন বছরের কারাদণ্ড অথবা তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। আদালত অর্থদণ্ডের সম্পূর্ণ বা অংশবিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে দেয়ার নির্দেশ দিতে পারবে।
 মোটরযান দুর্ঘটনায় কোন ব্যক্তি গুরুতর আহত বা প্রাণহানি হলে চালকের শাস্তি দেয়া হয়েছে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের জেল ও সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা।
 ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া মোটরযান বা গণপরিবহন চালানোর দায়ে ছয় মাসের জেল বা ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেয়া হয়েছে।
 নিবন্ধন ছাড়া মোটরযান চালালে ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে।
 ভুয়া রেজিস্ট্রেশন নম্বর ব্যবহার এবং প্রদর্শন করলে ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড অথবা এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে।
 ফিটনেসবিহীন ঝুঁকিপূর্ণ মোটরযান চালালে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেয়া হয়েছে।
 ট্রাফিক সংকেত মেনে না চললে এক মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দণ্ডিত করা হবে।
 সঠিক স্থানে মোটরযান পার্কিং না করলে বা নির্ধারিত স্থানে যাত্রী বা পণ্য ওঠানামা না করলে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে।
 গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনে কথা বললে এক মাসের কারাদণ্ড এবং ২৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
 একজন চালক আইন অমান্য করলে প্রতিবার তার পয়েন্ট বিয়োগ হবে এবং এক পর্যায়ে লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে।
 গণ পরিবহনে নির্ধারিত ভাড়ার চাইতে অতিরিক্ত ভাড়া, দাবি বা আদায় করলে এক মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
 আইন অনুযায়ী ড্রাইভিং লাইসেন্সে পেতে হলে চালককে অষ্টম শ্রেণি পাস এবং চালকের সহকারীকে পঞ্চম শ্রেণি পাস হতে হবে হবে। আগে শিক্ষাগত যোগ্যতার কোন প্রয়োজন ছিল না।
 গাড়ি চালানোর জন্য বয়স অন্তত ১৮ বছর হতে হবে। এই বিধান আগেও ছিল; এছাড়া
 সংরক্ষিত আসনে অন্য কোনও যাত্রী বসলে এক মাসের কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

সম্প্রতি সড়ক নিরাপত্তা আইন ২০১৯ কার্যকর করার পর যেভাবে পরিবহন শ্রমিকরা রাষ্ট্র তথা জনগণকে জিম্মি করে অন্যায়ভাবে যে দাবি দাওয়া জাতিকে শোনাচ্ছে তা স্পষ্ট রাষ্ট্রের সাথে বিরোধিতা । অতীতেও দেখেছি, শ্রমিকদের বিভ্রান্ত করে কিভেবে জনগণকে জিম্মি করে রাষ্ট্রকে অচল করে দেয়ার হুমকি দিয়ে অন্যায়, অপরাধ এবং সড়কে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে চলেছে । আমরা বারবার নমনীয় হয়ে তাদের সাহসের স্পর্ধা বাড়িয়ে দিয়েছি । তাদের পেছনের চাঁদাবাজ গডফাদারদের চিনেও না চেনার ভাবধরে এড়িয়ে গেছি । সড়কে বিশৃঙ্খলা আর চাঁদাবাজির সর্বদলীয় পঞ্চপাণ্ডবদের এখনই রুখে দিতে না পারলে হেরে যাবে বাংলাদেশ।

একবার ভাবুনতো, কিছুদিন পূর্বে আমাদের সন্তানরা সহপাঠীদের হারিয়ে সড়ককে নিরাপদ করতে আন্দোলনে নেমেছিল, আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে রাস্তায় নেমেছিল। তারা আমাদের রাষ্ট্রের প্রতি যে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিল- এখন কি উত্তর দিবেন তাদের?

বিজ্ঞাপন

লেখক: এফ এম শাহীন , সাধারণ সম্পাদক, গৌরব ’৭১, সংগঠক, গণজাগরণ মঞ্চ ।

সারাবাংলা/এমএম

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন