বিজ্ঞাপন

জনঅসন্তোষ সৃষ্টি করে ‘সরকার পতনের ছক’ হিযবুত তাহরীরের

November 23, 2019 | 9:04 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: সাম্প্রতিক বিভিন্ন ইস্যুতে উসকানি দিয়ে জনঅসন্তোষ সৃষ্টি করে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির মাধ্যমে সরকারের পতনের ছক নিয়ে এগুচ্ছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীর। সংগঠনটি ‘ক্ষমতাবান প্রভাবশালী বিভিন্ন মহলকেও’ উসকানি দিয়ে তাদের মধ্যে সরকার বিরোধী মনোভাব তৈরিতে তৎপর আছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রাম নগরীতে গ্রেফতার হওয়া হিযবুত তাহরীরের শীর্ষ কয়েকজন নেতাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি-দক্ষিণ) শাহ মো. আব্দুর রউফ।

এডিসি রউফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা হিযবুত তাহরীরের চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রধান নেতাসহ ১৫ জনকে গ্রেফতার করেছি। এদের মধ্যে কয়েকজন নেতা সংগঠনের পরিকল্পনা ও কর্মকৌশল বিষয়ে কিছু তথ্য আমাদের দিয়েছেন। তারা জানিয়েছে, হিযবুত তাহরীর সরকারের পতন চায়। তারা ভিন্ন গোষ্ঠীর মাধ্যমে শাসনক্ষমতা পরিচালনা চায়।’

বিজ্ঞাপন

‘প্রেক্ষাপট তৈরির জন্য তারা গত ৬ থেকে ৭ মাস ধরে বিভিন্ন ইস্যুতে লিফলেট-পোস্টার ছড়িয়ে জনঅসন্তোষ সৃষ্টির চেষ্টা করে আসছে। আমাদের কাছে তথ্যপ্রমাণ আছে, তারা বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার হত্যা, ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান, সাম্রাজ্যবাদ-গণতন্ত্র, এসডিজি-এমডিজি ইত্যাদি বিভিন্ন ইস্যুতে উসকানিমূলক কাজ করেছে। সর্বশেষ তারা সড়ক পরিবহন আইন নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষকে পুঁজি করে নাশকতার পরিকল্পনা করেছিল।’ – বলেন রউফ।

চার মাস নজরদারির পর ধরা

শুক্রবার (২২ নভেম্বর) দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত অভিযানে গ্রেফতার করা হয়েছে হিযবুত তাহরীরের চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রধান (আঞ্চলিক কমান্ডার) আবুল মোহাম্মদ এরশাদুল আলম, আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ (৩০), ওয়ালিদ ইবনে নাজিম (১৮), ইমতিয়াজ ইসমাইল (২৫), নাসিরুদ্দিন চৌধুরী (২৯), নাজমুল হুদা (২৭), লোকমান গণি (২৯), মোহাম্মাদ করিম (২৭), আব্দুল্লাহ আল মুনিম (২২), কামরুল হাসান রানা (২০), আরিফুল ইসলাম (২০), আজিমুদ্দিন (৩১), মো. আজিমুল হুদা (২৪), ফারহান বিন ফরিদ (২৩) এবং মো. সম্রাট (২২)।

বিজ্ঞাপন

এদের মধ্যে ওয়ালিদ ইবনে আজিম ও ইমতিয়াজ ইসমাইলকে শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর লিফলেট বিলির সময় নগরীর আন্দরকিল্লায় শাহী জামে মসজিদ থেকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম নগরীর নিউ চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায় খাদিজা টাওয়ারের ষষ্ঠ তলার একটি ফ্ল্যাটে সাংগঠনিক বৈঠক থেকে আঞ্চলিক কমান্ডার এরশাদুলসহ ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর নগরীর পাঁচলাইশ থানার আল আমিন হাউজিংয়ের বাসা থেকে ফারহান ও বায়েজিদ বোস্তামি থানার মোজফফর নগরের একটি বাসা থেকে সম্রাটকে গ্রেফতার করা হয়।

অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার শাহ মো. আব্দুর রউফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘চার মাস আগে থেকে আমরা তাদের কর্মকাণ্ড নজরদারি শুরু করি। তারা যেখানে লিফলেট বিলি করে, যেখানে পোস্টার লাগায় সেখানকার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করে কয়েকজনকে শনাক্ত করি। এরপর তারা যেসব মসজিদে গিয়ে লিফলেট বিলি করে, সেগুলোতে আমরা গোয়েন্দা বেশে নজরদারি শুরু করি। অবশেষে গতকাল (শুক্রবার) দুজনকে লিফলেট বিলির সময় হাতেনাতে গ্রেফতার করা হয়।’

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘হিযবুত জাল’

গ্রেফতার হওয়া হিযবুতের চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রধান (আঞ্চলিক কমান্ডার) এরশাদুল নগরীর একটি স্বনামধন্য ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের বাংলা বিভাগের শিক্ষক। মাহফুজ গ্রেফতার জঙ্গিদের মধ্যে দ্বিতীয় শীর্ষস্থানীয়, তিনি নোভারটিস ওষুধ কোম্পানির কর্মকর্তা। নাসিরুদ্দিন চৌধুরী ফাহিম ট্রাভেলস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সাবেক কর্মকর্তা। নাজমুল হুদা ড্যাফোডিল ইনস্টিটিউট থেকে পাস করা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। লোকমান মহসিন কলেজের স্নাতকোত্তরের ছাত্র। আরিফুল চট্টগ্রাম সরকারী মডেল কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ওয়ালিদ ইবনে নাজিম ইস্পাহানী পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। এছাড়া পলাতক দুজন জঙ্গি আফজাল হোসেন আতিক (৩৫) আরেকটি স্বনামধন্য স্কুলের খণ্ডকালীন শিক্ষক এবং তাহমীদ সুফিয়ান চট্টগ্রাম ডিজিটাল স্কুলের পরিচালক।

বিজ্ঞাপন

অভিযানে অংশ নেওয়া কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম নগরীর নামিদামি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে হিযবুত তাহরীরের সংগঠকেরা ঢুকে পড়েছেন। তারা ছাত্রদের টার্গেট করছেন। তাদের দাওয়াত দিয়ে সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত করছেন। এসব ছাত্ররা কোচিং কিংবা প্রাইভেটে যাওয়ার নাম করে জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িত হচ্ছেন। যারা গ্রেফতার হয়েছেন, তাদের অনেকের মা-বাবা জানেনই না যে তাদের সন্তান নিষিদ্ধ সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। এ ধরনের আরও ২০ থেকে ২৫ জন ছাত্রের নাম আমাদের কাছে আছে, যারা সক্রিয়ভাবে হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে যুক্ত।’

নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আমেনা বেগম বলেন, ‘আমাদের অভিভাবকদের সচেতন হবে। স্কুল-কলেজে, কোচিং কিংবা প্রাইভেটে যাওয়ার নামে তাদের সন্তানেরা কোথায় যাচ্ছেন, বাসায় তাদের আচরণ কেমন, এন্ড্রয়েড ফোন যাতে তারা ব্যবহার করতে না পারেন- এসব বিষয়ে অভিভাবকদেরকেই সচেতন হতে হবে। অল্প বয়সে নিষিদ্ধ সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া, এটা খুবই অ্যালার্মিং।’

ছাত্রশিবিরের স্টাইলে এগুচ্ছে হিযবুত তাহরীর

পুলিশ জানিয়েছে, গ্রেফতার হওয়া হিযবুত তাহরীরের সক্রিয় সংগঠকেরা প্রায় সবাই শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডেও তারা শিবিরকেই অনুসরণ করছেন। সদস্য সংগ্রহ, অনুদান আদায়, সাংগঠনিক সভা- তাদের সবকিছুই শিবিরের আদলে।

অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার আব্দুর রউফ সারাবাংলাকে জানান, হিযবুতের সাংগঠনিক কাঠামো অনেকটাই শিবিরের মতো। গ্রেফতার হওয়া এরশাদুল চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রধান। তার অধীনে আছেন তিনজনের নেতৃত্বে তিনটি সেল। তিনজন হলেন- আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ, তাহমীদ সুফিয়ান ও আফজাল হোসেন আতিক। এই তিনজনের নেতৃত্বে ভাগ হয়ে মাঠ পর্যায়ে সাংগঠনিক কাজ করেন সদস্যরা।

গ্রেফতার হওয়া ১৫ জনের প্রায় সবাই মাহফুজের অধীন সদস্য। তারা মূলত চান্দগাঁও-বায়েজিদ বোস্তামি এলাকায় সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন।

রউফ বলেন, ‘শিবিরের টার্গেট মেধাবী ছাত্ররা। হিযবুতের টার্গেট মেধাবী ছাত্র ও অভিজাত পরিবারের সন্তানেরা, যারা ক্ষমতাবলয়ের কাছাকাছি থাকেন। শিবিরও নামাজের দাওয়াত দিয়ে সদস্য সংগ্রহ করে। হিযবুতের দাওয়াতের স্টাইলও প্রায় একই। হিযবুতের প্রত্যেক সদস্যকে সপ্তাহে একদিন সাংগঠনিক প্রশিক্ষণ ও একদিন কর্মশালায় অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক। দুই ঘণ্টার সেশন চলে নেতাদের বাসায় কিংবা অন্য কোনো গোপনস্থানে।’

‘সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠনের মতো হিযবুতও চলে কাট অফ পদ্ধতিতে। মূল নেতার সঙ্গে সবার পরিচয় নেই। জুনিয়র কর্মীরা সিনিয়রদের সম্পর্কে কোনো তথ্য জানতে পারেন না। প্রত্যেক সদস্যকে বাধ্যতামূলক চাঁদা দিতে হয়। অনুদানও আসে। এখন আমরা তাদের অর্থের উৎস নিয়ে কাজ করব।’- বলেন রউফ।

উল্লেখ্য, এরশাদুলকে গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে ২ লাখ ৮২ হাজার টাকা জব্দ করে পুলিশ। এরশাদুল ও মাহফুজ শিবিরের সক্রিয় নেতা ছিলেন। গ্রেফতার মুনিম, আজিম ও লোকমান এর আগেও একাধিকবার ঢাকা-চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় গ্রেফতার হয়েছিলেন বলে রউফ জানান।

গ্রেফতার ১৫ জনের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. কামরুজ্জামান বাদি হয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দায়ের করেছেন। ওই মামলায় শনিবার (২৩ নভেম্বর) বিকেলে আদালতে হাজিরের পর তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন