বিজ্ঞাপন

অনেকেই বলেন পুরস্কারের সিলেকশন ফেয়ার হয় না, আমি একমত নই

December 4, 2019 | 5:46 pm

আশীষ সেনগুপ্ত

২০০০ সালের ১৪ এপ্রিল। বাংলাদেশের টেলিভিশনের ইতিহাসে সূচিত হল এক নতুন অধ্যায়। উন্মুক্ত টেরিস্টেরিয়াল টেলিভিশন কেন্দ্র হিসেবে সম্প্রচার শুরু করল একুশে টেলিভিশন (ইটিভি)। যার শুরু থেকেই নতুনত্ব ও অভিনবত্ব মুগ্ধ করেছিল দর্শকদের। দর্শকনন্দিত হয় তাদের বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান। তার মধ্যে একটি ‘এবং বিয়ে’। ধারাবাহিকভাবে প্রচারিত এই নাটকটি সেসময়  ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। শীর্ষস্থানীয় ও জনপ্রিয় অভিনয় শিল্পীদের নিয়ে এই নাটকটির নির্মাতা ‘সাইফুল ইসলাম মান্‌নু’। নিজের গল্প, চিত্রনাট্য ও নির্দেশনায় ‘এবং বিয়ে’- নিজের ক্যারিয়ারে এটিই তার প্রথম কাজ। এরপর ‘খুঁজে বেড়াই তারে’, ‘আমার বউ সব জানে’, ‘বয়স যখন একুশ’, ‘চলো হারিয়ে যাই’-সহ একের পর এক সফল ও দর্শকনন্দিত নির্মাণ করে গেছেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

সবশেষ কাজ সিনেমা- ‘পুত্র’। হারুন রশীদ’র গল্পে চিত্রনাট্য ও পরিচালনা করলেন তিনি। সেলুলয়েডে ধারণ করলেন একটি পরিবারের মানসিকভাবে দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙে যাওয়ার গল্প। নিজের সেরাটাই দেয়ার চেষ্টা চালিয়েছেন এই নির্মাণে। আর সেই চেষ্টা বিফল হয়নি। পেলেন দীর্ঘ শ্রমের প্রতিদান। অর্জিত হল এই অঙ্গনের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি- ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’। ২০১৮ সালের শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার- ‘সাইফুল ইসলাম মান্‌নু’। ‘পুত্র’ ২০১৮ সালের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ মোট ১১টি বিভাগে পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে। তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ পোশাক ও সাজসজ্জা বিভাগে মনোনীত হয়েছেন তারই সহধর্মিণী সাদিয়া শবনম শান্তু।

সাইফুল ইসলাম মান্‌নু বর্তমানে অবস্থান করছেন সুদূর আমেরিকায়। মুঠোফোনে আড্ডায় শোনালেন ‘পুত্র’র গল্প ও নিজের কথা। সারাবাংলা’র পাঠকদের জন্য…

বিজ্ঞাপন

• প্রসঙ্গঃ ‘পুত্র’ —

পুত্র মানে সন্তান। একটা পরিবারে সুস্থ স্বাভাবিক সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়েই বাবা মায়েরা যে পরিমান উদ্বিগ্ন থাকেন, সেখানে সেই সন্তানটি যদি হয় বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু, তখন তাদেরকে কি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়, ভুক্তভোগীরা ছাড়া সেটা কেউই কোনদিন উপলব্ধি করতে পারবেনা। আমার কাছে তাই ‘পুত্র’ কোন চলচ্চিত্র না, এটা একটা জীবন চিত্র। ওই পরিবারগুলোর মানসিক বা বাস্তবিক পরিস্থিতি পুরোপুরি সেলুলয়েডে বন্ধি করা, অসম্ভব। তারপরেও চেষ্টা করেছি তাদের দুমড়ে মুষড়ে ভেঙ্গে যাওয়ার গল্পটা যতটা সম্ভব সবার সামনে তুলে ধরতে।

বিজ্ঞাপন

• ‘পুত্র’ নির্মাণে সম্পৃক্ততা —

ছবির বিষয়বস্তু আর দশটা সিনেমার মত না। ইমপ্রেস টেলিফিল্ম থেকে যখন আমাকে ছবিটা নির্মানের জন্য বললো, সত্যি বলতে কি তখনও আমি অটিজম সর্ম্পকে তেমন কিছুই জানিনা। আমি প্রথমে সিনেমা বা স্ক্রীপ্ট না, অটিজম বিষয়টা সম্পর্কে জানার চেষ্টা শুরু করলাম। আমার স্ত্রীর বান্ধবী বুশরা, আমেরিকাতে থাকে ওরা। ওর একটা বিশেষ শিশু রয়েছে। আমি রাতের পর রাত ফোনে ওদের সাথে কথা বলতে থাকলাম। ঢাকায় একটা বিশেষ শিশুদের স্কুলে গেলাম। বাচ্চাদের সাথে সময় কাটালাম। টিচার প্যারেন্টস সবার সাথে কথা বললাম। ইন্টারনেটে এ বিষয়ে পড়াশুনা করতে লাগলাম। যত জানতে লাগলাম তত বেশি ভয় পেয়ে যাচ্ছিলাম। কারন বিষয়টা অনেক কঠিন। বাবা-মা বা ডাক্তাররাই যেখানে এই বাচ্চাদের ভেতরে কি হচ্ছে কি চাচ্ছে সেটা বুঝতে পারেনা, সেখানে একজন ফিল্মমেকার হিসেবে সেই বিষয়গুলো ফুটিয়ে তোলা, সত্যিই কঠিন ছিলো আমার জন্য ।

• জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার —

বিজ্ঞাপন

রাষ্ট্রীয় পুরস্কার হচ্ছে এমন একটা স্বীকৃতি যেটা একজন মানুষকে আরো বেশী রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্বশীল করে তোলে। রাষ্ট্র যখন আপনাকে সম্মান দেয়, তখন রাষ্ট্রের প্রতি আপনার একটা বিশেষ দায়িত্ব চলে আসে। একটা সময় ছিল যখন শিল্পের তাড়নায় নিজের মনের তাগিদে, জীবন যাপনের প্রয়োজনে কাজ করতাম। কিন্তু এখন অবচেতনভাবেই ভাবনাগুলোর একটু পরিবর্তন চলে আসছে। স্বীকৃতি বোধহয় এভাবেই সবাইকে প্রভাবিত করে।

• ‘পুত্র’ যখন পুরস্কৃত —

যখন কোনও কাজ করি, তখন পুরষ্কার বা টাকা-পয়সা পাওয়া এগুলো বিষয়ই আমার মনে আসে না। এমনিতেই আমরা অতটা মেধাবী না যতটা মেধাবী একজন চলচ্চিত্রকারের হওয়া উচিত। যদি টাকা পুরস্কার এগুলো মগজের বেশিরভাগ জায়গা দখল করে রাখে, তাহলে কাজটা নিয়ে আপনি ভাববেন কি করে। মনোযোগ দিয়ে সততার সাথে কাজ করলে তার স্বীকৃতি একদিন না একদিন সে পাবেই। অনেকে বলে যে পুরস্কারের সিলেকশানে নাকি অনেক বিষয়-আসয় থাকে, ফেয়ার হয়না। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতাতো বলে ভিন্ন কথা। আমি তো কারো সঙ্গে যোগাযোগ করিনি। উনারা ছবিটা দেখেছেন। বিচার বিশ্লেষন করে উনারাই আমার সাথে যোগাযোগ করেছেন। জানিয়েছেন যে আমাকে নমিনেশান দিয়েছেন। পরে গেজেটে দেখলাম পুরস্কারই পেয়ে গেছি।

• নিজের প্রাপ্তি যখন সর্বোচ্চ স্বীকৃতি —

সত্যিই বলে বোঝাতে পারবো না, অদ্ভুত। যারা শিল্পী বা শিল্প চর্চা করে, তাদের সারাজীবনের চাওয়া বা সাধনা থাকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। আমি এর আগে কখনোই কোন এ্যাওয়ার্ড পাইনি। এমনকি, কেউ কখনো আমাকে কোন এ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রনও করেনি। ওনারা হয়তো আমাকে পরিচালক হিসেবে গণনাই করেননি। খারাপ লাগতো। তখন ভাবতাম ঠিক আছে, হয়ত বড় কিছু আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আল্লাহ আমাকে সর্বোচ্চ সন্মান জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার দিয়েছেন। বুঝতেই পারছেন অনুভুতি কেমন।

• নির্মাণের প্রায় ৩ বছর পর এই স্বীকৃতি —

২০১৬ সালে ‘পুত্র’র যাবতীয় কাজ শেষ করে আমি আমেরিকায় চলে আসি। শুটিংয়ের সময় অনেক পরিবার যাদের এরকম বিশেষ শিশু রয়েছে, তাদের সঙ্গে আমার একটা হৃদ্যতার সর্ম্পক তৈরি হয়। রিলিজ হওয়ার পর ঐ বাবা মায়েদের কাছ থেকে যে ম্যাসজেগুলো পেয়েছি, ওগুলো কোন এ্যাওয়ার্ডের চেয়ে কম কিছু ছিলো না। এতদিন পরে কেউ তাদের কথাটা বলেছে, তাদের দুঃখগুলো স্পর্শ করতে পেরেছে। আমি যেন তাদেরই প্রতিনিধি। একটা কাজের সফলতাতো এখানেই।

• স্বীকৃতি চিত্রনাট্যকার হিসাবে, পরিচালক নয়- কোনো আক্ষেপ —

আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যারা ওখানে জুরী বোর্ডের মেম্বার হিসাবে ছিলেন, তারা এ ব্যাপারে অসম্ভব দক্ষ এবং অভিজ্ঞ। আক্ষেপ করার মানেই হচ্ছে তাদেরকে অসম্মান করা। ওনারা যে সিদ্ধান্তটা নিয়েছেন, সেটাকে আমি সম্মানের সাথে গ্রহণ করতে চাই। আর এটাতো রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত। রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তকে একজন নাগরিক হিসেবে সন্মান করা উচিত।

• একই সঙ্গে সহধর্মিণীও পুরস্কৃত —

আমি ভীষণ সৌভাগ্যবান যে আমরা দুজনই একসাথে স্বীকৃতি পেয়েছি। এটা আমার জন্য দারুণ একটা প্রাপ্তি। একজন পুরুষের সাফল্যের পেছনে নারীর অবদান সবচেয়ে বেশী। আর আমার ক্ষেত্রে এটা অনস্বীকার্য যে, আজকের এই সাফল্যের পেছনে আমার স্ত্রী (সাদিয়া শবনম শান্তু)’র অবদান সবচেয়ে বেশী। ও হয়তো শ্রেষ্ঠ পোশাক ও সাজসজ্জা বিভাগে মনোনীত হয়েছে, কিন্তু পুরো ছবিটার সবগুলো ক্ষেত্রেই ওর ভূমিকা ছিল। দিন-রাত আমার সঙ্গে এই ছবিতে সে কাজ করেছে। প্রতিটা বিষয়ে ওর তীক্ষ্ণ নজর ছিল। যেটা আমার জন্য ভীষণ হেল্পফুল হয়েছে। স্বামীর সাফল্যে স্ত্রী’র আনন্দ, আমাদের ক্ষেত্রে দুজনের সাফল্যেই দুজনেরই আনন্দ (হাসি)।

• আমেরিকা যাওয়ার কারণ —

আমি আসলে আমার নেক্সট স্টেপটা দেখার চেষ্টা করছি। এখানে এসে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি। এখানে ওরা কিভাবে কাজ করে, সেগুলো দেখার, শেখার চেষ্টা করছি। আমি আমার পরবর্তী পদক্ষেপের দিকে এগিয়ে যেতে চাই। এখানে আমি কমউিনিকেশান ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ-এ পড়াশুনা করছি। শেখার তো কোন শেষ কিংবা বয়স নাই।

• অন্য কোন কাজ —

‘ওমনে এম্পাওয়ারম্যান্ট’র এর উপর কাজ করার জন্য কিছু গল্প লেখা শুরু করেছি। ১৩টা মেয়েকে নিয়ে ১৩টা গল্প। কিভাবে তারা শত প্রতিকূলতার মধ্যেও এগিয়ে যাচ্ছে। সেটা আমি আর আমার এক বন্ধু মিলে গবেষনা করছি। নাম দিয়েছি ‘বাসর রাত’। ঐ যে বললাম রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আপনাকে রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্বশীল করে তোলে। আমার মনে হয়েছে নারী স্বাধীনতা নিয়ে কিছু কাজ করা উচিত।

• নিজের দেশ, নিজের ক্ষেত্র থেকে কি দূরে থাকার ভাবনা?

আমি তো আমেরিকায় থাকতে আসিনি। এসেছি শিখতে, আরো জানতে, পৃথিবীতে আরো অনেক কিছু আছে। সেটা জানা প্রয়োজন। আমি একটা গ্রাম থেকে ঢাকায় পৌঁছেছি। এখন যদি সুযোগ থাকে আরো উন্নত, আরো ভালো কিছু জানার বোঝার বা শেখার, তাহলে সে সুযোগটা আমি নেবো না কেন? নিজেকে সমৃদ্ধ করে আবার আমার জায়গায় আমি ফিরে আসবো সেগুলো প্রয়োগ করতে। দর্শকরা আমার কাছ থেকে আরো ভালো কিছু পায়, তার জন্য একটু সময় ব্যয় করছি। একটা প্রসেসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। নিজেকে ট্রেইন্ড করছি। মেধাকে শাণিত করছি।

• সবশেষে —

আমরা সব সময় হিসেব কষতে থাকি কি পেলাম। একবারও ভাবি না যে কি দিলাম ? পাওয়া না পাওয়ার হিসেব না করে আমি যদি আমার কাজটা সততার সাথে করে যাই, আমার পুরোটা দেয়ার চেষ্টা করি, তাহলে হয়ত প্রাপ্তিটা ঠিকই যথাসময়ে আমার বা আপনার কাছে চলে আসবে। আর যদি না আসে দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। ধরে নিতে হবে আমি এখনও ওটা পাওয়ার জন্য প্রস্তুত না। অথবা যা কিছু পাইনি সেটা আমার জন্য না। পৃথিবীতে মানুষ জন্মের গূঢ় রহস্যই বোধহয় কর্ম। হিসেব নিকেশের উর্ধ্বে উঠে অন্যের কল্যাণে, বিশেষ কল্যাণে, সৃষ্টির কল্যাণের কর্মেই আমরা সবাই মেতে থাকি।

সারাবাংলা/এএসজি/পিএম

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন