বিজ্ঞাপন

অসংগতির সরস-ভাষ্য : এই বেশ আতঙ্কে আছি

February 17, 2018 | 4:11 pm

সামিয়া কালাম :

বিজ্ঞাপন

এই বেশ ভালো আছি, কর্ম-কাজ নেই, গাড়ি-ঘোড়া কিছু নেই
অফিস-কাচারি নেই, হাজিরা কামাই নেই,
সময় দেই না বলে তেলেবেগুণ জ্বলে গিন্নীর রাগ নেই

নেই নেই কিছু নেই-

তবুও তো আছে কিছু বলতে যা বাধা নেই।

বিজ্ঞাপন

নচিকেতার একটি গান- ‘এই বেশ ভালো আছি’। কিন্তু ভালো থাকা যাচ্ছে না বলেই এই গান। আর তাপস রায় চারদিকের ভালো এবং মন্দ, সু এবং কু, আবদার এবং অধিকার, পতন এবং ছন্দপতন এসব দেখে আতঙ্কে আছেন। এই আতঙ্ক অমূলক নয়। সমকালীন জীবনের বহুমাত্রিক অসংগতি নিয়ে রচিত হয়েছে তাঁর রম্যগল্পগ্রন্থ- ‘এই বেশ আতঙ্কে আছি’। ফলে মানতেই হচ্ছে এ সময়ের জন্য এই শিরোনাম যথার্থ।

এখন প্রশ্ন হলো, মানুষকে কখন আতঙ্কে থাকতে হয়? ‘আতঙ্ক’ শব্দের সিনোনিমগুলোও আতঙ্কের মতই ভীতিকর। আশঙ্কা, ভীতি, বিহবলতা, ত্রাস, আকস্মিক ভয় ইত্যাদি। মূলত মস্তিষ্কের সিনাপ্সগুলো যখন ক্রিয়াশীল হয় তখনই মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পরে। বিচিত্র কিন্তু যৌক্তিক সব ইস্যু তাঁর লেখায় দেখা গেছে।

তাঁর ‘আজিমপুরের আগে মাদ্রাজ’ গল্পে ইসমাইলের কথায় আসা যাক। সে সরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণরত এক রোগী। স্যালাইন এবং অক্সিজেন সিলিন্ডারের বিবৃতির পাশাপাশি এই গল্পটিতে উঠে এসেছে সরকারী হাসপাতালের প্রকৃতচিত্র। লেখক হাসপাতালের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে:

বিজ্ঞাপন

‘রানওয়ের মতো লম্বা ফ্লোর। ফ্লোরে সমান্তরাল শিরাবিন্যাসের মতো সারি সারি বেড। বেডগুলোর বেহাল দশা। বালিশ আছে, তোশক নেই, তোশক থাকলে চাদর নেই; সেই চাদর ছাড়া বেডে শুয়ে চিকিৎসার চান্স পাওয়া চাট্টিখানি কথা না।’

‘বাপের দুধ’ নামের এক অলিক বস্তু পানে পীড়া আক্রান্ত ফিরোজের বাপসহ আর সকল রোগীর ঢালাও চিকিৎসা বলতে ‘চালকুমড়ার মতো ঝুলতে থাকা’ স্যালাইন, আর কদাচিৎ নার্সের দর্শন। আর তাই ফিরোজের বাপ মনে করে মরে যাবার আগে অন্তত একবার মাদ্রাজ যাওয়া দরকার, যদি বেঁচে ফেরা যায়!

হাসপাতাল থেকে শিশু উধাও হওয়ার খবর মাঝে মাঝে পত্রিকায় দেখা যায়। কিন্তু রোগী উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনাও যে ঘটে না এমন নয়। পাশাপাশি হাই প্রোফাইল রাষ্ট্রীয় আসামী অথবা ভিআইপি রোগীরা ডাক্তারি রেকমন্ডেশনে হাসপাতালে অবস্থান করেন। কে জানে কবে আবার কে উধাও হয়ে যায়! সেই আতঙ্ক থেকেই ‘আজিমপুরের আগে মাদ্রাজ’ গল্পের ইতি টানা হয়।

দেশের স্বাস্থ্য সেবার মান নিয়ে একাধিক বার আতঙ্কিত হতে দেখা গেছে তাপস রায়কে। কেননা তালেব ডাক্তার ‘হাতুড়ে’ অপবাদ থেকে আত্মরক্ষায় ব্যস্ত। এমনকি গৃহপালিত হাঁসের মুখে ‘কোয়াক’ শব্দটি তাকে পীড়িত করে। লেখক তালেব ডাক্তারের বর্ণনায় লিখেছেন:

বিজ্ঞাপন

‘চশমাটা শুধু ঠিক জায়গায় বসিয়ে নিরাবেগ কণ্ঠে বললেন, তোর বাড়িতে আমি যাব না।

ক্যান? কী হইসে ডাক্তারসাব? লোকটা যেন হাজার ফুট ওপর থেকে প্যারাস্যুট ছাড়াই উড়োজাহাজ থেকে উড়ে এসে আছড়ে পড়ল ওই তালেব ডাক্তারের চার পায়া টেবিলের ওপর।

ডাক্তার কিন্তু তাকে ধরলেন না। সটান বলে দিলেন, আমাকে দেখলেই তোর হাঁসগুলো কোয়াক কয়াক করে ডাকে। কোয়াক মানে যে হাতুড়ে ভেবেছিস আমি জানি না! তুই যা, আমি যাব না।’

উল্লেখিত গল্পের শিরোনাম ‘অজ্ঞ বৈদ্য যমসম’। তুখোড় একটি শিরোনাম। স্বল্প পরিসরে ব্যাপক আলোকপাত করা হয়েছে গ্রামবাংলার হাতুড়ে ডাক্তারদের চিকিৎসা ব্যবসার ওপর। একডালা কাঁকড়সমেত চাল থেকে যেমন পটু গেরস্ত বউ কাঁকড় আলাদা করে। ঠিক সেভাবে ডাক্তারের শ্রেণী বিভাগ করে আলাদা করা হয়েছে এই গল্পটিতে।

‘বদ্রির বউ গঞ্জের স্পেশালিস্টদের খবর কমই রাখে। তারা জানেই না, যিনি হার্ট স্পেশালিষ্ট তিনি লিভার দেখেন না। যিনি তালেব ডাক্তারের মত চোখ দেখেই শরীরের রোগ ধরে ফেলেন, সেই তিনিই আবার চোখ দিয়ে চোখের রোগ ধরতে পারেন না। এভাবে মাথার চুল থেকে পায়ের তালু যার যার ডিপার্টমেন্ট আলাদা।

শহরের তেপান্ন গলিতে তেত্রিশ পদের ডাক্তার। চোখ যতই মনের কথা বলুক, মনের রোগ মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ছাড়া কেউ এ শহরে বুঝবে না।’

‘এই বেশ আতঙ্কে আছি’ শিরোনামের রম্যগদ্যে নানাবিধ আতঙ্কের বিস্তারিত বিবরণ আছে। ‘কালো মেয়ে’ জন্ম দেয়ার আতঙ্ক থেকে শুরু করে ছিনতাইকারী, রাজাকার, দলবাজি, ডেঙ্গু মশা এরকম অসংখ্য বিষয়ে আমরা আতঙ্কে থাকি। এবং সেই সব আতঙ্কের পারদ দিন দিন বেড়েই চলছে। সেই অর্থে ‘এই বেশ আতঙ্কে আছি’ বইটির শিরনাম যথার্থ।

পেশায় সাংবাদিক তাপস রায়, আমি-তুমি, তুমি-আমির পার্মুটেশান এবং কম্বিনেশনের বাইরে গিয়ে লিখে চলেছেন রম্যগল্প, কখনও বিদ্রুপাত্মক গদ্য। বর্তমান জীবনের নানা অসংগতি লেখক বহুমাত্রিক দৃষ্টিকোন থেকে অবলোকন করেছেন এবং সেগুলোই তিনি প্রকাশ করেছেন অনবদ্য শিল্পিত ভাষায়। তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলি বেশ ভারি। রসবোধ অসামান্য এবং তা প্রকাশের ভাষাও তীক্ষ্ম এবং সরস। বস্তুত তাঁর ব্যবহৃত ভাষা এবং বক্তব্য উপস্থাপনকৌশলই তাঁর রচনাকে সরস করেছে।

বইটির জন্য লেখক কথাসাহিত্য বিভাগে কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বইটি প্রকাশ করেছে অনার্য প্রকাশনী। প্রচ্ছদ এঁকেছেন আজহার বিন ফরহাদ। বইটির মূল্য ১৫০ টাকা।

 

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন