বিজ্ঞাপন

অজয় রায়কে শেষ শ্রদ্ধা, মুক্ত চেতনায় দেশ গড়ার আহ্বান

December 10, 2019 | 4:11 pm

সিনিয়র নিউজ রুম এডিটর

ঢাকা: অসাম্প্রদায়িক চিন্তক, লেখক, পদার্থবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক অজয় রায়ের প্রতি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছে সর্বস্তরের মানুষ।

বিজ্ঞাপন

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ব্যবস্থাপনায় মঙ্গলবার (১০ ডিসেম্বর) সকাল এগারোটার কিছু পরে এই বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধার মরদেহ শহীদ মিনারে আনা হলে প্রথমে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। এসময় উপস্থিত ছিলেন ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আব্দুল আওয়াল।

গার্ড অব অনার প্রদানের পরে অধ্যাপক অজয় রায়ের মরদেহবাহী কফিনটি একটি কালো কাপড়ে ঘেরা টেবিলে রাখা হয়। জাতীয় পতাকা এবং ফুলে ঘেরা কফিনটির মাথার দিকে কাঁচ দিয়ে ঘেরা। এসময় বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি পুষ্প স্তবক ও ফুলের তোড়া দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানান বিশিষ্ট এই সংগঠক ও শিক্ষকের প্রতি। এসময় অজয় রায়ের ছেলে অনুজিৎ রায়সহ উপস্থিত ছিলেন, তাঁর পরিবারের সদস্য ও ঘনিষ্ঠজন।

বিজ্ঞাপন

অজয় রায়ের ছোট ছেলে অনুজিৎ রায় বলেন, ‘বাবা চাইলেই পরিবারসহ বিদেশে স্থায়ী হতে পারতেন। কিন্তু বাংলাদেশের টানে তিনি স্ব-পরিবারে দেশে ফিরে আসেন। তিনি সবসময় বলতেন, এই দেশ আমাদের। এই দেশ ছেড়ে কেন যাব আমরা?’

অনুজিৎ রায় আরও বলেন, ‘ভাই অভিজিৎ হত্যার বিচারের রায় দেখে যেতে পারলে তার বাবা কিছুটা স্বস্তিবোধ করতেন। ধর্মনিরেপেক্ষ যে বাংলাদেশের জন্য তাঁরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, স্বপ্ন দেখেছেন ও কাজ করেছেন সেই স্বপ্ন যেন আমরা পূরণ করতে পারি।

বিজ্ঞাপন

অজয় রায়ের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে উপস্থিত হয়েছিলেন বিশিষ্ট অভিনেতা, আবৃত্তিকার এবং স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রণী ব্যক্তিত্ব হাসান ইমাম। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘অজয় রায়ের মতো একজন অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্বকে হারানো বাংলাদেশের জন্য দুঃসংবাদ। কারণ, তার মতো ব্যক্তিত্ব আর তৈরি হচ্ছে না এই দেশে।’

তিনি আরও বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অধিকারী অজয় রায় একটি শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছেন। তার ছেলে অভিজিৎ রায়ের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের আগে থেকেই তিনি সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করেছেন। এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সবধরনের আন্দোলন সংগ্রামে নিজ থেকেই এগিয়ে এসেছেন সবসময়।’

শিক্ষাবিদ, নারীনেত্রী, সমাজসেবী ও মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক মাহফুজা খানম বলেন, ‘আমার শিক্ষক অজয় রায়ের সঙ্গে দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে সম্পর্ক। আমি তার সরাসরি ছাত্রী। ষাটের দশকে আইয়ুব খান, মোনায়েম খানের বিরুদ্ধে নানা আন্দোলন সংগ্রাম করতাম। তখন পাকিস্তানি জান্তাদের বিরুদ্ধে কাজ করতে যারা অনুপ্রাণিত করতেন অজয় স্যার ছিলেন তাদের একজন। নানা দুঃসময়ে তিনি আমাদের পাশে ছিলেন, অংশগ্রহণ করেছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধেও। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পশ্চিমবঙ্গে থাকা শিক্ষক সমজকে একত্রিত করেছিলেন।

বিজ্ঞাপন

মাহফুজা খানম আরও বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ হওয়ার পর নানা উত্থান-পতনে এবং সবধরনের প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছেন। গণজাগরণ মঞ্চেও সক্রিয় ছিলেন তিনি। অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের পর তার শরীর ভেঙে পড়ে। শেষের দিকে শারীরিক অসুস্থতার জন্য তিনি আর বক্তব্য দিতে রাজি হচ্ছিলেন না।’

সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘স্যার অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের রায় দেখে যেতে পারেননি। আপনারা অভিজিৎসহ সব মুক্তমনাদের হত্যার বিচার করুন।’

তরুণদের উদ্দেশে মাহফুজা খানম বলেন, ‘অজয় স্যারের মত আমরাও একদিন চলে যাব। আমরা যারা লাল সবুজের পতাকার জন্য যুদ্ধ করেছি, তোমরা সেই চেতনা ধরে রাখবে। একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ তোমরা গড়বে।’

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবীর বলেন, ‘১৯৯২ সালে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠনের একদম শুরু থেকেই যুক্ত ছিলেন অধ্যাপক অজয় রায়। জাহানার ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের দাবি নিয়ে গঠিত ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা এবং অভিভাবক হিসেবে পাশে ছিলেন অজয় রায়। বাংলাদেশে যখনই কোনো সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে তখনই প্রতিবাদ করেছেন তিনি। এমনকি নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনের জন্য তিনি বিভিন্ন নোবেল লরিয়েটদের কাছে চিঠিও লিখেছেন।’

শাহরিয়ার কবীর বলেন, ‘আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই পদার্থবিজ্ঞানী পদার্থবিদ্যায় নোবেল মনোনয়নের বিচারক কমিটির একজন সদস্য ছিলেন। পদার্থবিদ হলেও তিনি মুক্তচিন্তা ও ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদ নিয়ে লিখেছেন। ফলে বারবার ধর্মান্ধদের রোষানলে পড়েছেন, পেয়েছেন হত্যার হুমকি। তাকে হত্যা করতে না পারলেও তাঁর ছেলে অভিজিৎ রায়কে হত্যা করেছে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি।’

অজয় রায়ের অসংখ্য লেখা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে; সেগুলো একত্রিত করে যেন একটি গ্রন্থ প্রকাশ করা হয় সেজন্য বাংলা একাডেমির প্রতি দাবি জানান শাহরিয়ার কবীর। পাশাপাশি স্মারক গ্রন্থ প্রকাশ ছাড়াও অধ্যাপক অজয় রায়ের নামে ঢাকার একটি সড়কের নামকরণের দাবি জানান তিনি।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি, সংস্কৃতিকর্মী ও মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, ‘আজ আমরা এমন একজন মানুষকে বিদায় জানাতে শহীদ মিনারে সমবেত হয়েছি যিনি একটি অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি সমতা, ধর্ম-নিরপেক্ষতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিজ আদর্শে অবিচল ছিলেন। তার সন্তানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর শোকে নিমজ্জিত না হয়ে সবাইকে নিয়ে লড়াই চালিয়ে গেছেন। তিনি লড়াই চালিয়ে গেছেন এই জন্য যে, তার সন্তানসহ আরও যেসব মুক্তচিন্তকের মৃত্যু হয়েছে, তাদের বিচার হয়।’

নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু আরও বলেন, ‘অধ্যাপক অজয় রায় শুধুমাত্র শ্রেণিকক্ষের শিক্ষক ছিলেন না, বৃহত্তর সমাজের শিক্ষক ছিলেন। যা তিনি শিখেছিলেন, সেটা শুধু চর্চাই করতেন না, অনুজ প্রতীমদের মধ্যে সেই চেতনা ছড়িয়ে দিতেও কাজ করেছেন।’

শহীদ মিনারে অজয় রায়কে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে হাজির হয়েছিল নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা-কর্মী। উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও।

এছাড়া বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক সাদেকা হালিম, অধ্যাপক কাবেরী গায়েন, মানবাধিকারকর্মী খুশী কবীর, সঙ্গীতশিল্পী ফকির আলমগীর, অভিনেতা পীযূষ বন্দোপাধ্যায়, ঝুনা চৌধুরী, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকিসহ আরও অনেকে।

সারাবাংলা/আরএফ/পিটিএম

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন