বিজ্ঞাপন

কাছ থেকে পাওয়া সৌরভ

December 10, 2019 | 6:06 pm

প্রভাষ আমিন

ইডেন গার্ডেন নিছক একটা ক্রিকেট মাঠ নয়; যেন একটি জাদুঘর। ঢুকতে হবে না, বাইরে দাঁড়ালেই দেখা যাবে ইডেনের অনেক গৌরবের চিত্র বড় করে লাগানো আাছে প্রতিটি গেটে। ক্লাব হাউজে ঢুকতে গেলে ড্রেসিং রুমের দুই পাশে অনার্স বোর্ডে অনেক খেলোয়াড় ও সংগঠকের নাম লেখা। এছাড়া ইডেনের দেয়ালে দেয়ালে অনেক ছবি টাঙানো; যেখান থেকে উঠে আসে ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাস। তবে আমার বিবেচনায় ইডেনের দেয়ালে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছবিটি হলো- একটি জার্সি ও তার উপরে খালি গায়ের এক ক্রিকেটার। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ওঠার ল্যান্ডিংয়ে ছবি দুটি টাঙানো। যারা ক্রিকেটের সামান্যতম খোঁজখবর রাখেন, তারা নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন খালি গায়ের ক্রিকেটার কে, জার্সিটাই বা কার!

বিজ্ঞাপন

২০০২ সালের ১৩ জুলাই ভারতের তখনকার অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলী লর্ডসের অভিজাত ব্যালকোনিতে জার্সি খুলে বুনো উদযাপন করে ঝড় তুলেছিলেন ক্রিকেট বিশ্বে। ম্যাচটি ছিল ভারত-ইংল্যান্ডের মধ্যকার ন্যাটওয়েস্ট ট্রফির ফাইনাল। আগে ব্যাট করে ইংল্যান্ড তুলেছিল ৩২৫। এত বিশাল রানের টার্গেট তাড়া করে ভারত ম্যাচটা জিতে নেয় ২ উইকেটে। মোহাম্মদ কাইফের ব্যাট থেকে উইনিং রান আসার সঙ্গে সঙ্গে সৌরভ জার্সি খুলে পতাকার মতো ঘোরাতে থাকেন। সৌরভের এই উদযাপন নিয়ে যত আলোচনা হয়েছে, সমালোচনা হয়েছে তার চেয়ে বেশি। অনেকেই বলছেন, সৌরভের এই উদযাপন ক্রিকেটিং রুচির সাথে মানানসই নয়। তার এই উদযাপন লর্ডসের আভিজাত্য আর কৌলিন্যে কালিমা লেপন করেছে। কোনো অভিযোগই মিথ্যা নয়। কিন্তু ভারতের দিক থেকে দেখলে বলতেই হয়, সৌরভের সেই উদযাপন বদলে দিয়েছিল ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসকেই। সেদিনের এক উদযাপনে ভারতীয় ক্রিকেটকে সাবালক বানিয়ে দিয়েছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলী। ভারতের যা কিছু সাফল্য, তার সবই রক্ষণাত্মক খেলে, দেশের মাটিতে প্রতিপক্ষকে স্পিনের ফাঁদে ফেলে। ভারতের ক্রিকেটকে আক্রমণাত্মক ধারায় নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্ব সৌরভের। টিম ভারত যখন ফর্মের তুঙ্গে, তখন ভারতের ক্রিকেট বোর্ডের নেতৃত্ব সেই গাঙ্গুলীর হাতেই।

গত ২১ নভেম্বর কলকাতার ইডেন গার্ডেনে টেস্ট ক্রিকেটকে ঘিরে উৎসবের হাট বসিয়ে সৌরভ আবারও প্রমাণ করলেন ‘আউট অব দ্য বক্স’ ভাবনার দক্ষতা এখনও হারিয়ে ফেলেননি তিনি। সৌরভ এখনও পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব। সব মিলিয়ে জনপ্রিয়তা বিচার করলেও সৌরভই হয়তো সামনের কাতারেই থাকবেন। সৌরভকে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান বানানোটাকে তাই অনেকে নরেন্দ্র মোদির ক্রিকেট রাজনীতি বলে মনে কররেছেন। সবাই বলছেন, সৌরভের কাঁধে চড়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে আসন গাড়তে চাইছেন। সৌরভই যে সবচেয়ে জনপ্রিয়, সেটা প্রমাণে গণভোট লাগে না। সৌরভ যেদিক দিয়ে হেঁটে যান, ‘দাদা, দাদা’ রব ওঠে। সব সময় তার চারপাশে একটা ভিড় হেঁটে বেড়ায়। গোলাপি বলের টেস্টের আগের সন্ধ্যায় ইডেনে গিয়ে দেখলাম সৌরভের ব্যস্ততা। মাঠে ঢুকলেন। বেরোনোর সময় মুন্নী (মুন্নী সাহা) ক্লাব হাউজের দোতলা থেকে ডাকলেন- দাদা কথা বলবেন না একটু? একটু হেসে, হাত নেড়ে চলে গেলেন। টেস্টের প্রথম দিনে তো তার দম ফেলার সময় নেই। ক্লাব হাউজে আমাদের সামনে দিয়ে অনেকবারই আসা যাওয়া করলেন। কিন্তু ভিভিআইপি আর ভিআইপিদের সামলোতে এতই ব্যস্ত যে সাক্ষাৎকার দেওয়া বা কথা বলারও সময় নেই। এই ব্যস্ততা অবশ্য তিনি নিজে আমন্ত্রণ জানিয়ে এনেছিলেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও অভিষেক টেস্ট স্কোয়াড, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, ভারতের সব সাবেক অধিনায়ক, ভারতের অন্য খেলার তারকা- রীতিমতো তারার মেলা বসে যায় ইডেনে। আর সব তারকার কেন্দ্রে সবচেয়ে উজ্জ্বল এবং ব্যস্ত মহারাজা সৌরভ গাঙ্গুলী।

বিজ্ঞাপন

টেস্টের তৃতীয় দিনে আমরা ইডেনের ৩ নম্বর বক্সে কলকাতা ডেপুটি হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বসে খেলা দেখছিলাম। উদ্বোধনের দিনে এই বক্সটি নির্ধারিত ছিল শেখ হাসিনা ও মমতা ব্যানার্জির জন্য। তখনও বক্সের দরজায় তাদেরই নাম লেখা ছিল। তৃতীয় দিনে ভিভিআইপিদের ভিড় নেই। খেলাও তেমন জমেনি, তাই সবকিছুতে ঢিলেঢালা ভাব। হুট করে সেই বক্সে এলেন সৌরভ গাঙ্গুলী। কিছুক্ষণ খেলা দেখলেন। মুন্নী সাক্ষাৎকারের আবদার করতে না করতেই বাংলাদেশ অলআউট, খেলা শেষ। গাঙ্গুলীর তাড়া- তাকে মাঠে যেতে হবে। ফিরে এসে হবে, বলেই উঠে চলে গেলেন। সিরিয়াসলি বললেন না তাৎক্ষণিকভাবে ঝামেলা এড়াতে বললেন, বোঝা মুশকিল। তবু ‘ফিরে এসে হবে’ এইটুকু আশ্বাসে ভরসা করে আমি আর মুন্নী নিচতলায় বেরোনোর গেটে দাঁড়ালাম। দাঁড়ালাম তো দাঁড়িয়েই রইলাম। কত মানুষ, কত তারকা আসে যায়, কিন্তু সৌরভ গাঙ্গুলীর কোনো খবর নেই। নিচতলায় সিঁড়ির ডানপাশে ভারতের ড্রেসিং রুম, বা পাশে বাংলাদেশ। ভারতীয় দল বেরুবে বলে নিরাপত্তারক্ষীরা বেশ কয়েকবার আমাদের তাড়া দিল। আমরা একবার ডানে তো একবার বায়ে, এসব করে টিকে থাকলাম। কড়া নিরাপত্তায় ভারতীয় দল এবং অল্প নিরাপত্তায় বাংলাদেশ দল ইডেন ছাড়ার পর নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও শিথিল হয়ে যায়। কিন্তু ‘দাদা’ আসেন না। এক ফাঁকে আমরা ভারতীয় ড্রেসিং রুম হয়ে মাঠেও ঢুকে পড়লাম। গিয়ে দেখি গাঙ্গুলীকে ঘিড়ে বেশ ভিড়। সবাই তার সাক্ষাৎকার নিতে চান। এই ভিড়ে আমি আর মুন্নীও ঢুকে পড়লাম। চট করে গাঙ্গুলী আমাদের দিকে ফিরে বললেন, ওপরে আস। ব্যস আমাদের আর পায় কে? আমরা তখন যেন ইডেনের মালিক বনে গেলাম। দাদার পিছু নিলাম। পদে পদে নিরাপত্তার বাধা। কিন্তু বারবার গাঙ্গুলীই মনে করে আমাদের তাঁর সঙ্গে নিয়ে গেলেন। যেতে যেতে এক পর্যায়ে নিজেদের আবিষ্কার করলাম ইডেন গার্ডেনে সৌরভ গাঙ্গুলীর রুমে। ক্লান্ত সৌরভ বসে কথা বলতে চাইছিলেন। মুন্নীর আবদার দাঁড়ালে ভালো হয়। তাই সই। মুন্নী যখন তার মোবাইল সামনে ধরল গাঙ্গুলী বললেন, তুমি থাকবে না ফ্রেমে? আমি বললাম, আমার মোবাইলে পুরো ইন্টারভিউ রেকর্ড হচ্ছে। ইডেন গার্ডেনে দুই ক্যামেরায় ধরা দিলেন সৌরভ গাঙ্গুলী। আমরাও কাছ থেকে পেলাম গাঙ্গুলীর সৌরভ।

ছোট্ট ইন্টারভিউতে গাঙ্গুলী কথা বললেন নানা প্রসঙ্গে। স্মৃতিচারণ করলেন, বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টের। বললেন, অভিষেক টেস্টে বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে ৪০০ রান করেছিল। আমাদের জিততে কষ্ট হয়েছিল। পরে ছবি তোলার সময় আমি মনে করিয়ে দিলাম, বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট ছিল অধিনায়ক হিসেবে গাঙ্গুলীরও অভিষেক। একটু কি স্মৃতিকাতর হলেন গাঙ্গুলী? বাংলাদেশের ক্রিকেটের অকৃত্রিম বন্ধু সৌরভ। সেদিনের সাক্ষাৎকারেও বলতে ভোলেননি- ‘ঢাকায় গেলে মনে হয় কলকাতাতেই আছি।’ বাংলাদেশের দর্শকদের জন্যও তাঁর কণ্ঠে গভীর মমতা। বললেন, আশা করি তাদের জন্য (বাংলাদেশের দর্শক) তাদের দল আরও ভালো খেলবে।

কলকাতারই এক ক্রিকেট সংগঠন জগমোহন ডালমিয়ার ক্রিকেট কূটনীতির সুবাদে ২০০০ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়েছিল বাংলাদেশ। অভিষেক টেস্টে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ছিল ভারত। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো টেস্টে টস করতে নেমেছিলেন দুই বাঙালি- বাংলাদেশের নাইমুর রহমান দুর্জয় এবং ভারতের সৌরভ গাঙ্গুলী। কিন্তু ফিরতি সফরের জন্য বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯ বছর। ডালমিয়ার মতো বাংলাদেশের বন্ধু যেমন আইসিসিতে ছিলেন, তেমনি ছিলেন শ্রীনিবাসনের মতো বিদ্বেষীরাও। এই শ্রীনিবাসনদের কারণে মাঝে বাংলাদেশ-ভারত ক্রিকেট সম্পর্কে বিদ্বেষের অনেক বিষ জমেছে। গাঙ্গুলীর মতো বাংলাদেশের একজন সত্যিকারের বন্ধু এখন ভারতের ক্রিকেট কর্তা। আশা করি, গাঙ্গুলীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ-ভারত ক্রিকেট সম্পর্কের বিষটুকু উবে যাবে, ফিরবে সুস্থ প্রতিযোগিতার ধারায়। এমনিতে অনেক আগেই প্রতিযোগিতার বিবেচনায় ভারত-পাকিস্তান লড়াইয়ের জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ-ভারত লড়াই।

বিজ্ঞাপন

গাঙ্গুলী খেলা ছেড়েছেন প্রায় এক যুগ আগে। কিন্তু এখনও ডাউন দ্যা উইকেট গিয়ে তাঁর ছক্কা মারার স্মৃতি ভোলেনি দর্শকরা। শুধু খেলা নয়, দাঁতে নখ কামড়ানো, চোখ পিটপিট করা, চিন্তা করার সময় ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরা- সেই সব মুদ্রাদোষ হারিয়ে যায়নি এখনও। সেই চেনা গাঙ্গুলীই, কলকাতার দাদা এখন ভারতীয় ক্রিকেটের মহারাজা।

লেখক: বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ

সারাবাংলা/পিটিএম

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন