বিজ্ঞাপন

দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা: কৃষির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ৬ কৌশল

December 10, 2019 | 11:18 pm

জোসনা জামান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিণত করার লক্ষ্য পূরণে জনমানুষের পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এজন্য টেকসই কৃষি খাত গড়তে ছয় কৌশল গ্রহণ করা হবে। ‘দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা: ২০২১-২০৪১’-এর আওতায় এসব কৌশল বাস্তবায়ন করা হবে। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) পরিকল্পনাটি তৈরি করছে। এরই মধ্যে পরিকল্পনার খসড়া দেখানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য শিগগিরই তা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় উপস্থাপন করা হবে।

বিজ্ঞাপন

দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় কৃষি খাতের জন্য যে ছয়টি কৌশলের আওতায় বৈরী কৃষি পরিবেশগত ব্যবস্থাকে উৎপাদনশীল টেকসই কৃষি পদ্ধতির নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হবে। মাটির গুণের স্থায়িত্ব বজায় রেখে উৎপাদনশীল কৃষি জমিতে শস্য চাষাবাদের নিবিড়ায়ন করা হবে। নতুন জমি চাষের আওতায় না এনেও টেকসই উপায়ে নিবিড় কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে শস্য ও প্রাণিসম্পদ উৎপাদন ব্যবস্থার সহিষ্ণুতাও বাড়ানো হবে।

এছাড়া কৃষিজ উৎপাদন ও জীবিকার বহুমুখীকরণ এবং আরও বেশি সংখ্যক শস্যজাত বা প্রাণিজাতসহ খামার বহির্ভূত কার্যক্রম ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোর জন্য উদ্যোগ নেবে সরকার। এর সঙ্গে সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় অভিযোজনের বিস্তার ও বৈশিষ্ট্য সংশ্লিষ্ট অনিশ্চয়তার ফলে সৃষ্ট উন্নয়ন প্রতিক্রিয়ার অনিশ্চয়তার সঙ্গেও মানিয়ে চলার ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে।

পরিকল্পনাটি তৈরির দায়িত্বে ছিলেন জিইডির সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। আমাদের কৃষি অবকাঠামো দীর্ঘ দিনের। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে কৃষিতে। বর্তমান সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সহিষ্ণু কৃষি ব্যবস্থা প্রয়োজন। এর সঙ্গে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার বিষয়টিও নির্ভরশীল। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির সঙ্গে মানিয়ে নিতে কিছু বাড়তি উদ্যোগ প্রয়োজন। এ কারণেই ছয়টি কৌশলগত কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করা হবে।

বিজ্ঞাপন

তবে টেকসই কৃষি নিশ্চিত করতে ছয় কৌশলেই সরকারের উদ্যোগ থেমে থাকবে না। ড. শামসুল আলম বলেন, ভবিষ্যতে সরাসরি পণ্য ও সেবা দিয়ে স্থানীয় অভিযোজন দক্ষতা শক্তিশালী করতে হবে। যেমন— জলবায়ু সংশ্লিষ্ট উন্নততর তথ্য ব্যবস্থাপনা, জলবায়ু উপযোগী উৎপাদন প্রযুক্তিসহ তাপসহিষ্ণু ও লবণাক্ততাসহিষ্ণু শস্যজাত উদ্ভাবনের জন্য গবেষণা, দক্ষ পানিসঞ্চয়ী সেচ প্রযুক্তির ব্যবহার এবং আগাম আবহাওয়াবার্তা পূর্বাভাস ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। পরিবর্তনশীল জলবায়ুর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সংরক্ষণ কৃষি, সমন্বিত উদ্ভিদ পুষ্টি ব্যবস্থাপনা, সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মতো উত্তম চাষ পদ্ধতি গ্রহণ করে সুসংহত খামার ব্যবস্থা অনুসরণ করা হবে।

দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনার খসড়ায় বলা হয়েছে, কৃষি (মৎস্য ও প্রাণিসম্পদসহ) এবং গ্রামীণ অ-কৃষি কার্যক্রম দারিদ্র্য নিরসনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তারকারী অর্থনৈতিক খাতগুলোর অন্যতম। অর্থনীতির উন্নয়ন ধারায় কাঠামোগত পরিবর্তনের বাস্তব ধারাবাহিকতার সঙ্গে মিল রেখে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ক্রমশ নিম্নগামী। ১৯৭০-এর দশকের প্রায় ৬০ শতাংশ থেকে ২০১৮ অর্থবছরে এই অবদানের পরিমাণ মাত্র ১৪ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। তবে স্বাধীনতা উত্তরকালের প্রথমে দুই দশকে গড় বার্ষিক কৃষি প্রবৃদ্ধি ছিল ২ শতাংশের নিচে। অথচ ২০০১-২০১৮ সময় পরিধিতে বার্ষিক গড় ৩ দশমিক ৯ শতাংশ হারে কৃষি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়, যা জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে গেছে।

খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, একসময় বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল খাদ্য ঘাটতির দেশ হিসেবে। সাধারণ মানুষের মুখে দু’বেলা খাবার দিতেও বাইরে থেকে আসা খাদ্য সহায়তার ওপর নির্ভর করতে হতো। পরবর্তী সময়ে সরকারের কার্যকর নীতিমালা আর কৃষক সমাজের অক্লান্ত পরিশ্রম দেশের কৃষি পরিস্থিতিতে সম্পূর্ণ পাল্টে ফেলে। উচ্চ ফলনশীল ধান জাতের ব্যাপক চাষাবাদ, সেচযুক্ত বোরো ধানের চাষ ও রাসায়নিক সারের ব্যবহারে দেশে সবুজ বিপ্লব সংঘটিত হয়। এর ফলে দেশের দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতেও সমর্থ হয় দেশের কৃষি খাত।

বিজ্ঞাপন

বিভিন্ন পরিসংখ্যান তুলে ধরে খসড়ায় বলা হয়েছে, দেশে চালের উৎপাদন ১৯৭০-এর দশকের ১০ মিলিয়ন মেট্রিক টন থেকে প্রায় চার গুণ বেড়ে ২০১৮ সালে ৩৭ মিলিয়ন মেট্রিক ট্রনে উন্নীত হয়েছে। এর সঙ্গে আলু, ভুট্টা, গম, সবজি, ফলমূলের মতো ধান বহির্ভূত শস্য, মাছ ও পোল্ট্রি পণ্যের উৎপাদনও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। এর ফলে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত ও চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পথে দেশ অনেকটাই এগিয়েছে। পাশাপাশি খামার ও খামারিদের আয় বেড়ে যাওয়ায় কৃষি মজুরি বেড়েছে, যা গ্রামীণ দারিদ্র্য নিরসনেও অবদান রেখেছে।

এদিকে, দেশের সবচেয়ে উৎপাদনশীল ও গতিশীল খাতগুলোর মধ্যে মৎস্য খাত অন্যতম। সরকারও এই খাতে গুরুত্ব দিয়ে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিতে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার ২০১৮ সালের এক একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, উন্মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য আহরণে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়।

প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, দেশের কৃষিতে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে মৌলিক রূপান্তর ঘটে চলেছে। এই সময়ে মানুষের আয় যেমন বেড়েছে, তেমনি খাদ্য চাহিদার কাঠামোতেও পরিবর্তন এসেছে। এই যাত্রা আগামী আরও তিন দশক অব্যাহত থাকবে। পরিবর্তিত প্রবণতায় মানুষ উন্নত পুষ্টিমানসম্পন্ন খাবারের দিকে ঝুঁকছে। মাথাপিছু চালের ব্যবহার কমার পাশাপাশি শাকসবজি, ফলমূল, ডাল ও ভোজ্যতেল ছাড়াও মাংস, মাছ, ডিম ও দুধের মতো পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণের হার বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলের জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই প্রবণতা বেশি।

দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় কৃষি খাতের কৌশলপত্রে বলা হয়েছে, ধান থেকে ধান বহির্ভূত শস্যের বর্ধিত উৎপাদনকে বহুমুখী করে পরিবর্তিত খাদ্য চাহিদার জোগান দিচ্ছে। মৎস্য, প্রাণিসম্পদ ও উদ্যানশস্যের মতো অ-শস্য কৃষির প্রবৃদ্ধি শস্য কৃষির প্রবৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে গেছে। এই প্রবৃদ্ধির আরও বিস্তৃতি ঘটানো প্রয়োজন, একইসঙ্গে প্রয়োজন পণ্যের গুণগত উৎকর্ষ বজায় রাখা। ফলে কৃষিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে। ধান বহির্ভূত উচ্চমূল্য ফসল বিন্যাসসহ মূল্য সংযোজিত পণ্য, উদ্যানভিত্তিক ডালজাতীয় শস্য ও তেলবীজ চাষের যেমন প্রসার ঘটাতে হবে, তেমনি প্রাণিসম্পদ ও মৎস্যসম্পদের মতো দ্রুত বিকাশমান অংশ দুইটিতেও প্রবৃদ্ধির ধারা ধরে রেখে বিস্তৃতি ঘটাতে হবে।

বিজ্ঞাপন

এর বাইরে পানিসম্পদের ক্ষেত্রে পানি সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় বিদ্যমান উত্তম পদ্ধতিগুলো উন্নততর করাসহ আরও ব্যাপকভাবে সুসংহত পানি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার ওপর অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে প্রেক্ষিতের অধীন কৌশলে। এই সুসংহত পানি ব্যবস্থাপনায় অন্তর্ভুক্ত থাকবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিবারণ কার্যক্রম, বন্যা বিষয়ে আগাম সতর্ক ব্যবস্থা, সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সেচ চাহিদার ব্যবস্থাপনা। এছাড়া বন খাতে অগ্রাধিকার দিয়ে পুনঃবনায়ন ও বনায়নের জন্য কার্যকর সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব বাস্তবায়নের দিকেও জোর দেওয়া হবে।

২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার এরই মধ্যে ‘দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১’ বাস্তবায়নে মনোযোগী হয়েছে। শুধু তাই নয়, আগামী একশ বছরের দেশের অগ্রযাত্রার চিত্র মাথায় রেখে বদ্বীপ পরিকল্পনাও প্রণয়ন করা হয়েছে। টেকসই কৃষি গড়তে প্রেক্ষিত পরিকল্পনার কৌশলগুলোও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বদ্বীপ পরিকল্পনায়। তাতে কৌশলগুলোর পাশাপাশি আসছে দুই দশকে কৃষির বাণিজ্যীকরণকেও অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।

সারাবাংলা/জেজে/টিআর

Tags: , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন