বিজ্ঞাপন

ডিজিটাল বাংলাদেশ: অর্ধসত্যবাদী যুধিষ্ঠিরের নরক দর্শন

December 12, 2019 | 5:56 pm

রাজীব নন্দী

১২ ডিসেম্বর ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস-২০১৯’। ২০০৮ সালের দিকে আমি নিজেও অন্য দশজনের মতো তাচ্ছিল্যভরা ভঙ্গিমায় ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ শব্দ নিয়ে উপহাস করতাম। কত্ত বড় বেঈমানি, আজ সেই দেশের ডিজিটাল সেবার সুফলভোগীদের আমিও একজন! ভাবতেই অবাক লাগে, কী দারুণ এক বাংলাদেশে বাস করছি।

বিজ্ঞাপন

কতটুকু ডিজিটাল হলাম?- এই প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে হবে না। আপনার চারপাশের সব ‘ইলেকট্রনিক ডিভাইস’ কিছুদিনের জন্য দূরে রাখুন। দেখবেন, স্থবিরতা কাকে বলে! ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর দেশে প্রথমবারের মতো তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি দিবস পালিত হয়েছিল। গত বছর থেকে এই দিনটি ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। আমাদের যাদের গড় বয়স ৩২-৩৫ তাঁরা এই বাংলাদেশের যুগসন্ধিক্ষণের মানুষ। কারণ, আমরা জীবনের ১৫ বছর কাটিয়েছি অ্যানালগ বাংলাদেশে, আর বাকি ১৫ বছর কাটছে ডিজিটাল বাংলাদেশে! ফিফটি-ফিফটি? হ্যাঁ, আমরাই বুঝব, দুটোর মজা কী, যন্ত্রণা কী! যাদের বয়স আজ ২২-২৫ বছর তাঁরা কোনদিন বুঝবে না, অ্যানালগ থেকে একটি দেশ ডিজিটাল হওয়ার প্রসব যন্ত্রণা কী ভয়াবহ ছিল।

আজ থেকে প্রায় ১৫ বছর আগের কথা। ২০০৪ সালে ঢাকার মুক্তাাঙ্গন থেকে হেঁটে সাতদিনে খুলনার মংলা পর্যন্ত গিয়েছিলাম। হাঁটছিলাম আমরা প্রায় হাজার চারেক মানুষ। এরপর ঢাকা থেকে হেঁটে চট্টগ্রাম লংমার্চ হলো। তারও আগে-পরে ঢাকা থেকে সিলেট পায়ে হাঁটা লংমার্চ। ২০০৮ সালে দেশে জরুরি অবস্থা জারির দিন আমরা দুই বন্ধু উত্তরবঙ্গের পাঁচ জেলা ঘুরেছি। কখনও বাসে, আবার কখনও পায়ে হেঁটে। আরেকবার চট্টগ্রামের শহিদ মিনার থেকে বন্দর পর্যন্ত টানা চার ঘণ্টা পদযাত্রায় ছিলাম। অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় রাত ১১টায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে রেললাইন ধরে হাঁটা দিয়ে ভোরে এসে পৌঁছলাম শহরে। ২৩ মাইল ধরে ৬ জনের চিকা মারা টিমের সাথে হেঁটে হেঁটে পথে-পথে দেয়াল লিখন করা আর পুলিশ ও শিবিরের তাড়া খেয়ে দৌঁড়ে পালানো! বান্দরবানে তিনঘণ্টা হেঁটে পাহাড়ে চড়েছি। আমি হাঁফাচ্ছিলাম। কিন্তু আমার পাহাড়ি কমরেড দিব্যি স্বাভাবিক। ঢাকায় একবার নীলক্ষেত থেকে হেঁটে ঝুম বৃষ্টির মধ্যে খিলক্ষেত গিয়েছিলাম! বগুড়ায় কৃষক-ক্ষেতমজুরদের সমাবেশে চট্টগ্রাম থেকে গিয়ে পায়ে হেঁটে মিছিল করেছিলাম প্রায় পাঁচমাইল। তাও আবার কনকনে ঠাণ্ডার মধ্যে! ২০১৩ সালে রাজনৈতিক অবরোধের মুখে জেদ করে কয়েকজন ছাত্রের সাথে হেঁটে কাপ্তাই থেকে চট্টগ্রাম শহরে চলে এসেছিলাম প্রায়। এইভাবেই ছাত্রজীবনে নানা দূরত্বে ভ্রমণে, স্লোগানে, গানে, বক্তৃতায় পা মিলিয়েছিলাম বন্ধু, কমরেডদের সঙ্গে। রাজনৈতিক সংগ্রাম আর ভ্রমণের নেশা দুটি মিলে দুর্দান্ত এক ছাত্রজীবন ছিল আমাদের অনেকের। আর এখন? এখন রাজনীতি পাল্টে গেছে, হাঁটার গতি বদলে গেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ আমাদের আরাম এনে দিয়েছে। আর ব্যারাম বাড়িয়ে দিয়েছে। ঘরের বাইরে দু’পা দিতেই ক্লান্ত হয়ে যাই। ঘরে বসে বসে মোবাইলকে বলি, ‘ওভাই’, আমার জন্য একটা ‘উবার’ ‘পাঠাও’ তো, ‘সহজ’ হয়ে যায়!

অতীতের সকল স্থবিতা কাটিয়ে আমরা এখন দারুণ একটি গতিশীল বাংলাদেশ তথা ডিজিটাল বাংলাদেশে প্রবেশ করেছি। সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনী প্রচারে গুণগত পরিবর্তন বেশ চোখে পড়েছে। অবশ্য পরিবর্তন না বলে একে বলা দরকার অনিবার্যতা। সেটা হলো- ডিজিটাল প্রচার। ভোটের মাঠে শুধু ডিজিটাল প্রচারই নয়, যোগাযোগবিদ্যার ভাষায় আমরা দেখেছি- ‘বহুমাধ্যমাশ্রিত বৈদ্যুতিন জনপ্রিয় রাজনৈতিক যোগাযোগ।’ বাংলাদেশ যেহেতু সনাতনী সমাজ থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে প্রাযুক্তিক সমাজে পা দিয়েছে, ফলে একে বলা যেতে পারে মাল্টিমিডিয়া পলিটিক্যাল কমিউনেকশন ইন ডিজিটাল ইলেকশন। এইরকম একটি উত্থানপর্বে আসুন, সবাই সতর্ক হই। ফেক নিউজ ও গুজবকে যেন দমন করতে পারি। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেছেন, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে আমাদের যত অর্জন, সবকিছুকে কিন্তু ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি। অর্থাৎ গুজব প্রতিরোধই এখন আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ। এজন্য জনগণকে সচেতন করতে না পারাই এখন আমাদের প্রধান বাধা। ফলে আমরা অনলাইন সিকিউরিটি অ্যাওয়ারনেস বাড়ানোর চেষ্টা করছি। সোশ্যাল মিডিয়া সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করতে হবে।’

বিজ্ঞাপন

আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশে গুজব প্রতিরোধই সরকারের এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ। তাই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘সত্য-মিথ্যা যাচাই আগে, ইন্টারনেটে শেয়ার পরে।’ শুধু বাংলাদেশ নয়, পাশ্ববর্তী ভারতসহ পুরো বিশ্ব আজ গুজব ও ফেক নিউজের খপ্পরে চিহ্নিত করা হচ্ছে ডিজিটাল সিস্টেমে কিভাবে ফেক নিউজ ইঁদুর ঢুকে তছনছ করে দেয় বিশ্বাসের পাটাতন!

মহাভারত মিথোলজির প্রথম দিকে অদ্ভুত দুই সাংবাদিক পাই আমরা। একজন নারদ; ধ্বনিচিত্র সম্প্রচারক (অডিওভিডিও টেলিকাস্টার), অপরজন সঞ্জয়; সরাসরি সম্প্রচারক (লাইভ টেলিকাস্টার)। স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল জুড়ে যে বিশেষ প্রতিনিধি খবর সংগ্রহ ও পরিবেশন করতেন তিনি নারদ! হিন্দিতে ‘নারাহ’ মানে স্লোগান, সেই অর্থে নারা+দ= নারদ। ‘দ’ মানে ‘যে দেয়’। অর্থাৎ, যিনি স্লোগান দেন বা ধ্বনি দেন। তাই নারদ হলেন মিথোলজির ইতিহাসে প্রথম ধ্বনিচিত্রের সম্প্রচারক! এদিকে হস্তিনাপুরে বসে সুদূর কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সরাসরি বর্ণনা দিয়েছিলেন সঞ্জয়। অন্ধ মহারাজা ধৃতরাষ্ট্রের অনুচর সঞ্জয়। সঞ্জয়ের কাজ ছিল রাজসভায় বসে চোখ বন্ধ করে প্রতিদিন যুদ্ধের লাইভ আপডেট দেওয়া। সঞ্জয় হুবহু পক্ষপাতহীন বর্ণনা দিয়েছিলেন যুদ্ধের। তাই গীতায় শ্লোকে শ্লোকে বলা আছে ‘সঞ্জয় উবাচ’। সেই হিসেবে সঞ্জয় ইতিহাসের প্রথম সরাসরি সম্প্রচারক।

সংবাদ প্রচারে ভুল হলে নারদ ‘ক্ষমা’ চাইতেন। নারদ দেবতাদের পক্ষ নিতে গিয়ে সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতাও হারাতেন মাঝে মধ্যে। তবে সঞ্জয় ক্লান্তিহীনভাবে অপ্রিয় যুদ্ধবৃত্তান্ত রাজাকে শুনিয়েছেন। বিভিন্ন সময় নারদ আর সঞ্জয় বারবার অসুর আর ধৃতরাষ্ট্রকে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু তারা কানে নেননি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে অসুরদের, ধ্বংস হয়েছে ধৃতরাষ্ট্রের গুষ্টি। মহাভারত তথা মিথোলজি পাঠের প্রাসঙ্গিকতা এখানেই যে, আজকের বাংলাদেশের ‘দেবতা’ বা ‘অসুর’ কেউই গণমাধ্যমের সমালোচনায় সতর্ক হচ্ছেন না। গণমাধ্যম (নারদ বা সঞ্জয়) উপেক্ষিত! ফলে যা হওয়ার হবে! গুষ্টিনাশ, ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত, রাজ্যনাশ ও বংশনাশ। অন্ধ রাজা বিলাপ করবে, হায় শতপুত্র, হায় শতপুত্র বলে বলে…!

বিজ্ঞাপন

মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে পাণ্ডবদের লড়াইয়ের মাত্রা সর্বোচ্চ বাড়ানোর পরও কোনোভাবেই কৌরবদের হারানো যাচ্ছে না। অথচ পাণ্ডব পক্ষে রয়েছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ! এই অবস্থায় পাণ্ডবদের মধ্যে অর্জুন (যে ওস্তাদ শ্রীকৃষ্ণের কাছে ‘হে মাধব হে মাধব রক্ষা করো’ বলে ভ্যাঁ করে কেঁদে দেওয়া ছাড়া কিছু করতে পারেনি) বেশি ভেঙে পড়েছে। কারণ, প্রতিপক্ষ দ্রোণাচার্যকে বধ না করলে যুদ্ধ শেষ হবে না। দ্রোণাচার্য অবধ্য। কেবল তিনি নিজেই প্রাণত্যাগ না করলে কেউ তাঁকে সংহার করতে পারবে না। সেই দ্রোণাচার্য প্রবলবেগে পাণ্ডবদের সংহার করে চলছেন। যুদ্ধের অবস্থা ভয়াবহ। এখন উপায়? যথারীতি অর্জুনের কান্নাকাটি! শ্রীকৃষ্ণ মুখ খুললেন তার দুষ্ট ফন্দি নিয়ে। স্মরণ করিয়ে দিলেন, দ্রোণাচার্যের নিজের চেয়েও প্রিয় তাঁর সন্তান অশ্বত্থামা, যে অমরত্ব লাভ করেছে। অশ্বত্থামা ছিলেন দ্রোণের দুর্বলতা ও অহংকার। কৃষ্ণ সমবেত পাণ্ডবদের বললেন, অশ্বত্থামাকে মারতে না পার? অশ্বত্থামা নামক হাতিকে মেরে ‘সত্যবাদী যুধিষ্ঠির’ যদি দ্রোণাচার্যকে গিয়ে বলেন ‘হ্যাঁ, অশ্বত্থামা মারা গেছে’। তখনই কেবল দ্রোণাচার্য বিশ্বাস করবেন এবং প্রিয় পুত্র নিহত হওয়ার সংবাদে তিনি এই সংসারের মায়া ত্যাগ করবেন।

কৃষ্ণের ছলনায় সবাই সাড়া দিলেন। প্রবল পরাক্রমশালী ভীম কুরুক্ষেত্রে অশ্বত্থামা হাতিকে বধ করলেন। অর্জুন সেই সংবাদ নিয়ে গেলেন দ্রোণাচার্যের কাছে। সংশয়ী দ্রোণাচার্য ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞেস করলেন ‘বৎস, তুমি তো কভু মিথ্যা বলো না, তুমি ধর্মের পুত্র। সত্য তোমার অহংকার। তুমি বলো- আমার পুত্র অশ্বত্থামা কি সত্যিই নিহত?’

অনুতাপ, লজ্জা আর গ্লানিভরা মুখে অস্ফুট স্বরে ধর্মপুত্র যুধিষ্টির সত্য/মিথ্যার ধোঁয়াশার জটাজালে অর্ধসত্য বললেন- ‘অশ্বত্থামা হত’ কিন্তু পাপমুক্তির বাসনায় খুব ছোট করে উচ্চারণ করলেন ‘ইতি কুঞ্জর’। অর্থাৎ, ‘অশ্বত্থামা মারা গেছে, তবে হাতি’। দ্রোণাচার্য কিন্তু ‘ইতি কুঞ্জর’ শুনতে পেলেন না। প্রিয় পুত্রের মৃত্যুসংবাদ বিশ্বাস করে স্বেচ্ছায় প্রাণবায়ু বের করে দিলেন। মহাভারত মিথোলজির বুকে রচিত হলো প্রথম ফেক নিউজ!

যাকে বলা হতো- ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির, ধর্মে-কর্মে মতিস্থির, সেই যুধিষ্ঠির প্রথম এবং শেষবারের মতো মিথ্যা কথা বলে পাণ্ডবদের যুদ্ধজয় সহজ করে নিল। তবে অস্ফুট স্বরে ছোট মিথ্যা কথা বলার দায়মুক্তি পেলেন না যুধিষ্ঠির। তাঁকেও ভাগ্যবিড়ম্বিত হয়ে নরক দর্শন করতে হয়। ধর্ম-অধর্মের চিরন্তন লড়াইয়ে অধর্ম কীভাবে ধর্মের উপর আধিপত্য লাভ করার স্পর্ধা দেখায় মহাভারত। আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশেও স্মরণে রাখতে হবে মহাভারতের এই ঘটনা। যতবড় যুধিষ্ঠিরই হোক না কেন, ফেক নিউজ এবং গুজব ছড়ালেই কঠোর ব্যবস্থা যেন থাকে।

বিজ্ঞাপন

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/পিটিএম

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন