বিজ্ঞাপন

কেউ যেন ভুল করে গেও নাকো মন ভাঙা গান…

December 14, 2019 | 12:00 am

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: এখানে যেন বাতাস জমে গেছে। এখানে যেন সময় থেমে গেছে। এখানে বাংলাদেশ ও বাঙালি অস্তিত্বের ইতিহাস হাতে দাঁড়িয়ে আছে মহাকাল।

বিজ্ঞাপন

রাজধানী ঢাকার আগারগাঁও এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের চতুর্থ গ্যালারিতে ঢুকলেই চোখ চলে যায় শেষ মাথায়। এখানে রাখা আছে আমাদের জয়। এখানে রাখা আছে আমাদের মূল্যবোধ। এখানে আছে আমাদের সূর্য সন্তানদের স্মৃতিচিহ্ন।

একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর আলবদর ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা যাদের হত্যা করে বাঙালিকে মেধাশূন্য জাতিতে পরিণত করতে চেয়েছিল।

জাদুঘরের চারটির মধ্যে ‘আমাদের জয়, আমাদের মূল্যবোধ’ গ্যালারি তাই বেশ খানিকটা আলাদা। গাঢ় অন্ধকার আজও এক কালো অধ্যায়ের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখানে। এই আঁধার আমাদের যুক্ত করে চৈতন্যের সুতায়।

বিজ্ঞাপন

গ্যালারির দরজায় দাঁড়ালেই দেখা যাবে দেয়ালে টানানো অনেকগুলো ছবি। তার ওপর স্পট লাইট। কিছুটা এগিয়ে গেলে প্রথমেই যে ব্যক্তির মুখটি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, তাঁর নাম সিরাজুদ্দীন হোসেন। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, আলবদর ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে শান্তিনগরের চামেলীবাগের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর তাঁর আর কোনো সন্ধান মেলেনি। এখানে দেখা যাবে স্বজনের সঙ্গে তাঁর ছবি। তাঁর লেখা গ্রন্থ ‘ইতিহাস কথা কও’।

এরপর রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদের ছবি ও সংক্ষিপ্ত জীবনী।

দেশভাগের পর ১৯৪৯ সালে পাকিস্তানের আসেন রাশেদুল হাসান। ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন এবং ১৯৬৭ সালে একই বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর সকালে আলবদররা তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাস থেকে ধরে নিয়ে যায়। পরে মিরপুর বধ্যভূমিতে তাঁর ক্ষত-বিক্ষত মরদেহ শনাক্ত করেন রাশেদুল হাসানের সহকর্মীরা।

বিজ্ঞাপন

শেষ পর্যন্ত অনেকের মৃত্যুর তারিখই জানা যায়নি। পাওয়া যায়নি মরদেহ পর্যন্ত। থেকে গেছে কেবল অন্তর্ধান দিবস। পালন হয়নি মৃত্যুবার্ষিকী। সিরাজুদ্দীন হোসেনের মতো তেমনই একজন ড. আমিন উদ্দিন। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) এই কর্মকর্তাকে ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। পরে তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।

অনেক পরে রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে অনেক বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে পাওয়া যায় ডা. আলীম চৌধুরীর মরদেহ। ১৯৫৫ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি সম্পন্ন করেন আলীম চৌধুরী। ১৯৬৩ সালে তিনি মির্জাপুরের কুমুদিনি হাসপাতালে প্রধান চক্ষুবিশেষজ্ঞ হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৮ সালে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ফিরে আসেন। বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন তিনি। তাঁর ব্যবহৃত একটি ডায়েরিও দেখতে পাবেন দর্শনার্থীরা।

ষাটের দশকের উল্লেখযোগ্য কবি ছিলেন সেলিনা পারভীন। তাঁর আরও পরিচয় রয়েছে। একাধারে তিনি ছিলেন সাংবাদিক, শিক্ষক এবং সেবিকা। ১৯৬৯’এ সেলিনা পারভীন সাপ্তাহিক বেগম, সাপ্তাহিক ললনাতে সাংবাদিকতা শুরু করেন। এরপর তিনি সাহিত্য সাময়িকী শিলালিপি প্রকাশ করেন। আরও এক দশক আগে ১৯৫৬ সালে নার্সিংয়ে প্রশিক্ষণ নেন তিনি। ১৫৫৯ সালে মেট্রন হিসেবে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে যোগ দেন। পরের বছর শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন আজিমপুর শিশু আলয়ে।

পাকিস্তানি বাহিনী ১৩ ডিসেম্বর তাঁকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। পরদিন তাকে রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়। ১৮ ডিসেম্বর তাঁকে আজিমপুর কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।

বিজ্ঞাপন

গ্যালারিতে সাঁটানো রয়েছে বাংলাদেশের নারীদের ওপর পাকিস্তানিদের নির্মম অত্যাচারের বীভৎস চিত্র। হানাদার বাহিনীর বিকৃত মানসিকতার প্রকাশ— অশ্লীল দেয়ালচিত্র।

আরও রয়েছে চারজোড়া চোখ। যে চোখের দিকে তাকানোর জন্য দরকার বিপুল সাহস। ১৭ আগস্ট কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুরে হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। সেখান থেকে চারজন কিশোরীকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এদের একজন গৌরী রানী কারিগর। তিনি আর ফিরে আসেননি।

হবিগঞ্জের কাগপাশা গ্রামের আঙ্গুরা খাতুনকে রাজাকারদের সহায়তায় ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। শারীরিক নির্যাতনে ক্যাম্পেই তাঁর মৃত্যু হয়। আলোকচিত্রী আহমেদ টিপুর ক্যামের উঠে আসে আরও একজোড়া চোখ। মাদারীপুরে পাকিস্তানিদের নির্যতনের ২১ বছর বয়সী ওই তরুণীর মৃত্যু হয়।

এসব ছবিতে নির্যাতিত নারীদের মুখচ্ছবি নয়, উঠে এসেছে অপরিসীম যন্ত্রণা। এসব সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড হয়েছিল পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলীর নেতৃত্বে। তার অধীনে কাজ করে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র নেতারা। রাও ফরমান আলীর অফিস কক্ষে পাওয়া যায় একটি চিরকুট। তাতে হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।

আমাদের জয়, আমাদের মূল্যবোধ গ্যালারিতে আরও রয়েছে চিথলিয়া রেলওয়ে স্টেশনের যুদ্ধের চিত্র। প্রদর্শনীতে রাখা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত অস্ত্র।

শুক্রবার (১৩ ডিসেম্বর) সকাল থেকেই ছিল দর্শনার্থীদের আনাগোনা। ঠিক দুপুরের পরপর পরিবার নিয়ে চতুর্থ গ্যালারিতে আসেন মোমিনুল হক। সঙ্গে তার স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে। ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তিনি। থাকেন মিরপুর কালশী এলাকায়।

মোমিনুল বললেন, শুক্রবার-শনিবার দু’দিন ছুটি পাই। সপ্তাহে এই দুইদিন বাচ্চাদের সঙ্গে কাটানোর চেষ্টা করি। ওরা চায় বেড়াতে যেতে। আমিও বারবার ওদের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে নিয়ে আসি। যেন ওরা এটা জেনে বড় হয়— কিসের বিনিময়ে আমরা এ দেশ পেয়েছি। সন্তানদের নিয়ে এটা আমার স্বপ্ন। ওরা যেন শেকড় ভুলে না যায়। আমার নিজের জন্য একটা স্বপ্ন আছে, আমি যেন পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেখে যেতে পারি।

তিনি বলেন, আমার কান্না আসে না। তবে যতবার এখানে আসি, আমার চোখ ছলছল করে ওঠে। বেশি ভালো লাগে এটা দেখে, আমার সন্তানরা প্রতিবার খুব আগ্রহ নিয়ে ছবি এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্নগুলো দেখে। ওরা হয়তো এখনো কিছুই বোঝে না, বড় হলে নিশ্চয়ই বুঝবে।

আমার বিশ্বাস, আমার সন্তানদের দেখে শহীদদের আত্মাও শান্তি পাবেন— মোমিনুল।

প্রতি বছরের মতো এবারো জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণ করার উদ্যোগ নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে বিকেল ৪টায় জাদুঘর প্রাঙ্গণে পরিবেশিত হবে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রচনা থেকে পাঠ। পাঠ করবেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। দলীয় আবৃত্তি পরিবেশন করবে স্রোত আবৃত্তি সংসদ। সঙ্গীত পরিবেশ করবে সারগাম একাডেমি, রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ, অভ্যুদয় সংগীত অঙ্গন এবং ছায়ানট।

একই সময় মিরপুরে জল্লাদখানায় আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। শহীদদের সন্তানরা স্মৃতিচারণ করবেন। পরিবেশিত হবে সঙ্গীতানুষ্ঠান এবং নাটক।

সারাবাংলা/এটি/এমও

Tags:

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন