বিজ্ঞাপন

মুক্তিযুদ্ধ, জহির রায়হান ও আমাদের দায়

December 15, 2019 | 5:50 pm

বিধান রিবেরু

উদ্ধৃতি দিয়েই শুরু করি। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও স্বপ্ন নিয়ে সেখানে বলা হচ্ছে, “বাংলাদেশ এখন প্রতিটি বাঙালীর প্রাণ। বাংলাদেশে তারা পাকিস্তানের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতে দেবে না। সেখানে তারা গড়ে তুলবে এক শোষণহীন সমাজব্যবস্থা, সেখানে মানুষ প্রাণভরে হাসতে পারবে, সুখে-শান্তিতে থাকতে পারবে। বাঙলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধভাবে লড়ছে। লড়ছে সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত এক পেশাদার বাহিনীর সঙ্গে। লড়ছে, মৃত্যুকে তুচ্ছ করে জীবনকে অর্জন করার জন্য। বাঙলার মানুষের এই মুক্তির লড়াই পশ্চিম পাকিস্তানের নিপীড়িত অঞ্চলের মেহনতি মানুষকেও শোষণমুক্ত হবার প্রেরণা যোগাবে।”

বিজ্ঞাপন

১৯৭১ সালের জুলাই মাসে কলকাতার ‘পরিচয়’ নামের সাহিত্য পত্রিকায় এই কথাগুলো বলেন জহির রায়হান। লেখার শিরোনাম ছিলো ‘পাকিস্তান থেকে বাঙলাদেশ’। লড়াই সংগ্রামের ভেতর দিয়ে দেশের মানুষকে শোষণমুক্ত করার যে স্বপ্ন জহির রায়হান দেখেছিলেন, তা আজ নির্বাসিত। এমনকি তিনি যে মাধ্যমকে হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন, চলচ্চিত্র, সেটার ভবিষ্যৎও আজ নিভুনিভু শিখার মতো জ্বলছে বাংলাদেশে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের ব্যাপারে তো প্রযোজক ও বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ একেবারেই কম।

মুক্তিযুদ্ধের ছবি বানাতে হলে, সেখানে তো আর বাণিজ্যিক ছবির মশলা যুক্ত করা যায় না। যদি সেটা করা হয়, ‘বাঘা বাঙ্গালী’ বা ‘রক্তাক্ত বাংলা’র মতো, তাহলে সেটি সৎ চলচ্চিত্র থাকে না। ঘটনা হলো সত্য কাজে কম লোকই নারাজি, অসৎ কাজে টাকা ঢালতে অনেকে একেবারে এক পায়ে রাজি। তাই জহির রায়হান বলছেন, “ছবি বানাতে প্রথম যে জিনিসটার দরকার, সেটি হচ্ছে টাকা। অল্প নয় অনেক টাকা। আর টাকা যাদের আছে, তারা হচ্ছেন অসৎ ব্যক্তি। (কারণ, সৎপথে কোনদিনও ধনবান হওয়া যায় না।) এইসব অসৎ ব্যক্তি সৎছবি তৈরির জন্য টাকা খাটাতে চাইবেন না, এটা সহজ কথা। তারা সেখানেই চাইবেন, যেখানে দর্শকদের অসৎ বাসনাগুলো সুড়সুড়ি দিয়ে জাগিয়ে তুলে তার তাৎক্ষণিক তৃপ্তি সাধনের মাধ্যমে প্রচুর মুনাফা লোটা যায়।”
কথাগুলো শোনার পর নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগতে পারে সৎ চলচ্চিত্র বলতে তাহলে জহির রায়হান কি বুঝতেন? তিনি বলছেন, “সৎ ছবির প্রাথমিক যে শর্ত সেটা হচ্ছে ছবিটাকে সব রকমের সংকীর্ণতা ও গোঁড়ামিমুক্ত হতে হবে। বিষয়বস্তু এবং তার প্রকাশ, অভিব্যক্তি এবং তার ব্যঞ্জনায়, আবেগ এবং স্বতঃস্ফূর্ততায়, বক্তব্য এবং তার নির্ভীকতায় কোন রকম বিরোধ থাকলে চলবে না। কিন্তু কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মান্ধ সমাজে মুক্তবুদ্ধির চাষ করতে গেলেই বিরোধ ও বাধা স্বাভাবিক।”

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সমাজকে শোষণহীন শুধু নয়, বাংলাদেশকে কূপমণ্ডুকতা থেকে মুক্ত করার স্বপ্নও দেখতেন জহির রায়হান। আর এজন্যই আলমগীর কবির, বাবুল চৌধুরী, সৈয়দ হাসান ইমাম প্রমুখদের নিয়ে একাত্তর সালে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। তাঁর করা ‘স্টপ জেনোসাইড’ ও ‘আ স্টেট ইজ বর্ন’ দুটি প্রামাণ্যচিত্রের কথা সকলেরই জানা। গেরিলা কায়দায় তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করে ছবি তোলার কাজ করেছেন। প্রথম দলিলচিত্রটি গণহত্যা বন্ধের দাবিতে সতর্কবাণী, যা তৎক্ষণাৎ সমাদৃত হয়েছিল। আর দ্বিতীয়টিতে উঠে এসেছে আবহমানকাল থেকে বাংলার শান্তিপ্রিয় মানুষের উপর কিভাবে ইতিহাসের নানা পর্যায়ে বিপর্যয় নেমে এসেছে তার খতিয়ান। প্রথমটি তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ, দ্বিতীয়টি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস। জহির রায়হানের এই চালচ্চৈত্রিক লড়াইয়ের শুরু পাকিস্তানি উপনিবেশের বিরোধিতার মধ্য দিয়েই। এটার জন্য তাঁর রাজনৈতিক প্রস্তুতি ছিল।

বিজ্ঞাপন

যুদ্ধ শুরুর আগে রায়হান নির্মিত ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছিল স্বাধীকার আন্দোলনের রূপকচিত্র। তারও আগে ‘বেহুলা’ ছিল ঔপনিবেশিক পরিপ্রেক্ষিতে নির্মিত শ্রেণিদ্বন্দ্বের আলোকে নির্মিত লোকচিত্র। একটি ভূখণ্ডের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সাথে মিলিয়ে এমন রাজনীতি সচেতন পরিচালকের দেখা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে খুব একটা চোখে পড়ে না। তানভীর মোকাম্মেল ও তারেক মাসুদের কথা অবশ্য আলাদা করে বলতে হয়। এমন দুয়েকজন বাদে প্রকৃত অর্থে জহির রায়হানই বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্র নির্মাণে একলা হাতে ভূমিকা রেখে চলেছিলেন। কিন্তু সেটা বাংলাদেশের ভেতর জাতীয় চেতনার মুখোশধারীদের সহ্য হয়নি, তাদের ভয় ছিল জহির রায়হান তাদের মুখোশ খুলে দিতে পারেন। তাই তাকে কতল করতে হয়েছিল।

স্বাধীনতার পর আরো অনেকেই মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে প্রামাণ্যচিত্র ও কাহিনীচিত্র নির্মাণ করেছেন। বলা বাহুল্য নয়, চাষী নজরুল ইসলাম, সুভাষ দত্ত ও খান আতাউর রহমানদের পর ধীরে ধীরে মুক্তির ছবিতে আবেগের তীব্রতা কমেছে, বরং বেড়েছে ভাবাবেগের বেনোজল, সেই জল দিয়ে প্রবেশ করেছে বাণিজ্যিক উপাদান, এমনকি শত্রুর সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবনাও। চলচ্চিত্র গবেষক মির্জা তারেকুল কাদের যেমনটা বলেন, “সার্বিক বিচারে বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শকে ভিত্তি করে যথার্থ শৈল্পিক চেতনাসম্পন্ন চলচ্চিত্র নির্মাণে এদেশের চলচ্চিত্রকাররা ব্যর্থ হয়েছেন। আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সত্যিকার চেতনা, আদর্শ ও বাস্তবতা নিয়ে নির্মিত হয়নি কালোত্তীর্ণ কোন ছবি। স্বাধীনতার ২১ বছর পরেও এমন একটি পূর্ণ দৈর্ঘ্য ছবি নির্মিত হয়নি; যা আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল হয়ে থাকতে পারে (একমাত্র ব্যতিক্রম জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ ও ‘স্টপ জেনোসাইড’)।”

বিজ্ঞাপন

বিজয় অর্জনের পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে, অথচ এখনো মির্জা তারেকুল কাদেরের কথাগুলোকে ফেলে দেয়া যাচ্ছে না। অর্থাৎ একমাত্র জহির রায়হানকে বাদ দিলে অন্যদের কাজকে অতোটা উজ্জ্বল বলে মনে হয় না। এর একটি বড় কারণ হলো মুক্তিযুদ্ধকে বিষয় হিসেবে বেছে নিলে সামাজিক মান-মর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং সরকার থেকে অনুদান পাওয়া যায়, এমন মনোভঙ্গি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে, ঋত্বিক ঘটক যেমন করে দেশভাগের বেদনাকে ধারণ করেছিলেন, সেভাবে কেউ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ছবি বানাতে আর আসেন না। তাই নির্মাণ দেখলেই বোঝা যায় কি অবহেলায় তৈরি হয় মহান মুক্তিযুদ্ধের কাহিনীচিত্র।

জহির রায়হানের ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা আলমগীর কবির অবশ্য মনে করতেন মুক্তিযুদ্ধকে সার্বিকভাবে না বোঝার কারণেই মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের এমন দুর্দশা। মানে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা সেখানে উপেক্ষিত থাকে, বিষয় হয়ে দাঁড়ায় নারী ধর্ষণ ও বীরাঙ্গনা এবং তাতে থাকে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য। সত্তর দশকের কয়েকটি ছবি নিয়ে কবির বলেন, “যেসব নির্মাতা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ছবি করতে এগিয়ে এসেছিলেন তাঁদের প্রায় সকলেরই মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে ধারণা ছিল খুবই ভাসাভাসা। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধকে গভীরভাবে দেখতে পারেননি, কিংবা তাঁদের দেখবার ক্ষমতা ছিল না।”

মুক্তিযুদ্ধকে শুধু গভীরভাবে দেখা নয়, স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশকে নিয়ে যিনি অনেকদূর পর্যন্ত স্বপ্ন দেখতে পেরেছিলেন তিনি জহির রায়হান। তাঁর সম্পর্কে আলমগীর কবির বলছেন, “সেই একুশের সৈনিক জহির এই যুদ্ধেও তার ভূমিকা বেছে নিল—অস্ত্র হল তার মুভি ক্যামেরা। তারই নেতৃত্বে সূচিত হল স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন সিনেমা।”
অথচ কি দুর্ভাগা আমরা, আমাদের চলচ্চিত্রাকাশের সবচেয়ে জ্বলজ্বলে এই নক্ষত্রের কাজগুলো সুসংকলিত আকারে বাজারে সুলভ নয়। আমাদের ফিল্ম আর্কাইভ কি পারে না এই উদ্যোগ নিতে?

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগঠক, মুক্তিযোদ্ধা জহির রায়হানের কাজ কেন এখনো তাকবন্দী হয়ে থাকবে? বহির্বিশ্বে আমরা দেখি, কি চমৎকার মোড়কে গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রগুলোকে সহজলভ্য করা হয়। অথচ আমরা যেন কি এক ঘোরের ভেতর থাকি। কার জন্য যেন অপেক্ষা করি। যেন কেউ একজন এসে আমাদের উদ্ধার করে দিয়ে যাবেন। এই দায় আমাদেরই। জহির রায়হানের মতো চিন্তাবিদ ও চলচ্চিত্রকারের কাজগুলোকে সংগ্রহ করা এখন সময়ের দাবী। প্রয়োজনে যেভাবে সত্যজিৎ রায়ের ছবিকে বিদেশী ল্যাবের সহায়তায় ডিজিটাল প্রিন্টে রূপান্তর করা হয়েছে, সেভাবে জহির রায়হানের কাজকেও ডিজিটালি রিস্টোর করতে হবে। আমি মনে করি, যে দেশে ক্রিকেট ম্যাচের উদ্বোধনী সন্ধ্যায় বলিউডের নায়ক, নায়িকা ও গায়ক এনে কোটি কোটি টাকা খরচ করা যায়, যে দেশে চিহ্নিত ঋণখেলাপিদের কাছে হাজার হাজার কোটি কালো টাকা আছে, সে দেশে জহির রায়হানের মতো মহাত্মার কাজকে সংরক্ষণের অর্থের অভাব হবে না। সদিচ্ছা আর ভালোবাসাটা জরুরি।

বিজ্ঞাপন

সহায়
১. জহির রায়হান, রচনা সমগ্র, (ঢাকা: অনুপম প্রকাশনী, ২০১৭)।
২. আলমগীর কবির, চলচ্চিত্র ও জাতীয় মুক্তি: আলমগীর কবির রচনা সংগ্রহ ১, (ঢাকা: আগামী, মধুপোক, ২০১৮)।
৩. মাহমুদা চৌধুরী ও আয়শা আকতার কণা, জহির রায়হানের চলচ্চিত্র: সমাজ ভাবনা, (ঢাকা: বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ, ২০১৭)।
৪. মির্জা তারেকুল কাদের, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প, (ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ১৯৯৩)।

বিধান রিবেরু: চলচ্চিত্র গবেষক ও লেখক।

Tags: , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন