বিজ্ঞাপন

মুক্তিযোদ্ধাকে কেন সনদের আবেদন করতে হবে?— প্রশ্ন মুক্তি বাবু’র

December 16, 2019 | 6:09 pm

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। তবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও নেই তাঁর মুক্তিযোদ্ধা সনদ। রাষ্ট্রের কাছ থেকে তিনি নেননি কাগুজে পরিচয়। এমনকি পান না কোনো যুদ্ধাহত ভাতাও। নাম তাঁর রুহেল আহম্মদ। অনেকের কাছে তিনি ‘মুক্তি বাবু’ নামে পরিচিত।

বিজ্ঞাপন

সিলেটের গোলাপগঞ্জের ফুলবাড়ি গ্রামে আদিবাড়ি হলেও ঢাকাতেই বসবাস করতেন রুহেল আহম্মদ বাবু। তাঁর বাবার নাম নুরুর রহমান ও মা আসমা রহমান। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে ‘মুক্তি বাবু’ দ্বিতীয়। ছোট ভাই সোহেল আহমেদও একজন মুক্তিযোদ্ধা।

মুক্তিযোদ্ধা রুহেল আহম্মদ বাবু ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করেছিলেন চার নম্বর সেক্টরে। ক্যাপ্টেন শরিফুল হক ডালিম ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট কাদের যোগ দেওয়ার আগে তিনিই এই সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে সেই তথ্য কোথাও লিপিবদ্ধ না হওয়া নিয়েও কোনো ক্ষোভ নেই তাঁর। কারণ তিনি যে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন সেই দেশ আজ স্বাধীন। তিনি যে একজন মুক্তিযোদ্ধা এই ভেবে গর্ববোধ করেন। কারণ, তিনি দেশের স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এক অপারেশনে মারাত্মকভাবে আহত হন তিনি। পাকিস্তানি সেনাদের সাবমেশিন গানের গুলিতে তার বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচের হাড় উড়ে যায়। মর্টার শেলের স্প্রিন্টার লাগে হাঁটুর ওপরেও। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য রুহেল আহম্মদ বাবুকে সরকারিভাবে পাঠানো হয় পূর্ব জার্মানিতে। সেখানে ক্রাংকেন হাউজ বুখ, ইস্ট বার্লিনে তার চিকিৎসা হয়। ওখানেই পায়ের হাড় গ্রাফটিং করা হয়। পঁচিশ জনের দলে শমসের মবিন চৌধুরী, আমিন আহমেদ চৌধুরী, জেনারেল হারুনেরও চিকিৎসা হয় সেখানে। ব্যক্তিজীবনে বঙ্গবন্ধু পুত্র শেখ কামাল ও শেখ জামালের খুব কাছের মানুষ ছিলেন তিনি। তাও তিনি নেননি কোনো মুক্তিযোদ্ধা সনদ। তবে সেটি না থাকায় তিনি হতাশ নন। বরং ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রচণ্ড আশাবাদী একজন মানুষ। তিনি ভাবেন, মুক্তিযোদ্ধারা যে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন তার ভবিষ্যৎ গড়বেন তরুণরাই।

বিজ্ঞাপন

বিজয় দিবস উপলক্ষে সারাবাংলার সঙ্গে কথা বলেন এই মুক্তিযোদ্ধা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সারাবাংলার সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট সৈকত ভৌমিক

সারাবাংলা: আপনার মুক্তিযুদ্ধের অংশ নেওয়ার প্রেক্ষাপট কি ?

রুহেল আহম্মদ বাবু: রাজনৈতিক পরিবারেই আমার বেড়ে ওঠা। বাবা ছিলেন সিলেট আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তিনি ১২ বার কারাবরণ করেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও তাঁকে কারাবরণ করতে হয়। পাকিস্তানের বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী ছিলেন তিনি। সিলেটে যখন বঙ্গবন্ধু যেতেন তখন উনার কোলে ওঠার সৌভাগ্যও আমার হয়েছে। সৌহরাওয়ার্দী সাহেব এবং মাওলানা ভাসানীও আমাদের বাসায় আসতেন। তখন থেকেই মূলত রাজনীতিকে কাছ থেকে দেখা এবং রাজনৈতিক আবহে বেড়ে ওঠা। ১৯৬৯ সালে আমি ধানমন্ডি স্কুলের ছাত্র ছিলাম। সেই স্কুলের প্রথম ব্যাচের ছাত্র আমি। ছাত্রজীবনেই ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে জড়িয়ে পড়ি সক্রিয়ভাবে। স্কুল জীবন থেকেই শেখ কামালের বন্ধু ছিলাম। শেখ কামাল থাকত ৩২ নম্বরে আর আমি থাকতাম সাত নম্বরে। সেই সময়ে একুশে ফেব্রুয়ারি, পহেলা বৈশাখ এগুলো পালন করা নিষিদ্ধ ছিল। আমাদের বাংলা মিডিয়াম স্কুল হলেও এখানে অধ্যক্ষ ছিল একজন পাকিস্তানি, নাম রিজভী। শেখ কামাল প্রায়ই আমাদের স্কুলে আসত। এসে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাত ফেরি থেকে শুরু করে বিভিন্ন দিবস পালনের পরিকল্পনা করত।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা: ৭ই মার্চের ভাষণে কি সরাসরি শুনেছিলেন?

রুহেল আহম্মদ বাবু: ৭ই মার্চের আগে দেশের পরিস্থিতি ছিল উত্তাল। আমি তখন সবে বুয়েটে ভর্তি হয়েছি। ৭ই মার্চের ভাষণের দিন আব্বা বললেন, উনাকে নিয়ে যেতে হবে রেসকোর্সে। বাবাকে সঙ্গে নিয়ে একটি গাড়ি করে আমি, আমার ভাই সোহেল আহমেদ, বন্ধু আইয়ূব খান ও মাহবুবুর রহমান সেলিম বাচ্চু মিলে যাই রেসকোর্স ময়দানে। বর্তমানে যেখানে রাজু ভাস্কর্য সেখানে আমাদের গাড়ি রেখেছিলাম। সেদিন আমরা যে পাঁচজন ছিলাম তার মধ্যে চারজনই সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। বাবা বয়সের কারণে মুক্তিযুদ্ধে যেতে না পারলেও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রেখেছিলেন। মঞ্চের যতটুকু কাছে যাওয়া যায় আমরা ততটুকু গিয়েছিলাম। আব্বা খালি একটা কথাই বলছিল যে, শুনিস তো শেখ সাহেব পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলে কিনা। তখনই বুঝলাম, আজকে বড় কিছু একটা হতে যাচ্ছে। কারণ বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভোটে নির্বাচিত নেতা। যিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন। তখনও দেশ ভাগাভাগির চিন্তা আমার মাথায় আসেনি। তারপরে তো সেই ঐতিহাসিক ভাষণ।

সারাবাংলা: ৭ই মার্চের ভাষণ পরবর্তী সময়ে কীভাবে প্রস্তুতি নেন?

রুহেল আহম্মদ বাবু: ভাষণ শুনে যখন আসি তখন আমরা একজন আরেকজনের দিকে তাকাচ্ছিলাম। পরে আলোচনা করি নিজেদের মধ্যে। কীভাবে পরবর্তী দিন থেকে আমরা কাজ করব, সেগুলো নিয়ে আলোচনা করি। কারণ পুলিশ থাকবে না, ট্রাফিক পুলিশ বা প্রশাসন সেই অর্থে থাকবে না। আর তখন এলাকার দায়িত্ব নেওয়াও একটা দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। কারণ তখন ধানমণ্ডি হচ্ছে তখন এমন এক এলাকা যেটি বর্তমানের বারিধারা বলা যায়। দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এখানেই থাকতেন। আমরা তখন সেখানে একটি সংগ্রাম পরিষদ গঠন করি। কারণ, ধানমণ্ডিতে অনেক অবাঙালি থাকতো। সেই সময়ে আর তারা যেকোনো সময়ে অরাজকতা সৃষ্টি করতে পারে। এভাবেই যেতে থাকে দিন। উত্তপ্ত হতে থাকে পরিস্থিতি। পুলিশ না থাকার কারণে পুরান ঢাকা বা বিভিন্ন স্থানের অবাঙালিরা বিভিন্নভাবে অপকর্ম করার সুযোগ নিত। সেই সময়ে সারারাত আমরা পাহারা দেওয়া শুরু করি। এক পর্যায়ে ইকবাল হলের পানির ট্যাংকির নিচে আমরা প্রশিক্ষণ নেই। আমি পূর্বপাকিস্তান স্কাউট দলের লিডার ছিলাম, জাম্বুরিতেও গিয়েছিলাম। সেই হিসেবে আমাকে সেই ডেমো বন্দুকটা দেওয়া হয়। খসরু ও মন্টু নামে দুজন ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন। উনারা আমাদের প্রশিক্ষণ দিতেন। আমাকে দলনেতা হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। কারণ আমি মার্চপাস্টটা ভালোই পারতাম। রাতে আমরা সেই বন্দুক দিয়েই পাহারা দিতাম।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা: ২৫ মার্চের সময় আপনারা কোথায় ছিলেন?

রুহুল আহম্মেদ বাবু: আমাদের এলাকায় সিরাজ নামে এক বড় ভাই থাকতেন। কলাবাগানে থাকা ওই বড় ভাই ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় এসে আমাদের জানালেন, রাতে সেনাবাহিনী নামতে পারে। আমরা তখনও বিশ্বাস করতে পারিনি। তাও বলে ফেলেছিলাম, যে আসবে আসুক, আমাদের সামনে দাঁড়াতে পারবে না। এমন আত্মবিশ্বাস ছিল আমাদের। অথচ আমাদের কাছে সম্বল হিসেবে ছিল শুধু একটি টুটু বোর রাইফেল; যা দিয়ে পাখি মারে। আরেকটা থ্রি নট থ্রি ডামি বন্দুক ছিল। কলাবাগানের ৮ নম্বর রোডে লেকের পাড়ে একটি বিশাল আমগাছ ছিল। ২৫ মার্চের রাতে সেনাবাহিনী নামার কথা শুনে সেটি আমরা কেটে ফেলি, যাতে রাস্তায় ব্যারিকেড দেওয়া যায়। পুরো মিরপুর রোড ঢেকে যেত সেই গাছটার জন্য। মাত্র একঘণ্টার মধ্যে সেটি কেটে ফেলা হয়। ৭ই মার্চের পরেই আমরা ইউনাইটেড ব্যাংক অব পাকিস্তানের জিপ ও একটি মাইক্রোবাস নিজেদের কব্জায় নিয়ে রাখি। চিটাগাং রেস্টুরেন্ট নামে একটি হোটেল ছিল তখন ঢাকা কলেজের উলটো দিকে। সেখানে বসে আমরা বুনদিয়া আর পরটা খাচ্ছিলাম। হঠাৎ রাতে ১০টা থেকে সাড়ে ১০টার দিকে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাই। প্রথমে বুঝতে পারিনি কোথা থেকে এই শব্দ আসে। আমাদের সঙ্গে টয় নামে একজনের কাছে একটি পিস্তল ছিল। ভেবেছিলাম সে মনে হয় গুলি করছে। খোকন ভাইকে নিয়ে সেখানে যাই। জিপের সামনের দিকে পতাকা নিয়ে আমি বসেছিলাম। সঙ্গে সেই ডামি বন্দুক। দুই নম্বর রোড থেকে আসার সময় দেখি অনেকগুলো ট্রাক যাচ্ছে। সায়েন্স ল্যাবরেটরি পার হচ্ছিল গাড়িগুলো। পরে বুঝতে পারি যে, তারা আসলে পিলখানার মিশন শেষ করে রাজারবাগ যাচ্ছে। গোলাগুলির শব্দ শুনে যখন ভাবছিলাম টয় এগুলো করছে সেগুলো আসলে পিলখানায় হচ্ছিল।

আমাদের গাড়ির সামনে বাংলাদেশের পতাকা লাগানো ছিল। গাড়িটি দেখেই একটা ট্রাক থেমে যায়। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো আমাদের গাড়িটি যেতে দেওয়া হলো। তারা হয়তো ভেবেছিল পাকিস্তানি কোনো সেনা কর্মকর্তার গাড়ি। লোগোটাও হয়তো খেয়াল করেনি। আমরা রওনা দিয়ে কলাবাগানের বসিরুদ্দিন রোডে চলে আসি। সেদিকেই ভেতরে ছিল ছায়ানটের অস্থায়ী কার্যালয়। কারণ তাদের কার্যক্রমও নিষিদ্ধ ছিল। ছায়ানটের সেই অস্থায়ী কার্যালয়ে রবীন্দ্র সংগীত শেখানো হতো। সেখানে আমরা গাড়িটা রাখি। এখন যেটা পান্থপথ নামে পরিচিত সেখানে তখন একটা খাল ছিল। সেটি পার হয়ে গেলে ছিল একটি ডোবা। সেই ডোবার পাশেই আমরা লুকিয়ে ছিলাম। সেটা ক্রস করে আমরা ৩২ নম্বরে ঢুকব শেখ সাহেবের বাড়ি পাহারা দেওয়ার জন্য- এমন পরিকল্পনা ছিল আমাদের। আমাদের ধারণা ছিল, আমরা না গেলে শেখ সাহেবকে নিয়ে যাবে। এই পরিমাণে আমাদের আবেগ কাজ করত তখন। আমাদের কথা ছিল, খোকন ভাই টর্চের আলো দেখালে আমরা রাস্তা পার হব। তিনি রাস্তা পার হয়ে যান। কিন্তু টর্চের আলো জ্বালাতেই শুনি প্রচণ্ড গুলির শব্দ। দেখি টর্চটি উড়ে যাচ্ছে। এমন সময় দুইটা জিপ থেকে কেউ একজন বলছে, ‘শালা মর গ্যায়া?’ তখন আমরা বুঝতে পারি, সেই রাতের ভয়াবহতা। নিজেদের স্টুপিডিটিও তখন বুঝতে পারি। পরে আমরা সেখান থেকে ফিরে আসি।

২৭ তারিখ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সিগন্যাল খুঁজে পাই আমরা। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। আর এরপরেই কথা বলেন শমসের মবিন চৌধুরী। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ পরপর এই ঘোষণা শোনানো হয়। আর মাঝে শমসের মবিন চৌধুরী কথা বলতে থাকেন। শমসের মবিন চৌধুরী সবাইকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছিলেন। এবং আন্তর্জাতিক মহলকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি দেওয়ার অনুরোধ করছিলেন। ২৮ তারিখ সকালে কারফিউ ওঠার পরে কারফিউ ওঠার পরে আমরা যাই ছায়ানটের সেই অস্থায়ী বিল্ডিংয়ে। সেখান থেকে গাড়িটা বের করে খোকন ভাইকে খুঁজলাম। চারিদিকে অনেক অনেক লাশ পড়েছিল। একজন বলল, সোবহানবাগ মসজিদে একটি লাশ পড়ে আছে। দৌড়ে গিয়ে দেখি- ওটা খোকন ভাই। গুলিতে টর্চলাইটসহ উনার হাত উড়ে গেছে। লাশ নিয়ে ফিরে এলাম পানাউল্লাহ সাহেবের বাসায়। খুব দ্রুত সেখানে জানাজা পড়ানো হয়। পরিচিত কয়েকজন বলল, এখানে থাকা নিরাপদ নয়। তাই দাফনের জন্য লাশটা দিয়েই বাসায় ফিরে আসি।

সারাবাংলা: মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নেন? পরিবার কি রজি ছিল?

রুহেল আহম্মদ বাবু: ২৭ তারিখ বাসায় আসার পরেই আম্মু আমাকে বলে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য। আমার ছোট ভাই সোহেলের বয়স ১৭। আমার তখন ১৯। তিনি আমাদের সবাইকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে বলেন। বাসায় ছিল তখন ৭০০ রুপি। সেটা নিয়ে আমরা বের হয়ে পড়ি। বাসার গাড়ি দিয়ে আমাদের নামিয়ে দেওয়া হয় নরসিংদী ফেরি ঘাটে। তখন ঢাকা থেকে সিলেট যাওয়ার পথে পাঁচটা ফেরি পার হতে হতো। সেখান থেকে হেঁটে আমরা ১২ দিনে সিলেট পৌঁছাই। সিলেটে গিয়ে আমি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে পড়ি। সেখানে চিত্তরঞ্জন দত্তের গাড়ি খারাপ হওয়ার পরে সেটি ঠিক করার কাজ নেই। সেখান থেকে উনার সঙ্গে একজন চালক হিসেবে যুক্ত হই। সিলেট মুক্তাঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলে সেখান থেকে চলে যাই আসামের করিমগঞ্জে। সেখানে আমি মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেই। ওই সময় আমাদের প্রশিক্ষণ দিত বিএসএফ। বাঁশ দিয়ে দুই ইঞ্চির বন্দুক বানিয়ে আমরা প্র্যাকটিস করতাম। এরপর দিল্লি থেকে সিদ্ধান্ত হয় ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাদের প্রশিক্ষণ দেবে। তারা এসে আমাদের ইন্দ্রনগর বলে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে নিয়ে যায়। আমাদের সঙ্গে অধিকাংশই ছিল গ্রামের মানুষ। ঢাকার আমরা শুধুমাত্র দুজনই ছিলাম। এ সময় কিছুটা আক্ষেপের কণ্ঠে তিনি বলেন, গ্রামের মানুষেরা যেভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, সেভাবে ঢাকা শহরের খুব কম সংখ্যক মানুষ ছিলেন।

সারাবাংলা: মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ কোনো স্মৃতি কি মনে পড়ে?

রুহেল আহম্মদ বাবু: মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বলতে অনেক কিছুই মনে পড়ে। তবে কিছু স্মৃতি নিয়ে আফসোসও আছে। তেমনই একটি বলি আজ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কিন্তু বিভিন্ন রকমের হয়েছে। একদিকে ঢাকায় যেমন ক্র্যাকপ্লাটুন কাঁপিয়ে দিচ্ছিল, বিশ্ববাসীকে জানান দিচ্ছিল। দেখা গেছে, তারা ঢাকায় থেকেই এ কাজ করছিল। অনেক কষ্ট সহ্য করে, লুকিয়ে তারা যুদ্ধ করে যাচ্ছিল। আমাদের প্রেক্ষাপটটা কিছুটা ভিন্ন ছিল। আমরা থাকতাম ভারতীয় বর্ডারে। আমাদের খাওয়া-দাওয়া ও প্রশিক্ষণ খুব ভালো ছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনী যে রেশন ও বেতন পেত, আমরাও তাই পেতাম। সেখানে আমাদের অনেকের রেশন বেঁচে যেত। সেগুলো আমরা বিভিন্ন রিফিউজি ক্যাম্পে দিয়ে আসতাম। সেই সময়ে রিফিউজি ক্যাম্পের শরণার্থীরা আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকতো- দেশকে আমরা কবে স্বাধীন করব সেই আশা নিয়ে। আমরা ভেতরে আসতাম, মিশন শেষ করে চলে যেতাম। মিশন শেষে কিছুদিন বিশ্রাম পেতাম।

সারাবাংলা: মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশেষ কোনো ঘটনা কি, যা এখনও আপনাকে নাড়া দেয়?

রুহেল আহম্মদ বাবু: হ্যাঁ। অনেক মিশন করে ফেলেছি তখন। একবার নির্দেশ আসে বড়লেখার সাতমা ব্রিজ উড়াতে হবে। ব্রিজটি ৩০ থেকে ৪০ ফিটের মতো। যেকোনো মিশন শুরুর আগে একটা রেকি হয়। গ্রামের লোক এসে জানাতো প্রতিপক্ষ শিবিরের অবস্থা। খবর এলো, সেখানে কিছু রাজাকারও আছে যারা মুক্তিযোদ্ধাদের খবর দেয়। সেই মিশনে শিহাব নামে আমাদের একজন গাইড ছিল। সে জানায় দুইটা নদী পার হয়ে সেখানে যেতে হবে। আমরা হিসেব করে দেখলাম ১২ জন নিয়ে গেলেই আমরা এই মিশন সফল করতে পারব। রাইফেল আর এক্সপ্লোসিভ নিয়ে আমাদের যেতে হবে। যখন এক্সপ্লোসিভ সঙ্গে থাকে তখন সাঁতার কেটে নদী পার হওয়া যায় না। সেই মিশনে বাংলাদেশের ৭ থেকে ৮ মেইল ভেতরে এসে প্রথম নদীটি আমরা পার হই। আমরা কিন্তু কোনো বাড়িঘর বা বাজার দিয়ে কোথাও যেতাম না। কারণ একসঙ্গে ১০ থেকে ১২ জন যদি ভারি পোশাক নিয়ে ঘুরি তবে পেছনে কুকুর ঘুরে এবং ঘেউ ঘেউ করে। তখন পুরো গ্রাম জেগে যায়। সে কারণে আমরা দুই গ্রামের মাঝখানে জমির ভেতর দিয়ে পার হতাম। সেভাবেই নদীও পাড় হতাম। গাইডও আমাদের সেভাবেই নিচ্ছিল। প্রথম নদীতে গিয়ে আমরা দুটি নৌকা পাই। সেগুলো দিয়ে আমরা ১২ জন ক্রস করি। নদীটি একদম ছোট ছিল। দ্বিতীয় নদীতে গিয়ে দেখি কোনো নৌকা নেই। মাইলখানেক ঘুরেও কোনো নৌকা পাওয়া যায়নি সেখানে। দূরে একটি বাড়ি দেখতে পাচ্ছিলাম। তখন মধ্যরাত। হতাশ হয়ে সেখানেই বসে পড়ি। হঠাৎ পেছনে মনে হলো জঙ্গলটা নড়ে উঠেছে। সঙ্গে সঙ্গে স্টেনগান তাক করি। কিন্তু দেখি ১৫ থেকে ১৬ বছর বয়সী এক মেয়ে সেখান থেকে বের হয়ে আসে। পরনে এক পারের শাড়ি, যার আঁচলের কিছু অংশ মুখে কামড়ে ধরে কাঁপছে। সে তখন সিলেটি ভাষায় জিজ্ঞেস করে- ‘মুক্তি নি? আমি জানতাম আপনারা আইবা।’

আমরা উত্তর দেওয়ার আগেই সে বলে- ‘আমি জানতাম আফনারা আইবান। নৌকা কিন্তু আছে। সব নৌকা ডুবাই দেছে। কারণ, ওরাও জানতে পাইছে আফনারা আইবান।’ এই বলেই সে নিজে পানিতে নেমে গেল। আমি জাস্ট শকড হয়েছিলাম। হাঁটু পানিতে সে শাড়িটা তুলে নৌকা খুঁজছিল। আর সবাইকে খুঁজতে বলছিল। এক সময় পানির নিচে একটা নৌকা পাওয়া যায়। সবাই নৌকার পানি সেচ দিয়ে সরাচ্ছিল। মেয়েটি বলল, ‘এভাবে হবে না, নৌকা উলটে নিতে হবে।’ আবার সে পানিতে নামল। এবার খুঁজে পেল লগি। সেই নৌকা দিয়ে সবাইকে পার করে দিল। আমি ওর এসব কাণ্ড দেখে স্তম্ভিত। সে আমাকে এসে এবার ধমক দিয়ে বলে, ‘আফনি বসেন কেনো? ওঠো।’ সে আমাকে পার করে দেয়। মেয়েটা চারপাশে দেখছিল আর ভয়ে কাঁপছিল। আমি তখনও স্তম্ভিত। মেয়েটিকে ধন্যবাদ জানানোর সুযোগ পেলাম না। ভাবলাম ওকে কিছু পুরস্কার দেওয়া দরকার। কিন্তু ঘুরে তাকাতেই দেখি সে আর নেই। নৌকা নিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে।

এটা ভাবতে ভাবতে আমরা ব্রিজ পর্যন্ত যাই। ব্রিজটা উড়িয়ে দেই। সেটা করতে গিয়ে একটা ভুল হয়েছিল। আমাদের সঙ্গে থাকা গাইড একটা রাজাকারকে মারতে গিয়েছিল। স্টেনগান দিয়ে মারার সময় সে অস্ত্রটি উল্টোদিকে করে রেখেছিল যেটির গুলি তার বুকে গিয়ে লাগে এবং মারা যায়। সেই লাশ নিয়ে আমরা ফেরত আসি। নৌকা পেতে আর সমস্যা হয়নি। পরের দিন সকালে আমরা ফিরে যাই আবার ক্যাম্পে। কিন্তু সবাই আমরা একটা ঘোরে থাকি আগের রাতের ব্যাপার নিয়ে। মনের ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে মেয়েটির কথা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, গ্রামবাসীর চোখ ফাঁকি দিয়ে সে এসেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতে। যার নাম আমাদের জানা হয়নি। যাকে আমরা ধন্যবাদ দিতে পারিনি। এর চেয়ে বড় যুদ্ধ আর কী হতে পারে? পরদিন বিকেলে সহযোদ্ধারা কেউ কেউ বলছিল, মেয়েটি ছিল পরী। আবার কেউ কেউ বলছিল সে ছিল ফেরেশতা, যে আমাদের প্রাণে বাঁচিয়েছে। নতুবা গ্রামের এমন একটা মেয়ে আমাদের সেই সময়ে সাহায্য করতে আসত না। কিন্তু আমার কাছে সে একজন মুক্তিযোদ্ধা। জানি না সে এখন বেঁচে আছে কিনা। যদি বেঁচে থাকে তবে ওর বিয়ে হয়েছে কিনা? ওর সন্তানেরা জানে কিনা, তাদের মা একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমার মুক্তিযোদ্ধা সনদ না নেওয়ার পেছনে এটিও একটি কারণ। সেওতো একজন মুক্তিযোদ্ধা। তারওতো যেকোনো বিপদ হতে পারতো। তিনি কী তাঁর সনদ পেয়েছেন?

সারাবাংলা: মুক্তিযুদ্ধে আপনাদের বড় অপারেশনের কোন ঘটনাটা এখনও মনে পড়ে?

রুহেল আহম্মদ বাবু: পাকিস্তানি সেনাদের একটি ক্যাম্প ছিল দিলখুশ চা বাগানে। সেটা দখলে নেওয়ার পরিকল্পনা হয়। সেটা ছিল আমাদের একটা বড় হামলা। পরিকল্পনা ছিল ফার্স্ট অ্যাটাকে যাবে কাট অফ পার্টি। যেটি দুইদিক থেকে যাবে, যাতে রিইনফোর্সমেন্ট পার্টি না আসতে পারে। আরেকটা থাকবে কাভার পার্টি, যারা কাভারিং ফায়ার করবে। লাস্ট অ্যাটাক করবে অ্যাসল্ট পার্টি, যেটা নিচ দিয়ে গিয়ে হামলা করবে। অ্যাসল্ট পার্টিতে ছিলাম আমরা তিনজন- আমি, খয়ের আর আতিক। আতিক হচ্ছে ওয়াপদার ড্রাইভার; কিন্তু দুর্দান্ত এক যোদ্ধা। কাভার পার্টির গোলাগুলি যখন শেষ হলো তখন দেখি আতিক দাঁড়িয়ে আছে চা বাগানের ভেতর। আমাদের তিনজনের প্রত্যেকের সঙ্গে ৭ থেকে ৮ জন করে যোদ্ধা ছিল। এমন সময়ে দেখি হঠাৎ আতিক ‘জয় বাংলা’ বলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে বলছে। আমি ভাবছিলাম একজন ওয়াপদার ড্রাইভারের এতো সাহস হলে আমি আর কেনো চুপ থাকব। আমিও উঠে গেলাম। এর পরে দেখি খয়েরও উঠে গেছে। সবাই ‘জয় বাংলা’ বলে এগিয়ে যেতে থাকি। তিনটি গ্রুপে অ্যাটাক করে ওদের বাঙ্কার দখলে নিই। তখনই বাঁ পায়ে হাঁটুর ওপরে এসে লাগে মর্টার সেলের ছোট্ট একটি স্প্রিন্টার।

হাসপাতালে আমি যখন আহত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছিলাম তখন আতিক আসে আমার সঙ্গে দেখা করতে। আতিক আমার পায়ের অবস্থা দেখে কান্না করতে থাকে। আমি তাকে বলি- তোমার এত সাহস কীভাবে হলো। কারণ, কাভার পার্টির গুলির পরে তো আমি ভয় পাচ্ছিলাম। উপরে উঠে দাঁড়ানোর সাহস পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ দেখি তুমি ‘জয় বাংলা’ বলে এগিয়ে গেছো। তোমাকে দেখে আমি উঠে পড়ি। সে উত্তর দিয়ে বলে, ‘কি বলেন বাবু ভাই, আমি তো পারলে ভয়ে মাটির নিচে চলে যাই। আমি দেখি মন্ত্রীর ছেলে জান বাজি রেখে এগিয়ে যাচ্ছে। তিনি এগিয়ে যেতে পারলে আমি এগুতে পারবো না কেনো? আপনারে দেখেই তো আমি উঠেছিলাম।’

সারাবাংলা: বর্তমান সময়ে কোনো আক্ষেপ আছে কি?

রুহেল আহম্মদ বাবু: আক্ষেপ ঠিক বলা যায় না। তবে কিছু বিষয় খারাপ লাগে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীরর ৯৩ হাজার সৈনিক আত্মসমর্পণ করেছিল। এটা সবাই জানে। কিন্তু কতজন পাকিস্তানি আমাদের হাতে মারা গেছে- অনেকেই তা জানে না। ৬ হাজার ৬০০ পাকিস্তানি সৈন্য মারা যায় মুক্তিবাহিনীর হাতে। যাদের মধ্যে ৩ জন আমার হাতে মারা যায়। ১৩ দিনে ভারতের চার হাজার সৈনিক মারা যায়। ইদানিং অনেককে হাজারে হাজার পাকিস্তানি সেনা মেরে ফেলার গল্প বলে। আসলে কী তাই? আমরা তো মাসুদ রানা বা জেমস বন্ড ছিলাম না। আমরা নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচাতে লড়াই করছিলাম। একটা বিড়ালকে যখন এক কোণঠাসা করা হয় তখন সেও তার অস্তিত্ব রক্ষায় লড়াই করে। পাকিস্তানিরা শোষণ করতে করতে বাঙালিদের সেই অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে নামিয়েছিল। সেজন্য আমি সবাইকে বলি সত্য ইতিহাস তুলে ধরার জন্য। দুই মাসের ট্রেনিংয়ে আমরা যা করেছি, তার বেশি আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। সেই মেয়েটি যে সাহস দেখিয়েছে, কিছু ক্ষেত্রে সেটা দেখানোর সাহসও আমাদের ছিল না। তাও আমরা যুদ্ধে জিতেছি। কেনো? কারণ পুরো রাষ্ট্র আমাদের সঙ্গে ছিল। প্রকৃতিও পাকিস্তানের পক্ষে ছিল না। বীরশ্রেষ্ঠ হয়েছেন সেনাবাহিনীর কিছু লোক। কিন্তু তার বাইরে কেউ হয়নি। এটা দুর্ভাগ্যজনক। কারণ সেনাবাহিনীর কারও সুযোগ ছিল না যুদ্ধ ছাড়া অন্য কিছু চয়েস হিসেবে নেওয়ার। হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করতে হবে নতুবা বাংলাদেশের পক্ষে। কিন্তু একজন গ্রামের মানুষ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের তেমন বাধ্যবাধকতা ছিল না। তবু তারা যুদ্ধে গেছে। তাই খেতাবটা তাদেরও পাওয়ার কথা। মুক্তিযুদ্ধের সনদ আমি টাকা দিয়ে কেনো নেব? সেজন্য তো আমরা যুদ্ধ করিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের কেনো সনদের জন্য আবেদন করতে হবে? আমি পা হারিয়েছি, আমাকে চিকিৎসা করতে জার্মানি পাঠানো হয়। যেখান থেকে আমি ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশে আসি। ওই সময় আমি সনদের জন্য আবেদন করিনি। এবার যে গেজেট বের হচ্ছে সেখানে বলা হলো, আমার নাম থাকবে।

সারাবাংলা: তরুণদের জন্য আপনি যা বলতে চান।

রুহেল আহম্মদ বাবু: নয় মাসে খুব সোজা কাজটা আমরা করে দিয়েছি। কিন্তু তোমাদের নব্বই বছর দিলাম দেশটাকে গড়ে তোলার জন্য। দেশটা ঠিক পথে আছে। আমার স্বপ্ন ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখে যাওয়া। সেটি পূরণ হয়েছে। পাকিস্তানও ধ্বংস হয়ে যাবে। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি সুখী। তবে নতুন প্রজন্মকে নেতৃত্ব বুঝে নিতে হবে। আমাদের সময় শেষ। তরুণ প্রজন্মকে দেশের নেতৃত্ব দিতে হবে। এরই মধ্যে অনেক তরুণ দেশের উন্নয়নে অবদান রাখছে। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে হবে। সেই চেতনাকে ধারণ করে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। তরুণদের বলি, ‘তোমরা সঠিক পথেই আছো, দেশটাকে গড়।’

সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন