বিজ্ঞাপন

‘রাজাকারের তালিকায় ভুল অমার্জনীয়, দোষীদের ক্ষমা চাওয়া উচিত’

December 17, 2019 | 10:28 pm

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: প্রথমবারের মতো সরকারের পক্ষ থেকে রাজাকারের তালিকা প্রকাশের উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও এই তালিকা প্রণয়নের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মুক্তিযোদ্ধাসহ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে কাজ করা গবেষক ও শহিদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানেরা। তারা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ব্যক্তিরাই কেবল নন, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের নামও স্থান পেয়েছে এই তালিকায়, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ‘অবহেলা’য় প্রণয়ন করা মন্ত্রণালয়ের এই তালিকা বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে।

বিজ্ঞাপন

তারা বলছেন, তালিকায় যেসব ‘ভুল’ রয়েছে, সেগুলো অমার্জনীয়। তালিকাটি প্রত্যাহার করে নেওয়ার পাশাপাশি তালিকার ‘ভুল’গুলোর জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করা উচিত এবং তাদের ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত বলেও মনে করছেন তারা।

গত রোববার (১৫ ডিসেম্বর) প্রথম সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রথম দফায় ১০ হাজার ৭৮৯ জন রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করেন মুক্তিযুদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। তালিকা প্রকাশের পরই জানা যেতে থাকে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ব্যক্তিই কেবল নন, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং সরকারের গেজেটভুক্ত বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাও স্থান পেয়েছেন রাজাকারের তালিকায়। এর মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর নামও।

আরও পড়ুন- ‘আমি হতবাক, মর্মাহত, বিস্মিত ও অপমানিত’

বিজ্ঞাপন

তালিকা নিয়ে ১৯৭১-এর গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্টের সভাপতি ড. মুনতাসির মামুন সারাবাংলাকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় রাজাকারের যে তালিকা দিয়েছে, সেটি বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। অবিলম্বে এই তালিকা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে প্রত্যাহার করা উচিত। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে কাজ করেছেন, স্বাধীনতাবিরোধীদের সংজ্ঞা যারা জানেন, তাদের নিয়ে একটি আলাদা কমিটি করে এমন কাজ করা দরকার ছিল। আমলাতন্ত্র দিয়ে সব কাজ হয় না।

রাজাকারের তালিকার বদলে ‘স্বাধীনতাবিরোধী’দের তালিকা প্রণয়ন ও প্রকাশ করা জরুরি ছিল বলে মনে করেন এই গবেষক। তিনি বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী শব্দটি আলাদাভাবে বলেছি কারণ রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, আল- মুজাহিদীন, রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি থেকে শুরু করে সবাই চলে আসে। রাজাকার শব্দটি স্বাধীনতাবিরোধী বোঝালেও এর মাধ্যমে স্বাধীনতার বিরোধিতাকারীদের বিষয়টি পূর্ণভাবে প্রকাশিত হয় না। কারণ রাজাকার ছিল স্বাধীনতাবিরোধীদের একটি আলাদা ইউনিট। সেই হিসেবেই মন্ত্রণালয় হয়তো বলছে রাজাকার তালিকা। অথচ এই তালিকায় স্বাধীনতাবিরোধী শব্দটি থাকা দরকার ছিল।

তালিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, এক দশক আগে মেজর শামসুল আরেফিন কয়েক খণ্ডে রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করেছিলেন। প্রতিটি থানায় গিয়ে করা সেই তালিকা ছিল ১৪ হাজার রাজাকারের। গেজেট নোটিফিকেশনে যেসব রাজাকারের নাম ছিল, তা নিয়ে ২০ বছর আগে আমার এক ছাত্র ‘রাজাকারের তালিকা’ নামে বই করেছিল। আমি নিজে এক দশক আগে মুক্তিযোদ্ধা কোষ করেছি ১২ খণ্ডে। এর তিন খণ্ড ছিল স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে। এসব তালিকা নিয়ে কিন্তু কেউ কখনো প্রশ্ন তোলেনি।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন- রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার নাম

নতুন প্রকাশিত তালিকা নিয়ে মুনতাসীর মামুন বলেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় বলছে, এটি পাকিস্তান আমলে করা তালিকা, এটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় করেছে। কিন্তু আমার জানা মতে, পাকিস্তান আমলে করা তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে অনেকবার চেয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন। কিন্তু তখন মন্ত্রণালয় কোনো সহযোগিতা করেনি। এখন তারা কোথায় পেল এই তালিকা? মন্ত্রণালয় কি কিছু যাচাই-বাছাই করেছিল? সবচেয়ে বড় কথা, এই তালিকা থাকবে গোয়েন্দা সংস্থার কাছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে কেন থাকবে? তাহলে প্রশ্ন ওঠে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিসের ভিত্তিতে এই তালিকা করেছে? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যদি এই তালিকা পাকিস্তান আমল থেকেই থেকে থাকে, তাহলে সেটা চাওয়ার পর এতদিনেও প্রসিকিউশনকে দেওয়া হয়নি কেন? তালিকাটি পুরো মন্ত্রণালয়কেই কাঠগড়াতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

মুনতাসীর মামুন বলেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীকে আমি একজন সহজ-সরল ও সৎ ব্যক্তি হিসেবে জানি। তিনি হয়তো তার মন্ত্রণালয়ের এসব বিষয় অনুধাবন করতে পারছেন না। কিন্তু গোলাম আরিফ টিপুকে (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর) যদি অভিযুক্ত করা হয়, তখন বিষয়টি কী দাঁড়ায়?

আরও পড়ুন- ৪৮ বছর পর রাজাকারের তালিকা কেন?— প্রশ্ন বিএনপির

বিজ্ঞাপন

আমলাদের দিয়ে এমন একটি তালিকা প্রণয়নের বিরোধিতা করেছেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবিরও। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, রাজাকারের তালিকা বা যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা প্রকাশ করার উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। কিন্তু এটি যে প্রক্রিয়ায় করা হয়েছে, সেটি নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। এই কাজে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে কাজ করা কোনো গবেষককে যুক্ত করা হয়নি। আমলাদের দিয়ে এ তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু এটি আমলাদের কাজ নয়। এ অবস্থায় এ তালিকা নতুন করে যাচাই-বাছাই করে সতর্কতার সঙ্গে আবারও প্রকাশ করা দরকার।

সার্বিকভাবে স্বাধীনতাবিরোধীদের কথা উল্লেখ না করে কেবল রাজাকারদের তালিকা হিসেবে এটি প্রকাশ করার সমালোচনাও করেন শাহরিয়ার কবির। তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম থাকাকে চরম দুর্ভাগ্যজনক বলে মনে করেন তিনি। বলেন, তালিকায় শুধু রাজাকারদের নাম আছে। সেখানেও তাদের অপরাধের ধরণ উল্লেখ নেই। রাজাকার ছিল পাকিস্তানিদের নিজস্ব একটি বাহিনী। তারা ছিল বেতনভোগী। তাদের অনেকেই প্রাণের ভয়ে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিলেও অনেকেই কিন্তু যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল না। কিছু ক্ষেত্রে তারাও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছে। সুতরাং এই তালিকাতে অপরাধের মাত্রাও থাকা দরকার। আর মুক্তিযুদ্ধের পরে বঙ্গবন্ধুর আমলে ১১ হাজার স্বাধীনতাবিরোধীর একটি তালিকা ছিল। আমার ধারণা সেটিই নতুন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে।

২০ ডিসেম্বর একটি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি তাদের তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করবে বলেও জানান শাহরিয়ার কবির।

আরও পড়ুন- রাজাকারের তালিকায় নয়া ভাইয়ের নাম, প্রতিবাদে উত্তাল পাথরঘাটা

মুক্তিযুদ্ধের সময় চার নম্বর সেক্টরে সাব-কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন রুহেল আহম্মদ বাবু। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, স্বাধীনতার এত বছর পরে রাজাকার তালিকা করা প্রয়োজন আছে কি না, সেটা নিয়েও প্রশ্ন থাকতে পারে। আর তালিকা যদি করাও হয়, সে বিষয়েও সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।

প্রকাশিত তালিকা অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, যদি মুক্তিযোদ্ধার তালিকা করতে একবার ক্রস চেক করা হয়, তবে তার ১০ গুণ বেশি ক্রসচেক করা দরকার রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করার সময়। কারণ এখানে একটি ভুলের দায় একটি পরিবারের সদস্যদের আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। যাকে রাজাকার বলা হচ্ছে, সে হয়তো বেঁচে নেই। কিন্তু তার পরিবারের সদস্যদের সেই গ্লানি বইতে হবে আজীবন। এগুলোর সমাধান প্রয়োজন। আর বর্তমান তালিকা অবিলম্বে প্রত্যাহার করা দরকার।

রাজাকারদের এই তালিকা প্রকাশে অবহেলার অভিযোগ এনেছেন দুই শহিদকন্যা। তারা বলছেন, এরকম একটি তালিকা তৈরিতে অবহেলা করা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।

শহীদ ডা. আলীম চৌধুরীর মেয়ে নুজহাত চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয় হোক বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হোক, এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ এতটা অবহেলা নিয়ে করাটা আমার দৃষ্টিতে অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে যখন কেউ কাজ করবে, তখন সেখানে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। বলা হচ্ছে, পাকিস্তানিদের করা তালিকা। সেটা কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই কিভাবে প্রকাশ করা হলো। এটাকে অবহেলা নয়, আমি অন্যায় বলে মনে করি।

নুজহাত চৌধুরী আরও বলেন, এই তালিকায় আমাদের একটি বড় ক্ষতি হয়ে গেল। কারণ রাজাকারদের যে তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম আসে, তখন আমাদের স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা করার দাবিও প্রশ্নের মুখে পড়ে যায়। কিন্তু আমরা তো স্বাধীনতাবিরোধীদের চিহ্নিত করতে চাই। সেই দাবিতে যারা প্রশ্নের মুখে ফেলে দিলো, যে আমলারা এই কাজে অবহেলা করেছেন, তাদের পরিচয়ও সবাইকে জানানো দরকার। সরকারের ভেতরে থেকে কারা সরকারকে বিব্রত করার চেষ্টা করছে, সেটা জানার জন্য হলেও এদের পরিচয় সামনে আসা দরকার। যাদের কারণে রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম এসেছে, তাদের সংশ্লিষ্ট সবার কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত।

শহিদ আলতাফ মাহমুদ চৌধুরীর মেয়ে শাওন মাহমুদ বলেন, ভুল-ত্রুটি সংশোধন না করে এভাবে রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করার কারণ কী? রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম— যাচাই-বাছাই না করে কেবল বাহবা কুড়ানোর জন্যই কি এই তালিকা প্রকাশ? এই তালিকা প্রণয়নের জন্য কি আদৌ মাঠে কাজ করা হয়েছে? নাকি অফিসে বসেই করা হয়েছে এই তালিকা? এসব প্রশ্নের উত্তর জানা প্রয়োজন। কারণ যে ভুলগুলো করা হয়েছে, সেগুলো শুধু  ভুল নয়, অমার্জনীয় অপরাধ। এই অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

এরই মধ্যে এই তালিকা নিয়ে দুঃখপ্রকাশ করেছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। তিনি বলেছেন, তালিকায় ‘ভুল করে’ যাদের নাম এসেছে, আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের তথ্য যাচাই-বাছাই করা হবে। ভুলের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত হলে প্রয়োজনে তালিকা প্রত্যাহার করে নতুন তালিকা প্রকাশ করা হবে।

পরে মন্ত্রণালয় থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতেও বিষয়টির ‘ব্যাখ্যা’ দেন মন্ত্রী মোজাম্মেল হক। তাতে তিনি বলেন, তালিকাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রণয়ন করেছে। তার মন্ত্রণালয় কেবল প্রকাশ করেছে।

এদিকে, তালিকা প্রণয়ন বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দিকে ইঙ্গিত করলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলছেন, এই তালিকা থেকে কিছু নাম বাদ দেওয়ার জন্য নোট দেওয়া হয়েছিল। সেই নোট আমলে নেওয়া হয়নি।

সারাবাংলা/এসবি/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন