বিজ্ঞাপন

গণমাধ্যম, শিল্প-সাহিত্য ও আমাদের অবক্ষয়

December 23, 2019 | 7:38 pm

জ্যোতিষ মণ্ডল

বাঙালি জাতির সংস্কৃতি পাল্টে গেছে অনেকটাই। যতটুকু বাকি আছে সেটুকুও পাল্টে যাচ্ছে দ্রুত। কিছু পরিবর্তন যেমন উন্নতির দিকে গেছে, তেমনি আবার কিছু পরিবর্তন আমাদের নিচের দিকে নিয়ে গেছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মৌলিক মূল্যবোধগুলোর অধঃপতন হয়েছে বা অবক্ষয় হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

এখন গরিব, অশিক্ষিত বা রিকশাওয়ালা হলে আমরা আর কাউকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করি না। ব্যাপারটা অনেকটা এমন, বয়স যতই হোক গরিব বা অশিক্ষিতের আবার সম্মান কিসের। কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী, ষাটোর্ধ্ব বয়সী বাবা, কাকা বা দাদার বয়সীকে, ‘এই রিকশা যাবি?’ বলেই সম্বোধন করেন। এমনকি ‘রিকশাওয়ালাও’ বলে না। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, কেউ এতে বিব্রতবোধও করে না, প্রতিবাদও করে না। কারণ সমাজে এখন শুধু টাকাওয়ালা মানুষকেই সম্মানি মানুষ মনে করা হয়। টাকা অর্জনই এখন সবকিছুর মাপকাঠি। বৃদ্ধকে তুই বললে কেউ প্রতিবাদ না করলেও, ঘুষখোরকে ‘ঘুষখোর’ বলে গালি দিলে কিন্তু অনেক মানুষই প্রতিবাদ করে। এখন আর কেউ বলে না যে, ঘুষ, দুর্নীতি, অনৈতিকতার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের কাছে মেয়ে বিয়ে দেওয়া হবে না, তাদের বসতে চেয়ার দেওয়া হবে না, একসাথে বসে চা পান করব না। টেনেটুনে ফাইভ পাস হলেও সমস্যা নেই, ওই ব্যক্তির টাকার কাছে শিক্ষিতরাও এখন নিজেকে সমর্পন করে দেয়। এমনকি তাকে চেয়ার ছেড়ে দিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে যায়। সমাজ এখন অর্থকে মর্যাদা দেয়। জ্ঞান, মেধা, শিক্ষা ও বিবেক-বুদ্ধি এখানে তুচ্ছ। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে।

অনেক আগের একটি ছবিতে জওহর লাল নেহেরুকে রবীন্দ্রনাথের পায়ের কাছে বসে থাকতে দেখেছি। কিন্ত এখন? এখন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের পায়ের কাছে পণ্ডিতদের বসতে হয়। আগে পণ্ডিতরা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের গাইড করতেন। কিন্তু এখন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ইচ্ছায় পণ্ডিতদের চলতে হয়। আমার ছোটবেলা আর এখনকার সামাজিক অবস্থার মধ্যে বিরাট পার্থক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। আর এই সামাজিক অবক্ষয়ে বড় একটি ভূমিকা রয়েছে আমাদের গণমাধ্যম, শিল্প ও সাহিত্যেরও; যা আমরা কোনোভাবেই অস্বীকার করতে পারি না।

দেশাত্মবোধ জাগ্রত হয় এরকম গান, কবিতা বা প্রবন্ধ কেউ লেখে বলেই মনে হয় না। গণমাধ্যমগুলোও জাতি গঠনে যথাযথ ভূমিকা নেওয়ার চেয়ে অর্থ আয়ের দিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তারাও এখন চায় পাঠকের সন্তুষ্টি বা ভিউয়ারশিপ। পাঠকের রুচি পরিবর্তনের দায়িত্ব এখন আর কেউ নিতে চায় না। ব্যাপারটি অনেকটা এমন যে, বাচ্চা চিপস খেতে চায় তাই চিপসই দাও। পুষ্টির কথা কেউ ভাবে না। ব্যবসায়ীক কারণে গণমাধ্যমের মালিকানা এখন আর গণমাধ্যম কর্মীর হাতে বা শিল্পীর হাতে নেই। এগেলো প্রায় সবই ব্যাবসায়ীদের হাতে চলে গেছে।

বিজ্ঞাপন

আপনাদের অনেকেরই হয়তো মনে আছে যে, রাজধানীতে কয়েক বছর আগে ওয়াসার পাইপের মধ্যে পড়ে জিহাদ নামে একটি ছেলে পরে যায়। সারাদেশের মানুষ সেদিন বেশ উদ্বিগ্নের সঙ্গে ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করছিলেন গণমাধ্যমের কল্যাণে। সেদিন গণমাধ্যমগুলো সেই উদ্ধার অভিযান সরাসরি সম্প্রচার করেছিল। এমনও দেখা গেছে যে, উদ্ধার অভিযানের কাজ প্রায় বন্ধ রেখে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের ইন্টারভিউ দিতে দেখা গেছে।

ভারতে তাজ এবং ওভেরয় নামে বিখ্যাত দুটি পাঁচতারকা হোটেলে পাকিস্তানি সন্ত্রাসীরা আক্রমণ করেছিল। সেখানে যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালাচ্ছিল, তখন মিডিয়াগুলোও তা লাইভ টেলিকাস্ট করছিল। আর সেই লাইভ টেলিকাস্ট দেখে পাকিস্তানে বসা সন্ত্রাসীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গতিবিধি সম্পর্কে হোটেলে অবস্থানরত সন্ত্রাসীদের আপডেট দিচ্ছিল। সেখানে গণমাধ্যমের লাইভ টেলিকাস্টই মুখ্য ছিল, ফলাফল নয়।

সেদিন ফেসবুক দেখতে দেখতে ভারতের মিরাক্কেল সিরিয়ালের হাসাহাসির একটি এপিসোড দেখছিলাম। একটি বাচ্চা ছেলে স্কুলছাত্রের চরিত্রে অভিনয় করছে। অভিনয়ের বিষয়বস্তু হচ্ছে- ছাত্রটি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের চেয়ারে উল্টো করে পেরেক মেরে রেখেছে, যাতে সেটি শিক্ষকের পাছায় ঢোকে আর সে ব্যাথা পায়। কারণ আগেকার দিনে মানুষকে যখন শুলে চরানো হতো তখন সেই মানুষগুলো কেমন কষ্ট পেত তা ওই ছাত্রটি দেখতে চায়। প্রধান শিক্ষকের ভূমিকায় যিনি অভিনয় করেছেন, ছাত্রটি তার চুল টানাটানি করে ওঠাতে চাচ্ছে। ছাত্রটি দেখতে চায় তার শিক্ষকের মাথায় টাক হলে দেখতে কেমন হবে। এই হচ্ছে এখনকার মিডিয়ার ভূমিকা, বিবেক আর বিবেচনা। মানুষ হাসানোর জন্য তো আরও অনেক গল্প লেখা যেত। নাকি তারা কোনো গল্প লিখতে জানে না। হাসির অনুষ্ঠান বাচ্চারাই বেশি দেখে। মিডিয়াগুলো দেখিয়ে দিচ্ছে, শিক্ষকদেরও অপমান করা যায়। শিক্ষক, যে কিনা মানুষ গড়ার কারিগর, আমদের মিডিয়া তাদের পাছায় ছাত্রকে দিয়ে পেরেক ঢোকানো শেখাচ্ছে আর মানুষ হাসাচ্ছে। কয়েকদিন আগে আমরা শিক্ষককে পুকুরে নিক্ষেপ করার ঘটনাও দেখেছি।

বিজ্ঞাপন

আমাদের ছোটোবেলা শিক্ষক বাড়িতে আসলে আমরা বাড়ি থেকে পালিয়ে দূরে চলে যেতাম। আর সামনা-সামনি দেখা হলে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতাম। এখন দিন বদলেছে। এখন আর কোনো ছাত্র শিক্ষকের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম বা সালাম করে না। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করা নাকি সেকেলে কালচার। কারও কাছে মাথা নোয়ালে নাকি মন ছোট হয়ে যায়। কোথাও কোথাও ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতার কথাও শোনা যায়। এতে নাকি মানসিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। কেউ কেউ বলে থাকেন, মানুষ আদম সন্তান। সুতরাং সবাই সমান। একজন আরেকজনের পায়ে কেন হাত দেবে? মাথা কেন নোয়াবে? কারণ জ্ঞানী, মুর্খ, বাচ্চা, বৃদ্ধ সবাই সমান!

ছোটোবেলা আমরা ‘ইভ টিজিং’ শব্দটির সাথে একেবারেই অপরিচিত ছিলাম। এ কালে এসে পরিচিত হয়েছি শব্দটির সঙ্গে। ক্লাস ওয়ান থেকে একেবারে শেষ পর্যন্ত কো-এডুকেশনে পড়াশোনা করেছি। অথচ এই শব্দটার সাথে পরিচিত হলাম এই মধ্য বয়সে এসে। আমাদের ছেলেরা ইভটিজিং এখন শৈল্পিক কায়দায় করে। তাও আবার মিডিয়ার অবদানে। তারা এখন গানের সুরে সুরে ইভটিজিং করে, ও টুনির মা তোমার টুনি কথা শোনে না……। গানটি যার উদ্দেশে গাওয়া হচ্ছে তিনি অবশ্যই মাতৃস্থানীয়া এক ভদ্রমহিলা। আর যাই হোক তাকে টুনির মা তো ডাকা যায় না। হায়রে গীতিকার, হায়রে গায়ক, হায়রে গণমাধ্যম! এগুলো কি সম্প্রচার যোগ্য?

ভারতের প্রখ্যাত শিল্পী শ্যামল মিত্রের একটি গান আছে- ‘নাম রেখেছি বনলতা যখন দেখেছি, হয়তোবা সেই ক্ষণে তারে ভালবেসেছি।’ এই গানটি ওনার গাওয়ার কথা ছিল না। অন্য আরেকজন শিল্পীর জন্য এই গানটি লেখা হয়েছিল। কিন্তু ওই শিল্পী এই গানটি গাননি। কারণ তার স্ত্রীর মা, মানে শাশুড়ির নাম ছিল বনলতা। মাতৃতুল্য শাশুড়ির নামটি উনি গানে প্রেমিকার মত করে উপস্থাপন করতে চাননি। এই হচ্ছে, সেকেল নয় সেদিন, আর আজকের নৈতিকতার পার্থক্যের নমুনা।

আমি ছোটবেলা থেকেই গান শুনতে পছন্দ করি। তবে মাত্র কয়েকদিন আগেই হঠাৎ করে একটি গান শুনলাম ইউটিউবে। শুনে এত ভালো লাগল যে, ভাবতে লাগলাম এত সুন্দর গানটি কেন এতদিনে একবারও কানে এলো না? এরকম অসাধারণ জাগরণী সংগীত বাংলা সাহিত্যে খুব কমই আছে। খুঁজতে লাগলাম এর লেখক কে? লেখকের নাম দেখেতো আমি রীতিমতো হতবাক। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সেই গানের লেখক। অথচ জাতীয় কবির লেখা সব গানও আমরা এ দেশে গাই না। গানটি বারবার শুনলাম আর আবিষ্কারের চেষ্টা করতে লাগলাম কেন নজরুলের এই গানটি এদেশে গাওয়া হয় না। গানটি হলো- ‘বলো ভাই মাভৈমাভৈ, নবযুগ ওই এলো ওই।’ গানটি শুনলে আমার প্রাণে শক্তি আসে, মন পবিত্র হয়ে যায়। তবে চোর, ঘুষখোর আর ক্যাসিনো মালিক এবং তাদের সন্তানদের ভালো নাও লাগতে পারে।

বিজ্ঞাপন

স্বাধীনতার পরে আমার জন্ম, তাই স্বাধীনতার গল্প আমার মুখে মানায় না। মুক্তিযুদ্ধ নিজের চোখে দেখিনি। শুনেছি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে গণমাধ্যমের বড় ভূমিকা ছিল। মানুষের মধ্যে দেশাত্ববোধ জাগাতে, সৎ জীবন যাপনের ইচ্ছা জাগাতে গণমাধ্যমের অনেক বড় ভূমিকা থাকে। তবে এখনকার সময়ে গণমাধ্যম সে দ্বায়িত্ব বা ভূমিকা কতখানি পালন করছে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

এবার আসুন, একটু পিছন ফিরে তাকাই। হুমায়ুন আহমেদ-এর ‘কোথাও কেউ নেই’ নামে একটি নাটক ছিল। নাটকে বাকের ভাইয়ের অন্যায়ভাবে ফাঁসি দেওয়া হয়। ‘নাটকের’ ফাঁসি ঠেকাতে মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করে। নিছক একটি নাটক চরিত্র মানুষের বিবেককে এতটা নাড়িয়ে দিয়ে প্রতিবাদ করার জন্য তাদের রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছিল। এটাও কিন্তু আমাদের গণমাধ্যমেরই কাজ ছিল। অবশ্য এর পিছনে ভুবন বিজয়ী এক স্রষ্টার হাতের ছোঁয়া ছিল, যাকে আমরা এরই মধ্যে হারিয়ে ফেলেছি।

আমাদের দেশে দশ বছর আগেও কোনোদিন বাসের মধ্যে কেউ ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে শুনিনি। যদিও ব্যাপারটা এরই মধ্যে অনেকটা রেগুলার হয়ে গেছে। যতদূর মনে পড়ে, দিল্লিতে এক ডাক্তার মেয়ে বাসের মধ্যে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হন। তারপর থেকে আমাদের দেশেও বাসের মধ্যে ধর্ষণ শুরু হয়ে যায়। পৃথিবীতে দুইশ’র বেশি দেশ রয়েছে। পৃথিবীর কোথাও না কোথাও প্রতিদিনই কিছু ভালো কাজ হয়। সেটা কি নিউজ হতে পারে না? মানুষ সব সময়ই অন্যকে অনুসরণ করে। একটি ভালো খবর শুনে হয়তো কেউ-কেউ অনুসরণ করতেও পারে। বাসের মধ্যে ধর্ষণের সংবাদ শুনে অনুপ্রাণিত হলে, ভাল কাজেও হয়ত কেউ কেউ অনুপ্রাণিত হতে পারে। হাতি যেমন জানে না যে, সে কত বড়, তেমনি গণমাধ্যমও অনেক সময় তার ব্যাপক প্রভাব সম্পর্কে ধারণা হারিয়ে ফেলে।

বছর কয়েক আগে দেশে পেট্রোল বোমার কালচার চালু হয়েছিল। ওই সময় দেশের অনেক যানবাহনে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এমনকি আগুনে অনেক হতাহতের ঘটনাও ঘটে। তখন কোনো এক পত্রিকা বোমা কীভাবে বানাতে হয় তার বর্ণনা এত নিখুঁতভাবে লিখেছে যে, বিজ্ঞানের বইয়ে-ও এত নিখুঁতভাবে লেখা থাকে না। কি উদ্দেশ্যে পেট্রোল বোমা বানানোর সূত্র এত নিখুঁতভাবে লিখেছে জানা নেই। নেহাত মুর্খতা নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

লেখক: এফসিএ

সারাবাংলা/পিটিএম

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন