বিজ্ঞাপন

৩০ বছর ধরে নির্বাচনে একটিই ইস্যু ‘কালুরঘাট সেতু’

December 28, 2019 | 11:17 am

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর ওপর প্রায় ১০০ বছর আগে নির্মিত প্রথম সেতু, যা কালুরঘাট সেতু নামে পরিচিত। বয়সের ভার আর বিপুল যানবাহনের চাপে ক্রমশ নুয়ে পড়া এই একমুখী রেলসেতুটি দীর্ঘসময় ধরে দক্ষিণ চট্টগ্রামের একাংশের জনগণের বহুমুখী দুর্ভোগে পরিণত হয়েছে। বোয়ালখালী-পটিয়া উপজেলাসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষের প্রধান দাবি একটি রেল ও সড়কপথসহ বহুমুখী সেতু, যা গত প্রায় ৩০ বছর ধরে প্রতিটি সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের মূল প্রতিশ্রুতি হয়ে আসছে। কিন্তু প্রতিশ্রুতি থেকে গেছে প্রতিশ্রুতির জায়গায়, সেটার বাস্তব প্রতিফলন দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসী দেখেনি গত ৩০ বছরেও।

বিজ্ঞাপন

বোয়ালখালী উপজেলার গোমদণ্ডী পাইলট হাইস্কুলের প্রবীণ শিক্ষক মঞ্জুর আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘কালুরঘাট সেতুর অবস্থা এমন হয়েছে যে, প্রার্থীরা এলাকার মানুষের দুর্বল জায়গায় আঘাত করে এটাকে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার ইস্যু বানায়। একধরনের মূলা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে গত ২৫-৩০ বছর ধরে। কোনোমতে বৈতরণী পার হয়ে গেলে তারপর নানা তালবাহানা শুরু করেন। যে কারণে দেশে এত উন্নয়ন হচ্ছে, অথচ একটি সেতু হচ্ছে না। বলতে গেলে, কালুরঘাট সেতু এখন নির্বাচনী বৈতরণী পার হবার সহজ পন্থায় পরিণত হয়েছে।’

১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বার্মা ফ্রন্টের সৈন্য পরিচালনা করার জন্য কর্ণফুলী নদীতে ব্রিজ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ১৯৩০ সালে ব্রুনিক অ্যান্ড কোম্পানি ব্রিজ বিল্ডার্স নামে একটি সেতু নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান সেতুটি নির্মাণ করে। মূলত ট্রেন চলাচলের জন্য ৭০০ গজ লম্বা সেতুটি ১৯৩০ সালের ৪ জুন উদ্বোধন করা হয়। পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পুনরায় বার্মা ফ্রন্টের যুদ্ধে মোটরযান চলাচলের জন্য ডেক বসানো হয়। দেশ বিভাগের পর ডেক তুলে ফেলা হয়।

বিজ্ঞাপন

পরে ১৯৫৮ সালে সব রকম যানবাহন চলাচলের যোগ্য করে সেতুটির বর্তমান রূপ দেওয়া হয়। বৃটিশ আমলে নির্মিত ব্রিজটির রয়েছে ২টি এব্যাটমেট, ৬টি ব্রিক পিলার, ১২টি স্টীল পিলার ও ১৯টি স্প্যান। জরাজীর্ণ সেতুটির বয়স এখন ৮৯ বছর।

একমুখী সেতুটিতে ট্রেনের পাশাপাশি যানবাহনও চলে। বোয়ালখালী-পটিয়াসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষের একাংশের নগরের সঙ্গে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম এই কালুরঘাট সেতু। একমুখী সেতুর একপাশে গাড়ি উঠলে আরেকপাশ বন্ধ থাকে। ফলে দীর্ঘ যানজটের ভোগান্তি চলছে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে। এছাড়া লক্করঝক্কর সেতুর ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচলের ঝুঁকি তো আছেই।

বিজ্ঞাপন

নব্বইয়ের দশকের শুরুতে দেশ গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরুর পর ১৯৯১ সালে প্রথম সংসদ নির্বাচন থেকে কালুরঘাট সেতুর বিষয়টি রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে প্রার্থীদের প্রচারণা ও প্রতিশ্রুতিতে গুরুত্ব পেয়ে আসছে। ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনেও ছিল একই প্রতিশ্রুতি।

১৯৯৬-২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কালুরঘাটে রেলওয়ে সেতুর পাশে রেল কাম সড়ক সেতু নির্মাণের জন্য দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আবেদন জানানো হয়। কিন্তু সেসময় পাঁচ বছরে তারাও এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনের পর ক্ষমতায় আসে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট। প্রতিশ্রুতি ছিল কালুরঘাটে সেতু নির্মাণ করা হবে। সেতুর দুই পাড় নিয়ে গঠিত সংসদীয় আসন বোয়ালখালী-চান্দগাঁও থেকে নির্বাচনে জিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছিলেন বিএনপি নেতা এম মোরশেদ খান। এলাকার মানুষ আশায় বুক বেঁধেছিল। কিন্তু তৎকালীন সরকার প্রবল আপত্তি উপেক্ষা করে কালুরঘাটের বদলে আরও দক্ষিণে গিয়ে ‘শাহ আমানত সেতু’ নির্মাণ করে।

শিক্ষক মঞ্জুর আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এম মোরশেদ খান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। মানুষকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচিত হলেও তিনি কালুরঘাটে সেতু করার জন্য তিনি কোনো চেষ্টাই করেননি। এমনকি এলাকার প্রতি ওনার কোনো আন্তরিকতাও তার মন্ত্রীত্বের সময়ে আমরা দেখিনি।’

বিজ্ঞাপন

বোয়ালখালী-কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদের আহ্বায়ক মো. আব্দুল মোমিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘সেতু হওয়ার কথা ছিল কালুরঘাটে। কিন্তু আকস্মিকভাবে সেটা নিয়ে যাওয়া হয় আরও দক্ষিণে। বোয়ালখালী-পটিয়ার মানুষ তৎকালীন সরকারের এমন সিদ্ধান্তে হতবাক হয়ে যায়। শাহ আমানত সেতু যেখানে নির্মিত হয়েছে, সেখানে সেতু হলে কর্ণফুলী নদী ভরাট হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে সংকট তৈরি হবে বলে বিরোধিতা করেছিলেন প্রয়াত মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। অনেক আপত্তি উঠেছিল। কিন্তু বিএনপি সরকার কারও আপত্তির তোয়াক্কা করেনি।’

এরপর ২০০৮ সালে নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা লালদিঘীতে এক জনসভায় চট্টগ্রামের উন্নয়ন পরিকল্পনার মধ্যে কালুরঘাটে সেতু নির্মাণের কথা জানিয়েছিলেন। ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম বর্ষপূতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া বক্তব্যে কর্ণফুলী নদীর উপর আরেক কংক্রিট সেতু নির্মাণের আশ্বাস দিয়েছিলেন।

কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদে কোনো অগ্রগতি না দেখে ২০১৪ সালে মাঠে নামে বোয়ালখালী-পটিয়াসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ। বোয়ালখালী-কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদ নামে একটি নাগরিক সংগঠন গড়ে তুলে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন শুরু হয়। মূলত এর মাধ্যমেই প্রতিশ্রুতির গণ্ডী থেকে বেরিয়ে জোরালো হয় সেতুর ইস্যু। সংসদে সরব হন বোয়ালখালী-চান্দগাঁও আসনের সংসদ সদস্য জাসদ নেতা মঈনউদ্দিন খান বাদল। এরপর থেকে বারবার আশ্বাসের বৃত্তেই এখনও বন্দি হয়ে আছে কালুরঘাট সেতু।

বোয়ালখালী-কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদের আহ্বায়ক মো. আব্দুল মোমিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত ৩০ বছরে আমরা একজন সংসদ সদস্যই পেয়েছিলাম, যিনি সংসদে দাঁড়িয়ে এই সেতুর কথা বারবার বলেছেন। একমাত্র বাদল সাহেবই সেতু নিয়ে জনগণের দাবিকে সংসদে নিয়ে গেছেন। শুধু সংসদে নয়, জীবদ্দশায় তিনি এই দাবি নিয়ে রাজপথেও দাঁড়িয়েছিলেন। এখন তিনি নেই। নতুন যিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন, উনার কাছে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, প্রতিশ্রুতি-দাবি, কথার ফুলঝুরি আর মানুষ শুনতে চায় না। যদি জনগণের প্রতি দায়িত্ববোধ থাকে, তাহলে তিনি যেন অবশ্যই সরকারের কাছ থেকে একটি সেতু আদায় করে নিয়ে আসেন। জনগণের দাবি আদায় করতে না পারলে সংসদে গিয়ে লাভ কি?’

২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে কালুরঘাট সেতু প্রার্থীদের প্রথম ও প্রধান প্রতিশ্রুতিতে পরিণত হয়। গত ৭ নভেম্বর সংসদ সদস্য মঈনউদ্দিন খান বাদল মারা গেছেন। শূন্য হওয়া বোয়ালখালী-চান্দগাঁও আসনের উপ-নির্বাচন ১৩ জানুয়ারি। উপ-নির্বাচনের ডামাডোলে আবারও প্রার্থীদের মুখে উচ্চারিত হচ্ছে সেতুর প্রতিশ্রুতি।

আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোছলেম উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, নির্বাচিত হলে তার প্রথম ও প্রধান কাজ হবে কালুরঘাট সেতুর কাজ দৃশ্যমান করা। আর বিএনপির প্রার্থী আবু সুফিয়ান বলেছেন- নির্বাচিত হোন আর না-ই হোন, তিনি চান কালুরঘাট সেতু যেন হয়। তবে নির্বাচনী প্রচারণায় আবু সুফিয়ানও তুলে ধরছেন সেতুর কথা।

মোছলেম উদ্দিন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঘোষণা দিয়েছেন কালুরঘাটে দুটি সেতু হবে। একটি রেলসেতু, আরেকটি সড়ক সেতু। আমি নির্বাচিত হলে সরকারের উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ করে যে কোনোভাবে এক বছরের মধ্যে সেতুর কাজ শুরু করব।’

আবু সুফিয়ান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি এটাকে মূল নির্বাচনী ইস্যু বানাতে চাই না। এতবছর ধরে একটি সেতুর জন্য লাখ লাখ মানুষ কষ্ট পাচ্ছে, এটাকে ইস্যু হিসেবে মানুষের কাছে তুলে ধরতেও লজ্জা লাগে। আমি বলছি, আমি এমপি হতে পারি আর না পারি, সেতুটা যেন হয়।’

দক্ষিণ কোরিয়া ও বাংলাদেশের যৌথ অর্থায়নে ১ হাজার ১৬৪ কোটি ৯৮ লাখ ৮৯ হাজার টাকা ব্যয়ে সেতু নির্মাণের চূড়ান্ত নকশা প্রণয়ন করা হয়েছিল। ২০১৮ সালের মার্চে কাজ শুরু করে ২০২৩ সালে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ২০১৮ সালে একনেক বৈঠকে নকশায় ত্রুটি ধরা পড়ার পর কার্যত সেই উদ্যোগ পরিত্যক্ত হয়েছে।

এ নিয়ে প্রয়াত সংসদ সদস্য মঈনউদ্দিন খান বাদল জীবদ্দশায় ২০১৯ সালে আন্দোলন শুরু করেন। চলতি বছরের অক্টোবরে চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের এক সভায় এসে ওবায়দুল কাদের দু’টি সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। ঘোষণা এলেও বাস্তবে এর দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ দেখছেন না দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষ।

বোয়ালখালী-কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক মুস্তফা নঈম সারাবাংলাকে বলেন, “দু’টি সেতুর জন্য আলাদা দু’টি নকশা প্রণয়ন করতে হবে। ফান্ডিংয়ের বিষয় আছে। আমলাতান্ত্রিক বিষয় আছে। প্রক্রিয়াটা দ্রুত শুরু করা না হলে আবারও ঝুলে যেতে পারে। আমরা চাই না, সেতুটা কোনো রাজনৈতিক বা নির্বাচনী কথার মারপ্যাঁচে পড়ুক। এটা দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষের প্রধান দাবিতে পরিণত হয়েছে।’ বছরের পর বছর ধরে মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। মানুষের কষ্ট নিয়ে রাজনীতি আমরা চাই না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

সারাবাংলা/আরডি/এমও

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন