বিজ্ঞাপন

তাবিথ-ইশরাক: তারেকের দুই ‘ক্রীড়নক’ প্রার্থী

January 17, 2020 | 2:46 pm

ঢাকা: ২৮ এপ্রিল ২০১৫। সকাল সাড়ে ১১টা। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল তখন মিরপুর পল্লবীর একটি ভোটকেন্দ্রে। হঠাৎ করে তার সেলফোন বেজে উঠল। ও প্রান্তে তার নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ— ‘তাবিথ, তুমি চলে আসো। আমরা এখনই ভোট বর্জনের ঘোষণা দেবো!’ তাবিথের উত্তর, ‘স্যার, আমি আরেকটু দেখতে চাই।’ কিন্তু মওদুদ সাফ জানিয়ে দেন, ‘না না, ১২টার আগেই ঘোষণা দিতে হবে। পরে দিলে সেটা কাউন্ট হবে না। এখনই দিতে হবে।’

বিজ্ঞাপন

তাবিথকে ফোন দেওয়ার আগে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বিএনপির চেয়ারপারসনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু তখন যেহেতু সকাল সাড়ে ১১টা, তাই খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা বলা ‘সম্ভব হয়নি’! তার বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাস নিজেই সিদ্ধান্ত দিয়ে দেন, ‘ভোট বর্জনের ঘোষণা এখনই দিতে হবে। প্রার্থীদের বলুন, মিডিয়ার সামনে ঘোষণা দিয়ে দিতে।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাবিথ সেবার ছিলেন খালেদা জিয়া ও তার বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাসের ক্রীড়নক। আর এবার খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমানের ক্রীড়নক। খালেদা জিয়া-শিমুল বিশ্বাস সেবার ছড়ি ঘুরিয়েছেন তাবিথ আউয়াল-মির্জা আব্বাসের ওপর। এবার তারেক রহমান ছড়ি ঘুরাবেন তাবিথ-ইশরাকের ওপর। পাপেট খেলার মতোই তাদের দু’জনকে নিয়ে খেলবেন তারেক।

দলীয় সূত্রমতে, ভোটার সংখ্যা ও গুরুত্ব বিবেচনায় বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহৎ ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির বেশিরভাগ নেতা চেয়েছিলেন দক্ষিণে মির্জা আব্বাস এবং উত্তরে সিনিয়র কোনো নেতা প্রার্থী হবেন। কিন্তু তারেক রহমানের একক সিদ্ধান্তে দক্ষিণে সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার পুত্র ইশরাক হোসেন আর উত্তরে প্যারাডাইস পেপারস কেলেঙ্কারিখ্যাত আব্দুল আউয়াল মিন্টুর ছেলে তাবিথ আউয়ালকে প্রার্থী করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি, বিএনপির বিশেষ সম্পাদক, অভিজ্ঞ রাজনীতিক ড. আসাদুজ্জামান রিপন উত্তরের জন্য মনোননয় ফরম কিনলেও তার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। বরং ২০১৬ সালে পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারি এবং ২০১৭ সালে প্যারাডাইস পেপারস কেলেঙ্কারিতে নাম আসা তাবিথ আউয়ালকেই মেয়র প্রার্থী হিসেবে বেছে নিয়েছেন তারেক রহমান।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেবল বিলাসী জীবনের অর্থ জোগাতে দলের অভিজ্ঞ, ক্লিন ইমেজ ও অপেক্ষাকৃত সৎ ব্যক্তিদের রেখে ‘ধনকুবের’ তাবিথ আউয়ালকে প্রার্থী করেছেন তারেক রহমান। যদিও তার বিরুদ্ধে কর ফাঁকি দিয়ে বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়া, আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দেশের টাকা বিদেশে পাঠানো, অবৈধ আয়ের টাকায় ‘বৈধ’ ক্ষমতার মালিক হতে গোপনে অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের টাকা বিদেশে বিনিয়োগের অভিযোগ রয়েছে। একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, আব্দুল আউয়াল মিন্টুর ছেলে তাবিথ আউয়ালের বিদেশে বিনিয়োগ করা সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার।

সম্প্রতি বাংলাদেশের কয়েকজন প্রতিথযশা অর্থনীতিবদি ও আইনজ্ঞ এক সেমিনারে বলেন, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর প্রচুর অর্থ বিভিন্ন দেশে পাচার হয়। কিন্তু গরীবদের এ অর্থ পাচারের সুযোগ নেই। তাদের তো আর সুইস ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট থাকে না! অঢেল অর্থ থাকলে কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য বারমুডা যে স্বর্গরাজ্য, সে তথ্যও তাদের অজানা।

বিজ্ঞাপন

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেভরন কোম্পানির বাংলাদেশি এজেন্ট বিএনপি নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টু ও তার পুত্র তাবিথ আউয়াল সেই ‘স্বর্গরাজ্যে’র খবর ভালো করেই জানেন। তাদের বিরুদ্ধে এ বিষয়ে সুনির্দষ্ট অভিযোগও উঠেছে।

একটি অসমর্থিত সূত্রে জানা গেছে, বিপুল সম্পদের মালিক তাবিথ আউয়াল লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমানের বিলাসী জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের অন্যতম জোগানদাতা। সে কারণেই বেশিরভাগ শীর্ষ নেতার অসম্মতি থাকা সত্ত্বেও তাবিথ আউয়ালকে মনোনয়ন দিয়েছেন তারেক। সম্প্রতি লন্ডন সফরে গিয়ে তারেক রহমানকে নগদ সাড়ে ৩ কোটি টাকাও দিয়ে এসেছেন তিনি।

তারপরও তারেকের ‘ক্রীড়নক’ তাবিথ আউয়াল শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের মাঠে থাকতে পারবেন— এমন বিশ্বাস ও আস্থা বিএনপির নেই। গতবার ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের মাধ্যমে শিমুল বিশ্বাসের ‘হুকুমনামা’ কানে পৌঁছানো মাত্রই যেমন মাঠ ছাড়তে হয়েছিল তাবিথকে, এবারও যে তেমনটি ঘটবে না— তার কোনো নিশ্চয়তা তিনি নিজেও দিতে পারছেন না। সেবারের মতো এবারও তার নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সেই ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। আর হুকুমদাতা হিসেবে শিমুল বিশ্বাসের জায়গায় এবার তারেক রহমান।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ঢাকা উত্তরের মতো দক্ষিণের প্রার্থী বাছাইয়েও যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, ত্যাগ, জনপ্রিয়তার চেয়ে অর্থের বিষয়টি বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকা তার জীবদ্দশায় খালেদা জিয়ার বিলাসী জীবনের ভরণপোষণ থেকে শুরু করে ‘হাওয়া ভবন’-এ অর্থের অন্যতম জোগানদাতা ছিলেন। তারেক রহমানের লন্ডন জীবনের অর্থের জোগানদাতাও ছিলেন ইশরাকের হোসেনের বাবা সাদেক হোসেন খোকা।

বিজ্ঞাপন

আর সে কারণেই মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাস, ঢাকা দক্ষিণের সভাপতি হাবীব-উন-নবী খান সোহেল, সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল বাশার আগ্রহ দেখালেও ‘ধনকুবের’ ইশরাক হোসেনকেই বেছে নেন তারেক রহমান। কারণ, আব্বাস দম্পতির টাকা থাকলেও তাদের সঙ্গে মনোনয়ন বাণিজ্য করার সুযোগ তারেক রহমানের নেই। আগ্রহী বাকি দুই নেতা হাবীব-উন-নবী খান সোহেল আর কাজী আবুল বাশারের পক্ষে নগদ টাকা ছিটানো সম্ভব না।

তাই অনভিজ্ঞ হওয়া সত্ত্বেও কেবল বিপুল অর্থ থাকায় ঢাকা দক্ষিণের জন্য ইশরাক হোসেনকে বেছে নিয়েছেন তারেক রহমান। এই প্রার্থীর বিরুদ্ধেও সম্পদের তথ্য গোপন করার একটি মামলার বিচারকাজ সম্প্রতি শুরু হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলেছেন, চরম সংকটের মধ্যে থেকেও কেবল ‘ভুল’ নেতৃত্বের কারণে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না বিএনপি। লন্ডনে বসে একের পর এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত দলের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তার সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়া মানেই দল থেকে ছিটকে পড়া। সম্প্রতি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খানও তারেক রহমানের একক আধিপত্যের অভিযোগ তুলে দলত্যাগ করেছেন।

তবে তারেক রহমানের ব্যাপারে প্রকাশ্যে মিডিয়াতে কথা বলতে রাজি নন দলের কেউ। দলের বেশিরভাগ নেতার বক্তব্য, বিএনপির অখণ্ডতা রক্ষা ও সংকটকাল উত্তরণের জন্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারেকের নেতৃত্ব মেনে নিতে হচ্ছে সবাইকে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য সারাবাংলাকে বলেন, ‘ধানের শীষে নির্বাচনের জন্য নেতা লাগে না। নয়াপল্টন কার্যালয়ের একজন পিয়নকে ধানের শীষে দাঁড় করিয়ে দিলে সে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে। কারণ, এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় নৌকা-ধানের শীষে। আর সেই সুযোগটাই নেন তারেক রহমান। প্রার্থী বাছাইয়ে তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।’

সারাবাংলা/টিআর

Tags: , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন