February 21, 2018 | 10:54 pm
মাহবুব স্মারক, অতিথি প্রতিবেদক
ঢাকা: রাষ্ট্রীয় নানা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাঝে-মাঝেই টানেন পুরনো দিনের উদাহরণ। তা-ও আবার হাস্যরসের ছলে। কথাগুলো সাবলীল-সহজ, বলেন হালকা চালে— তবে থাকে গূঢ় ভাব। কখনো সেই কথায় পড়ে হাসির রোল, কখনো সকলেই অবাক হয়ে শোনেন।
তেমনি একটি পরিবেশ ছিল বুধবার (২১ ফেব্রুয়ারি) মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আলোচনা সভায়। রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে এই আলোচনায় পাকিস্তান শাসনামলে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে তৎকালীন শাসক শ্রেণির ষড়যন্ত্রের নানা রকম-ফের জানাচ্ছিলেন প্রধানমন্ত্রী।
বললেন, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র আর তা রুখে দিতে কী যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছিল বাঙালিকে।
শেখ হাসিনা বলেন, `নতুনপ্রজন্ম এর অনেক কিছুই জানে না, তাদের জানানো দরকার। তাদের জানা দরকার, ভাষার জন্য সেই সংগ্রাম কেমন ছিল?’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘...একদিন বলা হলো, চিরায়ত হরফে বাংলা লেখা যাবে না। লিখতে হবে আরবি হরফে।’ ‘বাঙালি মানবে কেন?’ নিজেই প্রশ্ন করে নিজেই তার উত্তরে বললেন, ‘হলো প্রতিবাদ। পাকিস্তানি ষড়যন্ত্র টিকল না।’
‘আবার চেষ্টা হলো, রোমান হরফে বাংলা লিখতে হবে। বাঙালি ঠেকিয়ে দিল সেই ষড়যন্ত্রও’, বলেই চলেছেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “ররি ঠাকুর কিংবা কাজী নজরুল, কারো বিষয়ে ছাড় ছিল না। একবার পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ঘোষণা দিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোনো লেখা কেউ পড়তে পারবে না, তার গান গাওয়া যাবে না। রবীন্দ্রনাথ হিন্দু! তার লেখা পড়লে মুসলমানিত্ব নষ্ট হয়ে যাবে। তাই সেটা নিষিদ্ধ! আর আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল যে সকল কবিতা লিখেছেন, সেগুলো পরিবর্তনের চেষ্টা হলো। লেখাগুলোকেও ‘মুসলমানি ভাষা’ দেওয়া হলো। যেমন, কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’ কবিতার শব্দ বদলের চেষ্টা হলো...
‘আমরা টুটাব তিমির রাত, বাধার বিন্ধ্যাচল।
নব নবীনের গাহিয়া গান সজীব করিব মহাশ্মশান’
‘সজীব করিব মহাশ্মশান’ এইখানে ‘মহাশ্মশান’ পরিবর্তন করা হলো। লেখা হয়েছিল...
‘নব নবীনের গাহিয়া গান সজীব করিব গোরস্তান’…” কবিতা সরাসরি উদ্ধৃতি করেই বলছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এতে দর্শক সারিতে পড়ে যায় হাসির রোল।
শেখ হাসিনা আরও উদাহরণ টানলেন এক এক করে... বললেন প্রচলিত অনেক কবিতা-ছড়াতেও পরিবর্তনের চেষ্টা করত পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী।
মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ছড়া ‘আমার পণ’-এর প্রথম লাইন যেমন ছিল...
‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি,
সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি’
এমন সব লাইনও বদলে দিয়ে লেখার চেষ্টা হলো...
‘ফজরে উঠিয়া আমি দেলে দেলে বলি
সারা দিন আমি যেন সাচ্ছা হয়ে চলি’
আবার উদ্ধৃতি করলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর মুখে এমন ছড়া শুনে আরেক দফা হেসে উঠলেন সবাই।
থামলেন না প্রধানমন্ত্রী, দুঃখ করে জানালেন, তাদের সময় বাংলা ভাষা নিয়ে যে যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে, তা এখনকার প্রজন্ম ধারণাও করতে পারবে না।
জানালেন, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রী ছিলেন। সেই সময় বাংলা বিভাগের শিক্ষক ছিলেন, মুহম্মদ আব্দুল হাই। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন মুনায়েম খাঁ। আর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট তখন আইয়ুব খান। সে সময়ে রবীন্দ্রনাথের লেখা গান করা নিষিদ্ধ হলে আন্দোলন শুরু হয় গোটা দেশে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেই আন্দোলনের অংশ ছিল।
আবারও শোনালেন গল্প, “...একদিন গভর্নর মুনায়েম খাঁ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন বাংলা বিভাগের প্রধান আব্দুল হাইকে ডাকলেন। হাই সাহেব অত্যন্ত অমায়িক, নরম মনের মানুষ। রবি ঠাকুরের গান নিষিদ্ধের প্রতিবাদে আন্দোলনে বিরক্ত মুনায়েম খাঁ। হাই সাহেবকে রাগত স্বরেই বললেন...‘ধূরও মিয়া আপনেরা খালি রবীন্দ্র সংগীত, রবীন্দ্র সংগীত করেন কে? আপনেরা নিজেরা রবীন্দ্র সংগীত লিখ্যা ফালাইতে পারেন না...?’ হাই সাহেব বিনয়ের সাথে মুনায়েম খাঁকে বললেন, ‘স্যার আমরা তো লিখতে পারি, কিন্তু আমি লিখলে তো সেটা ‘রবীন্দ্র সংগীত’ হবে না, হবে ‘হাই সংগীত’।” এই গল্পেও গোটা অডিটোরিয়ামে হাসির শব্দ।
এমন উদাহরণ, হাস্যরসের পাশাপাশি সরকার প্রধান এ কথাও মনে করিয়ে দিতে ভুললেন না যে, বাংলা ভাষার চর্চার কথা ভুলে গেলে চলবে না। রক্তের দামে কেনা বাংলা ভাষার সাথে বাঙালিত্বেরও চর্চা করতে হবে। নতুন প্রজন্মকে সেই বাঙালিত্বের শিক্ষাও দিতে হবে।
সারাবাংলা/আইজেকে/এমএম