বিজ্ঞাপন

হায় সম্প্রীতির বাংলাদেশ!

January 31, 2020 | 9:44 am

প্রভাষ আমিন

২৮ জানুয়ারি রাতে ফেসবুকে পরিচিত একজন ইনবক্সে একটি বার্তা পাঠালেন। আমি ব্যস্ত ছিলাম বলে হুবহু সেই বার্তাটিই স্ট্যাটাস আকারে তুলে দিয়েছিলাম। বার্তায় মূল কথা ছিল, মিরপুর ২ নম্বরে গভর্নমেন্ট অফিসার্স কমপ্লেক্সে তারা সরস্বতী পূজা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু করতে পারছেন না। সঙ্গে তার কিছু বেদনার কথাও ছিল।

বিজ্ঞাপন

ফেসবুকে ওই স্ট্যাটাসে তিনশ জন মন্তব্য করেছেন, অনেকে শেয়ারও করেছেন। মন্তব্যের ঘরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিল। কেউ পূজা করতে না দেওয়ার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। কেউ কেউ এ না দেওয়াকে সমর্থন করেছেন এবং যথারীতি অনেকে আমাকে অশ্লীল গালাগাল করেছেন। আবার অনেকে আমার বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়ার অভিযোগ এনেছেন।

অনেকে বলেছেন, কোনোরকম যাচাই ছাড়া ইনবক্সে পাওয়া এমন স্পর্শকাতর বার্তা পাবলিক স্ট্যাটাস দেওয়া ঠিক হয়নি। যিনি বার্তাটি পাঠিয়েছেন, তাকে বিশ্বাস করা যায়। কিন্তু তবুও মনে একটু খচখচানি থেকেই গেল। যদিও ফেসবুক আমার সাংবাদিকতার জায়গা নয়, তবুও দুই পক্ষের সঙ্গে কথা না বলেই এমন একটি বিষয় তুলে ধরায় অস্বস্তি হচ্ছিল। পরে বুধবার ও বৃহস্পতিবার বিষয়টি নিয়ে অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। আমার স্ট্যাটাস দেখে আরও অনেক সাংবাদিকও যোগাযোগ করেছেন। পুলিশের সঙ্গেও কথা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আগ্রহীরা পূজাটা করতে পারেননি। ইনবক্স বার্তা দিয়ে যে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম, বাস্তব অবস্থা তার চেয়েও খারাপ!

এবার গভর্নমেন্ট অফিসার্স কমপ্লেক্স সম্পর্কে একটু বলি। মিরপুর ২ নম্বরে কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল লাগোয়া এই আবাসিক এলাকায় ছয়টি ১৬ তলা ভবন আছে। এসব ভবনে মোট ৩৬০টি পরিবার বাস করে। এর মধ্যে ৪৪টি পরিবার হিন্দু সম্প্রদায়ের। ভবনগুলো সরকারেরই বানানো। আবেদনের ভিত্তিতে সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা সরকারের কাছ থেকে ফ্ল্যাট কিনে নিয়েছেন। এর অর্থ, এখানে বর্তমান বা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তারাই থাকেন।

বিজ্ঞাপন

২০১৫ সালে এই আবাসিক এলাকায় মানুষ বসবাস শুরু করেন। ছয়টি আবাসিক ভবনের পাশাপাশি আরেকটি কমন ভবন আছে। সপ্তম ভবনটির নিচ তলা ও দোতলায় মসজিদ, চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় কমিউনিটি সেন্টার, এছাড়া দোকান, সেলুন, কমিটির অফিস ইত্যাদি আছে সেই ভবনে।

এবারই প্রথম হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন তাদের ক্যাম্পাসে সরস্বতী পূজা করার উদ্যোগ নেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা চেয়েছিলেন, ৭ নম্বর ভবনের কমিউনিটি সেন্টারে পূজা করবেন। কারণ ওইখানেই সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো আয়োজন করা হয়ে থাকে। কিন্তু কমিটির লোকজন তাতে আপত্তি জানিয়ে বলেন, যে ভবনের নিচে মসজিদ, তার ওপরে পূজা করতে দেওয়া যাবে না।

এরপর হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন সামনের চত্বরে পূজা করতে চেয়েছিলেন। এই চত্বরে বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান হয়। কিন্তু কমিটির লোকদের তাতেও আপত্তি। তাদের দাবি, এখানে জানাজার নামাজ হয়, তাই এখানে পূজা করা যাবে না। এরপর ঠিক হয়, পানির পাম্পের পাশে গ্যারেজের মতো ছোট একটা জায়গা আছে, সেখানে সরস্বতী পূজা হবে। কিন্তু সেখানেও বাগড়া দেন ‘ধর্মপ্রাণ’ মুসলমানরা। কারণ সেই জায়গায় কুরবানি হয় এবং মরদেহ ধোয়ানো হয়। পূজা করতে দিয়ে সেই জায়গাটিকে তারা ‘অপবিত্র’ করতে দিতে পারেন না। শেষ পর্যন্ত এত বড় কমপ্লেক্সে সরস্বতী পূজা করার মতো একটি জায়গা খুঁজে পাওয়া যায়নি!

বিজ্ঞাপন

সরস্বতী পূজার দিন ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটগ্রহণের দিন নির্ধারিত ছিল। তীব্র আন্দোলন আর প্রতিবাদের মুখে নির্বাচন কমিশন ভোটগ্রহণের তারিখ দু’দিন পিছিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। অথচ ৪৪টি হিন্দু পরিবার চেয়েও সরস্বতী পূজা করার সুযোগ পায়নি!

কথাটি শোনার পর ফেসবুকের অনেকের মতো আমারও বিশ্বাস হয়নি। তারা অবশ্য পূজাটি করার জন্য অনেক চেষ্টা করেছে। মিরপুর মডেল থানায়ও তারা গিয়েছে। কিন্তু পুলিশ তাদের বলে দিয়েছে, তারা এখন নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। এখন এই ‘ঝামেলা’ মেটানোর সুযোগ তাদের নেই। পুলিশ অবশ্য অন্য কোথাও পূজাটি করার পরামর্শ দিয়েছে।

ধর্মনিরপেক্ষতা যে দেশের সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি, সেই দেশের রাজধানীতে হিন্দুরা তাদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব উদযাপনের অনুমতি পায় না, এটা আসলে অবিশ্বাস্য। তার চেয়েও অবিশ্বাস্য সেই কমপ্লেক্সে যারা থাকেন, তারা সবাই সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তাদের মাথায় যদি সাম্প্রদায়িকতার এমন নোংরা চিন্তা বাসা বেঁধে থাকে, সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আমরা কী আশা করব?

কমিটির লোকজন নাকি শেষ পর্যন্ত বলে দিয়েছেন স্কুলে বা বাসায় সরস্বতী পূজা করতে। কমিটি বৈঠক করে এ সিদ্ধান্তও নিয়েছে, ওই কমপ্লেক্সে পূজা করতে দেওয়া হবে না। কী ঔদ্ধত্য! সরকারের বড় পদে চাকরি করছেন, তারা নিশ্চয়ই জানেন, তাদের এ সিদ্ধান্ত সংবিধান পরিপন্থি। তার চেয়েও বড় কথা, তাদের এ সিদ্ধান্ত ইসলাম ধর্মের মূল চেতনারও পরিপন্থি। ইসলাম শান্তির পথে সবাইকে আহ্বান জানায়। কিন্তু কখনোই অন্য কারও ধর্ম পালনে বাধা দেয় না। নির্বাচনের পর হলেও পুলিশ সেই কমপ্লেক্সের কমিটির কর্তাদের ডেকে এই অসাংবিধানিক ও অনৈসলামিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ ও এখতিয়ার জানতে চাইতে পারে। ভবিষ্যতে যেন কমপ্লেক্সের সব ধর্মের মানুষ নির্বিঘ্নে, নিরাপদে ধর্ম পালন করতে পারে, সেটিও যেন নিশ্চিত করা হয়।

বিজ্ঞাপন

সেই কমপ্লেক্সের সেই বাসিন্দা আমাকে লিখেছিলেন, ‘এখানে কমপ্লেক্সের ভেতরেই মসজিদ, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে সবাই। প্রতি শুক্রবার বয়ান হয় মাইকে, বেশ উচ্ছশব্দেই হয়। কই, আমরা তো কখনো কমপ্লেইন করি না। আর আমরা ভয়ে জোরে উলুধ্বনি দিতে পারি না। দেশটা যদি শুধু মুসলমানদের হয়, আমাদের জানিয়ে দেওয়া হোক, তাড়িয়ে দেওয়া হোক।‘

আমি তার বেদনার সঙ্গে একমত, কিন্তু যুক্তির সঙ্গে নই। বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এখানে সবার নিজ নিজ ধর্ম পালনের পূর্ণ অধিকার আছে। মসজিদে দিনে পাঁচ বার আজান হবে, মুসলমানরা নামাজ পড়বেন। শুক্রবার জুমার নামাজের আগে মাইকে ধর্মীয় বয়ান হবে। হিন্দুরা তাদের পূজা করবেন। বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানরাও তাদের ধর্মীয় উৎসব পালন করবেন। এটাই এই ভূখণ্ডের মানুষের ঐতিহ্য। এই দেশের মসজিদ-মন্দির পাশাপাশি থাকে, আজানের সময় পূজার আনুষ্ঠানিকতা বন্ধ থাকে। মুসলমান যুবকরা পাহারা দেয় হিন্দু বা বৌদ্ধ মন্দির।

যিনি আমাকে ইনবক্সে খবরটি জানিয়েছিলেন, পরদিনই তিনি ভয় পেয়ে গেছেন। আমার স্ট্যাটাসের পর বিষয়টি আলোচনা হয়েছে, অনেকেই থানায় বা কমপ্লেক্সের কমিটির কাছে ফোন করেছেন। তাতে কেউ কেউ আমার সংবাদদাতাকেও সন্দেহ করছেন। পূজা করতে না পেরে তার যতটা মন খারাপ, সেই মন খারাপের কথা জানাজানি হয়ে যাওয়ার শঙ্কায় তিনি তার চেয়ে বেশি আতঙ্কিত। তাই তিনি পরে আমাকে জানিয়েছেন, যেন এ বিষয়ে আমি আর কিছু না করি। যাদের সঙ্গে একই কমপ্লেক্সে বছরের পর বছর থাকছেন, তাদের ভয়েই তিনি জড়োসড়ো। এই বেদনার আসলে কোনো সীমা নেই।

তার এই আতঙ্ক আমাকে লজ্জিত করেছে। যে দেশের সংখ্যালঘুরা যত ভীত, ধরে নিতে হবে সে দেশের সংখ্যাগুরুরা তত খারাপ। সংখ্যাগুরুদের দায়িত্ব হলো সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করা, তাদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের অভয় দেওয়া। আমি তাকে বলেছি, মিরপুরের একটি কমপ্লেক্স দিয়ে বাংলাদেশকে বিবেচনা করা ঠিক হবে না। কিন্তু তিনি উল্টো আমাকে বলেন, ‘এখানে সব শিক্ষিত লোকের বাস। এখানেই যদি এই অবস্থায় পড়তে হয়, তাহলে সারাদেশের পরিস্থিতি কী?’ আমি কোনো জবাব দিতে পারিনি।

তবে আমি এখনও বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশ। সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান থেকে এই চেতনাতেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান ক্রমশ অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। ভারতও এখন চরম সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে। বাংলাদেশই এই অঞ্চলের অসাম্প্রদায়িক চেতনার শেষ ভরসা হয়ে থাকুক। যেখানে সব ধর্মের মানুষ নিশ্চিন্তে তাদের নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারবে।

সারাবাংলা/টিআর

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন