বিজ্ঞাপন

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বরাবরের মতোই ‘দ্বিমুখী’ চীন

February 17, 2020 | 4:35 pm

এম এ কে জিলানী, স্পেশাল কসেপন্ডেন্ট

ঢাকা: রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীন বরাবরের মতোই দ্বিমুখী আচরণ চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারকে বন্ধু দেশ হিসেবে আখ্যায়িত করলেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে একাধিকবার বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করেছে চীন, যা মিয়ানমারের পক্ষে গেছে। ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং সোমবার (১৭ ফেব্র্রুয়ারি) গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে অনেক কৌশল করে কথা বললেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের দ্বিমুখী আচরণের বিষয় লুকাতে পারেননি।

বিজ্ঞাপন

ডিপ্লোমেটিক করেসপন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডিকাব) আয়োজিত ‘ডিকাব টক’ অনুষ্ঠানে সোমবার কথা বলেন চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। অনুষ্ঠানটি জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত হয়। বরাবরের মতোই সোমবারের অনুষ্ঠানেও চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেন, ‘রাখাইনে সহিংসতা বন্ধ করতে হবে। সেখানে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ না করলে বাংলাদেশের একাধিক শিবিরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা ফেরত যেতে উৎসাহিত হবে না। এই সংকট দ্বিপাক্ষিকভাবে সমাধান করতে হবে। চীন এই সংকট সমাধানে সহায়তা করে যাচ্ছে।’

চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং আরও বলেন, ‘চীনের উদ্যোগে নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশ, চীন এবং মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে গত ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ছিল দ্রুত প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা। ওই বৈঠকের পর ত্রিপক্ষীয় ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়। এই গ্রুপ কাজ করছে। আমরা বিশ্বাস করি যে খুব দ্রুত এই সংকট মিটে যাবে।’


অথচ পর্যালোচনায় দেখা দেখে যে, কমবেশি গত দুই বছরেও এই সংকট মেটাতে ত্রিপক্ষীয় ওই গ্রুপ তেমন কার্যকর কোনো ফল দেখাতে পারেনি। এই গ্রুপের সর্বশেষ বৈঠক হয়েছে প্রায় ৬ মাস আগে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিয়ানমারের অনাগ্রহের কারণে আর কোনো বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে না।

বিজ্ঞাপন

গণমাধ্যমকর্মীদের একাধিক প্রশ্নের জবাবে চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট দ্বিপাক্ষিকভাবে সমাধান হবে, চীন এমনটাই চায়।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে লি জিমিং বলেন, ‘চীন মনে করে যে বাংলাদেশ-মিয়ানমার দুই বন্ধুপ্রতিম দেশ। রোহিঙ্গা নিয়ে এই দুই দেশের মধ্যে যে সংকট চলছে সেখানে চীনের মতো একটি রাষ্ট্র মধ্যস্ততার কাজ করতে পারে।’

অন্য একটি প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার দুইটি রাষ্ট্রই চীনের বন্ধু দেশ। বন্ধুত্বের পর্যায় থেকে চীন বন্ধু দেশগুলোকে পরামর্শ দিতে পারে কিন্তু কোনো দেশকে কোনো বিষয়ে চাপ দিতে পারে না।’

চীনের রাষ্ট্রদূতের সোমবারের (১৭ ফেব্র্রুয়ারি) রোহিঙ্গা সংকট ঘিরে এসব মন্তব্য পর্যবেক্ষণ করলেই পরিস্কার হয় যে, দেশটি এই ইস্যুতে দ্বিমুখী আচরণ চালিয়ে যাচ্ছে। কেননা, চীন বলছে যে রাখাইনে সহিংসতা বন্ধ করতে হবে। কিন্তু এই সহিংসতা বন্ধ করার জন্য এখন পর্যন্ত মিয়ানমার সরকারকে চীন কিছু বলেছে, এমন নজির নেই। আবার একদিকে, চীন বলছে যে রোহিঙ্গা সংকট দ্বিপাক্ষিকভাবে মেটাতে হবে। সঙ্গে এও বলছে, দুই দেশের মধ্যে এই সংকট মেটাতে চীন মধ্যস্থতা করতে পারে। অর্থাৎ এই সংকট চীন নিজের মতো করে জিইয়ে রাখতে চায়।

বিজ্ঞাপন


অন্যদিকে, চীন বাংলাদেশকে বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত করলেও জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে বারবার ভেটো দিয়ে মিয়ানমারের স্বার্থ রক্ষা করছে।

চীনের এই কৌশলী দ্বিমুখী আচরণ রাষ্ট্রদূত লি জিমিংয়ের সোমবারের (১৭ ফেব্রুয়ারি) মন্তব্যে প্রকাশিত। রোহিঙ্গা ইস্যুতে একাধিকবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে চীনের ভেটো দেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেন, ‘এই ইস্যুটি এখন আর নিরাপত্তা পরিষদে উঠবে না। চীনও ভেটো দেবে না।’

আইসিজে’তে (জাতিসংঘের আর্ন্তজাতিক বিচারিক আদালত) রোহিঙ্গা বিষয়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অর্ন্তবর্তীকালিন আদেশ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমকর্মীরা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং এর কাছে প্রশ্ন করলেও তিনি এই বিষয়েও কৌশল অবলম্বন করেন। রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘এটা আদালতের বিষয়। তারা তাদের মতো করে যথা সময়ে আদেশ দিবেন। এই বিষয়ে মন্তব্য করা ঠিক না।’


অথচ আইসিজে গত ২৩ জানুয়ারি অর্ন্তবর্তীকালীন আদেশ দেওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিঙ মিয়ানমার সফর করেন। গোটা বিশ্ব যখন মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে চাপে রেখেছে ঠিক তখনই চীনের রাষ্ট্রপতির মিয়ানমার সফর রোহিঙ্গা গণহত্যার অনুমোদনকারী অং সান সুকিকে নির্ভরতা যুগিয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনে ‘শি’স মিয়ানমার ভিজিট এন্ড চায়নাস রিজিওনাল ডিপ্লোমেসি’ শীর্ষক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সময়ে (আইসিজে অর্ন্তবর্তীকালিন আদেশ দেওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে) চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিঙ এর মিয়ানমার সফরের তিনটি কারণ রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম কারণ হচ্ছে, চীনের রাষ্ট্রপতি এমন এক সময়ে মিয়ানমার সফর করছেন যখন দেশটির সরকার সংখ্যালঘু এবং ভীন্ন মতালম্বীদের নির্যাতনের কারণে বিশ্বব্যাপী নিন্দিত হচ্ছে এবং মিয়ানমার আর্ন্তজাতিক চাপের মুখে রয়েছে। আর এই সুযোগকেই কাজে লাগাতে চায় চীন। দুর্দিনে বন্ধু দেশের পাশে দাঁড়িয়ে সাহস দিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ট করতে চায়। যাতে ‘বিআরআই’ বাস্তবায়নে, ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনা নিয়ন্ত্রণ এবং এশিয়াসহ বিশ্বব্যাপী চায়নিজ প্রভাব প্রতিষ্ঠা সহজ হয়।

সারাবাংলা/জেআইএল/এমও

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন