বিজ্ঞাপন

ক্যাসিনোতে কোটি টাকা খুইয়ে স্ত্রী-সন্তানদের খুন করেন প্রকৌশলী!

February 19, 2020 | 9:37 am

উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ছিলেন বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) উত্তরা কার্যালয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী। তবে রকিব উদ্দিন জড়িয়ে পড়েছিলেন অবৈধভাবে পরিচালিত ক্যাসিনোর সঙ্গে। দিনের পর দিন টাকা ঢেলেছেন ক্যাসিনোর বোর্ডে। খুইয়েছেন কোটি টাকা। ক্যাসিনোর নেশায় বিভিন্ন উৎস থেকে নিয়েছেন ঋণ। কিন্তু সর্বস্বান্ত হয়ে ঋণ মেটানো তো দূরের কথা, সংসারই চালাতে পারছিলেন না। মাঝে ডিসেম্বরে একবার বাসা থেকে পালিয়েও গিয়েছিলেন, যদিও কিছুদিন পর ফিরে আসেন।

বিজ্ঞাপন

সেই রকিব উদ্দিনের স্ত্রী আর দুই সন্তানের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে তাদের দক্ষিণখানের বাসা থেকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্বজনরা বলছেন, শেষ পর্যন্ত স্ত্রী আর দুই সন্তানকে খুন করে ক্যাসিনো নেশার মূল্য চুকিয়েছেন রকিব।

গত শুক্রবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যার দিকে দক্ষিণখানের প্রেম বাগান এলাকার ৮৩৮ নম্বর বাড়ি থেকে রকিবের স্ত্রী মুন্নি বেগম (৩৭), ছেলে ফোরকান উদ্দিন (১২) ও মেয়ে লাইভার (৪) মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এসময় পাঁচ তলা বাড়ির চতুর্থ তলার ওই বাসার দরজা বাইরে থেকে বন্ধ ছিল। পুলিশের ধারণা, আরও অন্তত দুই থেকে তিন দিন আগে এই তিন জনকে হত্যা করা হয়েছে।

পুলিশ জানিয়েছে, মরদেহ উদ্ধারের সময় রকিব উদ্দিনকে পায়নি পুলিশ। শুধু তাই নয়, আরও দুই-তিন দিন আগে থেকেই নিখোঁজ রয়েছেন তিনি। তার সন্ধান এখনো মেলেনি।

বিজ্ঞাপন

পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, মরদেহ উদ্ধারের সময় রকিব উদ্দিনের লেখা একটি চিরকুট পেয়েছে পুলিশ। ওই চিরকুটে রকিব নিজে রেললাইনে মাথা দিয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন। নোটে ডলি নামে এক নারীর প্রসঙ্গও রয়েছে।

মুন্নী ও তার দুই সন্তানের মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় রকিবকে আসামি করে শনিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) রাতে দক্ষিণখান থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন মুন্নির ভাই মুন্না রহমান। দক্ষিণ খান থানার পুলিশ পরিদর্শক নাসির উদ্দিন সেই মামলার তদন্ত করছেন।

নাসির উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, সবার আগে রকিবকে খুঁজে বের করা প্রয়োজন। মরদেহ উদ্ধারের সময় একটি হাতুড়ি পাওয়া গেছে। ধারণা করছি, ওই হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়েই স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হত্যা করে তারপর পালিয়েছে রকিব।

বিজ্ঞাপন

চিরকুটে ‘ডলি’ নামের যে নারীর কথা উল্লেখ রয়েছে, সে প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এই তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ওই বাড়ির মালিকের স্ত্রীর নাম ডলি। চিরকুটে সম্ভবত তার নামই উল্লেখ করা হয়েছে। তিনিও এ ঘটনায় জড়িত থাকতে পারেন। আমরা সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছি না।

পুলিশ জানিয়েছে, মরদেহ উদ্ধারের পর বাড়ির মালিকের স্ত্রী ডলিকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তার কাছে তেমন তথ্য পাওয়া যায়নি। পুলিশ তাকে নজরদারিতে রেখেছে।

এদিকে, ডলিকে নিয়ে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়েছে সিসিটিভি ফুটেজ সংক্রান্ত বিষয়ে। কারণ ওই বাড়ির সিসিটিভি ফুটেজ উদ্ধার করে দেখা গেছে, বুধবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত কোনো ফুটেজ সংরক্ষিত নেই। ধারণা করা হচ্ছে, ওই সময়ে ধারণ করা ভিডিও মুছে ফেলা হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে খুন ও তাতে ডলির জড়িত থাকার সন্দেহই তাতে দানা বেঁধেছে। তবে সিসিটিভি ক্যামেরার ডিভিআরটি বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে মুছে ফেলা ভিডিও উদ্ধারের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

এদিকে, ডিসেম্বরে রকিব উদ্দিন যখন নিখোঁজ ছিলেন, তার মোবাইল ফোনটি বাড়িতে রেখে গিয়েছিলেন বলে পুলিশকে জানিয়েছে স্বজনরা। তারা জানান, ওই সময় অনেকেই রকিবের মোবাইলে ফোন করে পাওনা টাকা চাইতে থাকেন। পরে রকিব ফিরে এলে তার কাছে এসব পাওনা টাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। একপর্যায়ে তিনি শুধু জানান, ক্যাসিনোতে কোটি টাকা হারিয়েছেন তিনি। ওই সময়ই অনেকের কাছে ধার নিয়েছিলেন।

বিজ্ঞাপন

বাড়ির মালিক ডলি বেগমের বিষয়ে নোটে কী লেখা আছে— জানতে চাইলে পুলিশ জানায়, রকিবকে ডলি বেগম ব্ল্যাকমেইল করেছেন এবং তাকে অনেক টাকা দিতে হয়েছে— এরকম কিছু কথা লেখা রয়েছে।

এদিকে, মঙ্গলবার মুন্নীর ভাই মুন্না রহমানের সঙ্গেও কথা হয় সারাবাংলার। তিনি বলেন, ‘যেভাবেই হোক রকিবকে খুঁজে বের করতে হবে। তাকে ছাড়া হত্যা রহস্যের জট খুলবে না। এ ঘটনায় বাড়িওয়ালিরও কিছু ভূমিকা আছে। আমরা চাই, খুনি যে-ই হোক, তাকে দ্রুত গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনতে হবে। না হলে আমরাও বিপদমুক্ত হব না। খুনি যদি রকিব হয়, তাহলে আমাদের ওপরও তো হামলা চালাতে পারে। কারণ ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে তিনি আমাদের কাছেও টাকা ধার চেয়েছিলেন।’

ওই বাড়ির মালিক মনোয়ার হোসেন জানান, ২০১১ সালে রকিব তার বাসায় ভাড়াটিয়া হিসেবে ওঠেন। এত বছরে পারিবারিক বিবাদের কথা তিনি শোনেননি। তবে রকিব যে অনেকের কাছে ধার নিয়েছেন, সে বিষয়ে কিছুদিন আগে জানতে পেরেছেন। সবশেষ বুধবার দিনের বেলায় রকিবের সঙ্গে একবার কথা হয়েছিল বলে জানান মনোয়ার হোসেন।

আলোচিত এ ঘটনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়নে (র‌্যাব)-১-এর পরিচালক লে. কর্নেল শাফিউল্লাহ বুলবুল সারাবাংলাকে বলেন, ‘রকিবকে সর্বশেষ গত ১২ ফেব্রুয়ারি দেখা গেছে দক্ষিণখান এলাকায়। তারপর থেকে তিনি নিখোঁজ। তার ফোনও বন্ধ। ঘটনার আলামত, আত্মীয়-স্বজনদের বক্তব্য ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে এটা স্পষ্ট— তিন জনই হত্যার শিকার। আমরা রকিবের অবস্থান শনাক্তের চেষ্টা করছি।’

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) উত্তর বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, প্রকৌশলী রকিবের সঙ্গে বাড়ির মালিকের স্ত্রী ডলি বেগমের অনৈতিক সম্পর্ক ছিল— এমন কিছু তথ্য মিলেছে। এ নিয়ে বিস্তারিত জানতে তদন্ত করা হচ্ছে। ডলি বেগমকে নজরদারিতেও রাখা হয়েছে। আমরা মনে করছি, সবকিছুর সমাধান হবে যদি রকিবকে পাওয়া যায়। তাকে খুঁজে বের করতে সব ধরনের চেষ্টা চলছে।

সারাবাংলা/ইউজে/টিআর

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন