বিজ্ঞাপন

দেখেছি পিলখানা ট্রাজেডি…

February 25, 2018 | 1:41 pm

জিমি আমির, জয়েন্ট নিউজ এডিটর

২৫ ফ্রেব্রুয়ারি ২০০৯। বুধবারের সকাল ১০টা। অফিস চ্যানেল ওয়ান। যথারীতি অফিসে গিয়েছি। এত সকালে অফিসে রিপোর্টার আর ডেস্কের কয়েকজন ছাড়া তেমন কেউ আসেন না।

বিজ্ঞাপন

অফিসে গিয়ে দেখলাম, বিডিআরের সদর দফতর পিলখানা নিয়ে প্রায় সবগুলো টেলিভিশনে ফোনো লাইভ চলছে। তথ্য এটুকুই, পিলখানায় গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু কেন এর কোনো কারণ কেউ জানে না। আশেপাশের মানুষজন ধারণা করছেন, সেনাবাহিনীর শীতকালীন মহড়া চলছে!

অনেক রিপোর্টার আশপাশের লোকজনের বক্তব্য থেকেও লাইভ দিচ্ছেন। আসলে কি হচ্ছে, তা জানার জন্য অফিসের সিনিয়রদের অ্যাসাইন করা হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই জানা গেলো বিডিআর-এ বিদ্রোহ হয়েছে। ভেতরে সত্যিকারের গোলাগুলি চলছে। হতাহত হচ্ছে। খুব স্বাভাবিকভাবে অন্য সব অ্যাসাইনমেন্ট বাতিল হলো। এবং নির্দেশনা এলো কোনো নারী রিপোর্টার মুভ করবে না! সুতরাং আমি অফিসে থেকেও না থাকার মতো।

কিন্তু হাল ছেড়ে দিলাম না। অফিসে তখন কেরামত উল্লাহ বিপ্লব ভাই। পিছে পিছে ঘোরা শুরু করলাম। শেষ পর্যন্ত আমার করুণ মুখ দেখে বললেন, ঠিক আছে, জাহাঙ্গীর গেট থেকে এক ট্রাক সেনা বের হওয়ার কথা আছে ফুটেজটা নিয়ে আসো। আমি শুধু অপেক্ষায় ছিলাম বের হওয়ার। জাহাঙ্গীর গেট ছেড়ে মানিক মিয়ার দিকে এগিয়ে যেতেই দেখলাম রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা। দোকান পাট সব বন্ধ। এরপর মিরপুর রোডে উঠেই অফিসে ফোন দিয়ে রাস্তার অবস্থা জানালাম। তখন বলা হলো ফোনো লাইভ দিতে। আমি ততক্ষণে সিটি কলেজের সামনে। ওখান থেকেই গোলাগুলির শব্দ পাচ্ছি।

বিজ্ঞাপন

সিটি কলেজ থেকে পিলখানার গেট পর্যন্ত এক পলক দেখে বোঝা যায়, বোবা গাছগুলোও যেন ভয়ে একেবারে সিঁটিয়ে আছে। বাড়িগুলো দেখে মনে হচ্ছে, যেন কতকাল কেউ থাকে না। স্টার কাবাবের পর কেউ আর সামনে যাওয়ার সাহস করছে না। এলোপাথাড়ি গুলির শব্দ। প্রত্যেকটি বাড়ির গেট এমনভাবে বন্ধ যে অনুরোধ করেও আশ্রয় নেওয়ার কোনো সুবিধা করা যায়নি।

বেলা ১১টার দিকেই খবর পাওয়া গেল বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদকে হত্যা করেছে বিডিআর সদস্যরা। সাংবাদিকদের কাছে খবর এমন যে, মেজর শাকিলসহ হয়তো আর দুই একজন কেউ মারা গেছেন। কিন্তু একসাথে যে ৫৭ জন সিনিয়র সেনা কর্মকর্তা নেই, এই ভয়ংকর তথ্য তখনও রিপোর্টাররা কেউ জানেন না।

টিভি রিপোর্টাররা খোঁজেন তথ্য আর ক্যামেরাম্যানরা ভালো ফুটেজ। দুপুর ২টার পর যখন হেলিকপ্টার থেকে লিফলেট ফেলা হচ্ছে তখন আমার ক্যামেরাম্যান ফারুক স্টার কাবাবের সামনে রাস্তায় আইল্যান্ডের ওপর দাঁড়িয়ে ফুটেজ নেওয়ায় ব্যস্ত। ওকে টেনে সরাতে পারলাম না। বললাম দুজনেই মারা যাব তো। বললো, মরে গেলেও এই ফুটেজ মিস করতে পারবোনা। এই অবস্থায় ফারুকের দৃঢ়তার কাছে হেরে গিয়ে আমি ওর পাশেই দাঁড়িয়ে থাকলাম।

বিজ্ঞাপন

অফিসে ফুটেজ যাচ্ছে, ফোনো লাইভ যাচ্ছে। তথ্য যতটুকু যা পাচ্ছি তাই বলছি। আমাদের চোখের সামনে দিয়েই সে সময়ের প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যদের সাথে সমঝোতার উদ্দেশ্যে পতাকা নিয়ে সামনে এগুতে গিয়েও ফিরে আসলেন।

ডাল, ভাত কর্মসূচিতে অনিয়ম ও বিডিআর সদস্যদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে সেনাবাহিনী, এই নিয়েই চলেছে ২৫ ফেব্রুয়ারির সারাদিনের রিপোর্টিং। টেলিভিশনগুলোতে চলছে, একটানা লাইভ। মিরপুর রোড, ধানমন্ডি ১৫ নম্বর, নিউমার্কেট এলাকা, জিগাতলার পেছন দিকে সব রাস্তা বন্ধ, পুলিশের সাজোয়া যান, রায়ট কার, জলকামান দিয়ে ভর্তি। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়াও কঠিন।

বিকেলের পর সিটি কলেজের রাস্তায় এসে পিটিসি দিলাম, একই জায়গায় এনটিভির সিনিয়র প্রতিবেদক সুলতানা রহমান আপা, বাংলাভিশনের হেড অব নিউজ মোস্তফা ফিরোজ দিপু ভাইসহ অনেকেই। যে যার মত পিটিসি, লাইভ দিয়ে অফিসের দিকে রওনা হলাম।

অফিসে ফিরে সিএনই নাজমুল আশরাফ ভাই আমাকে দেখে বললেন, দেখে মনে হচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরছে সবাই। রিপোর্ট শেষ করে, অনেক অজানা প্রশ্ন, বিস্ময় নিয়ে বাসায় ফিরলাম। পরের দিন আমাকে আর পাঠানো হবে না। বলে দেওয়া হয়েছে আগের রাতেই। কিন্তু ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় হঠাৎ অফিস থেকে বলা হলো কিছুক্ষণের জন্য পিলখানায় যেতে হবে। নিজেই আনমনে হেসে রওনা হলাম, উদ্দেশ্য সোজা পিলখানা।

বিজ্ঞাপন

পৌঁছলাম হোটেল আম্বালা ইন এর কাছে। দেখলাম রাইফেল স্কয়ার আর আম্বালা হোটেল গুলি লেগে ক্ষত-বিক্ষত হওয়ার দৃশ্য। সময় চলে যেতে লাগল। কিন্তু অফিসে ফিরতে হবে এমন ফোন আর নেই। রিপোর্টিং হোক না হোক ঘটনার সাথে আছি এটাই বড় আমার কাছে। আমার ক্যামেরাম্যান এলো। আগের দিনের চেয়ে ২৬ ফেব্রুয়ারি কিছুটা শিথিল। মূল রাস্তায় কেউ না থাকলেও গলির রাস্তায় মানুষ বের হয়েছে। এই সুযোগে বিভিন্ন পথ ঘুরে ঘুরে পিলখানার পেছনের দুটি গেট এলাকাও ঘুরে এলাম। বুঝতে পারলাম, আগের দিন বিডিআর সদস্যদের যে সাহস ছিল তা ধীরে ধীরে কমে আসেছে। আর পিলখানার বাইরে সামরিক পোশাকে এবং সাধারণ পোষাকে সেনা সদস্যদের উপস্থিতি বেড়ে চলেছে।

২৫ তারিখ সন্ধ্যায় বিভিন্ন সুত্রের খবরে এটা নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয়েছে যে, ৫৭ সিনিয়র সেনা কর্মকর্তাকে নির্মমভাবে মেরে ফেলা হয়েছে। সুতরাং আগের দিনের মত ঢালাওভাবে বিডিআরের পক্ষ নেওয়া থেকে পুরোপুরি সরে এল সবাই। ক্ষোভ থাকতে পারে। কিন্তু ক্ষোভ থেকে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে নিরস্ত্র অবস্থায় হত্যা করা হবে এটা ভাবার পর থেকেই বিডিআর জওয়ানদের ওপর থেকে সব সমর্থন চলে গেল সবার। পরদিন ২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে খুব সাবধান হয়ে রিপোর্ট করা হল। শুধু আমার টিভি চ্যানেলই নয়, সব গণমাধ্যমেই দেখা গেল সেই সাবধানতা।

২৬ ফেব্রুয়ারি দুপুরের পর আমরা কয়েকজন স্যারেন্ডারের ভঙ্গিতে হাত তুলে পিলখানার মূল গেটের দিকে এগুচ্ছিলাম। কিন্তু প্রায় গেটের কাছে এসে আটকে দেওয়া হলো। আবার ফিরে গেলাম। বিকেলে প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায় বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন। আমি তখন পিলখানা গেট থেকে ২০ হাত দুরে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার আধা ঘন্টা পর এক এক করে আটকে থাকা পরিবারগুলো বের হতে থাকল। সেই মুখগুলো বর্ণনা করার মত নয়। মনে হলো, গুলি খাওয়া পাখি কোনো মতে পালিয়ে বাঁচলেও আর কখনো উড়তে পারবে না।

পিলখানার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা পরিবারগুলোর অবর্ণনীয় চেহারাগুলো দেখতে দেখতে নিজের অজান্তেই চোখে পানি চলে আসে। অনেকক্ষণ পর সন্ধ্যায় অফিসে ফেরার সময় ধানমন্ডি ১৫ পার হতে গিয়ে দূর থেকে দেখলাম সেনাবাহিনীর একটি দল মার্চ পাস্ট করে এগিয়ে আসছে। অজানা আরেকটা ভয় নিয়েই অফিসে ঢুকলাম। কি হতে যাচ্ছে কে জানে। অফিসে ঢুকে শুনলাম আরো অনেক ঘটনা। বেশ অনেক রাতেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেল। পরের দিন শুক্রবার, টানা দুদিনের ক্লান্তিতে দুপুর পর্যন্ত ঘুম।

হঠাৎ এক কলিগ ফোন করে বলল, কেমন সাংবাদিক, ঘটনা শেষ না করে ঘুমাও। নিজেকে খানিকক্ষণ গালি দিলাম। তাই তো? উঠৈই দৌড়। চীফ রিপোর্টার শাকিল ভাই আমাকে ডে অফ দিয়েছে। সেটা মনে নেই। আমাকে দেখে হাসি দিয়ে বলল, তো ডে অফ দিলাম কেন? বাধ্য হয়েই বললেন, বের হতে। আবারও সন্ধ্যায় রিপোর্ট।

এরপরের সপ্তাহের একদিন। এ্যাসাইনমেন্ট শেরেবাংলা নগরের পরিকল্পনা কমিশনে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (একনেক) বৈঠক। এর আগেই একটা খবর পেলাম, যে সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তার স্ত্রী কথা বলতে চান। একনেক বাদ দিয়ে শাকিল ভাইকে কোনো কিছু না জানিয়ে উত্তরা চলে গেলাম। ক্যাপ্টেনের স্ত্রীকে অভয় দিয়ে বললাম, যা বলা যাবে না তা বাদ দিয়েই বলেন। অত্যাচারের বর্ণনা শুনেছি প্রায় আড়াই ঘন্টা। যা তিনি বলেন নি তা বুঝে নিতে আমার খুব একটা দেরি হয়নি।

 অফিসে ফিরছি এমন সময় শাকিল ভাই ফোন করে বললেন, জিমি যান নি একনেকে? ভয়ে ভয়ে বললাম না ভাই। তখন ফোনেই হাসির শব্দ পেলাম। বললো, ভয় নেই অফিসে আসেন।

পুরো বিকেল ধরে রিপোর্ট বানালাম। প্রশংসা শুনেছি অনেকের। প্রশংসা শুনেছি কারো কথা না শুনে ঘটনার সাথে থাকার। এরপরে আরো একটি রিপোর্ট করার কথা ছিল। কিন্তু শাকিল ভাই আমাকে অনুরোধ করে রিপোর্টটি দিয়েছিলেন আরেকজনকে।

এর মধ্যেই পিলখানার ঘটনা দেখার জন্য অনেক সাংবাদিককে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমিও ছিলাম সে দলে। দেখেছি দরবার হলের দেয়ালে দেয়ালে গুলি লাগা ফুটো। ছোপ ছোপ রক্তের দাগ লেগে আছে দেয়াল, জানালা, মেঝেতে। বাইরে বিভিন্ন জায়গায় ভেসে যাওয়া রক্তের প্রবাহ। কোরবানীর পর শুকিয়ে যাওয়া রক্তের যে গন্ধ হয়, তেমন উৎকট গন্ধ। সিভিল পোশাক পরে পাচিল টপকে পালিয়ে যাওয়ার সময় ফেলে যাওয়া বিডিআর সদস্যদের পোশাকের স্তুপ। পুরো এলাকা যেন মৃত্যুপুরী। আজও চোখের সামনে ভাসছে।

কি হয়েছিল সেদিন? কেন নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয়েছিল দেশ রক্ষার দায়িত্বে থাকা এতগুলো সেনা কর্মকর্তার? আসলেই কি তাদের কোনো দোষ ছিল? এমন অনেক প্রশ্ন আজও মাথায় ঘুরপাক খায়। যারা সেদিন পিলখানার ঘটনা দেখেছেন, শুনেছেন নিশ্চয়ই তাদেরও আছে এমন নানা প্রশ্ন। কার কাছে গেলে উত্তর পাওয়া যাবে? কেউ জানেন?

সারাবাংলা/জেএএম/এমএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন