বিজ্ঞাপন

একজন সুফি মিজানের গল্প

February 20, 2020 | 3:48 pm

রফিকুল বাহার

গল্পটা সুফি মিজানুর রহমানের। বাংলাদেশে দ্বিতীয় শিল্পপতি হিসেবে এবং জীবদ্দশায় প্রথম শিল্পপতি হিসেবে যিনি ভূষিত হয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ সম্মাননার একটি পুরস্কার একুশে পদকে।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৪৯ বছর হলো। আর আমাদের ভাষা আন্দোলন বা অমর একুশে সে আরও ১৯ বছর আগের ইতিহাস। তবে ভাষা শহীদদের স্মরণ করতে স্বাধীন বাংলাদেশে একুশে পদক চালু করা হয় আরও পরে। সেটি ১৯৭৬ সালে। এরপর এ পর্যন্ত ৫০১ জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ এ রাষ্ট্রীয় পদকে ভূষিত করা হয়েছে। সঙ্গীত, নৃত্য, অভিনয়, চারুকলা, গবেষণা, অর্থনীতি, সমাজসেবা, চিকিৎসা, ভাষা ও সাহিত্যের জন্য এসব পুরস্কার মনোনীত করা হয়। এরপর বিভিন্ন ধাপে তা চূড়ান্ত করা হয়। যাঁর জন্য একুশের পদকের প্রস্তাব করা হবে তাঁর বিষয়ে ৩৫০ শব্দের একটি যৌক্তির ব্যাখ্যা তুলে ধরেন প্রস্তাবক। তারপর জেলা প্রশাসন, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্তরের ব্যাপক খোঁজখবর যাচাই-বাছাই শেষে চূড়ান্ত মনোনয়ন দেয়া হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে এ পর্যন্ত মাত্র দুইজন শিল্প উদ্যোক্তাকে একুশে পদক দেয়া হয়েছে। প্রথম ব্যবসায়ী শিল্প উদ্যোক্তা হিসেবে মরণোত্তর পুরস্কার পেয়েছিলেন দেশের অন্যতম শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্কয়ার গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা স্যামসন এইচ চৌধুরী। ২০২০ সালে দ্বিতীয় পুরস্কারটি পেলেন জীবদ্দশায় দেশের আরেক সফল শিল্পপ্রতিষ্ঠান পিএইচপি ফ্যামিলির চেয়ারম্যান সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।

জানিয়ে রাখি তার প্রতিষ্ঠিত শিল্প প্রতিষ্ঠান পিএইচপির বাংলা অর্থ হল, ‘সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধির ছায়া।’

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে সুফি মিজানুর রহমান ব্যবসা শুরু করেন ব্যাংক কর্মকর্তার সামান্য চাকরি ছেড়ে। এ পাঁচ দশকেই তিনি গড়েছেন ৩৩টি প্রতিষ্ঠান। যাতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে প্রায় ১০ হাজার কর্মজীবী। তাঁর গড়া প্রতিষ্ঠানগুলো বছরে লেনদেন করে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। সরকারকে ভ্যাট, শুল্ক ও আয়কর বাবদ প্রতিবছর পরিশোধ করে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা।

বিজ্ঞাপন

বন্দরনগরী চট্টগ্রাম কেন্দ্রীক শিল্প-বাণিজ্যের বিকাশ ঘটানো এই সুফি মিজানের জন্ম নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জে। তবে চট্টগ্রামেই তার স্থায়ী নিবাস। বন্দরনগরীর নাসিরাবাদে তার বাড়ি। তার মালিকানাধীন অধিকাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠানও চট্টগ্রামে।

৭৬ বছরের এই শুভ্র শশ্রুম-িত মানুষটি সাদামাটা বাঙালিয়ানা সূতির সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরেন। মাথায় টুপি থাকে। খুব সাধারণ বেশভূষা। যারা তাকে খুব কাছে থেকে চেনেন, তারা জানেন ধর্মপ্রাণ সুফি মিজানস বছরের অধিকাংশ দিনই রোজা করেন। আর খাবারের তালিকাও তার অতি সাধারণ বাঙালিপনা। করলা ভাজি, ডিম ভাজি, ডাল, কৈ মাছ, ইলিশ মাছ তাঁর প্রিয় খাবার। সদা হাস্যোজ্জ্বল বিনয়ী। কারো সঙ্গে সাক্ষাতে অতি সজ্জন। মুখে মুখে শোনা যায়, কোনও সাক্ষাতে সুফি মিজানের আগে কখনো তাকে কেউ সালাম দিতে পারে না, তিনিই আগে সালাম দিয়ে হাত বাড়ান। অনেক বড় শিল্পপতি হয়েও এতকিছু সাধারণ গুন তাকে সাধারণ মানুষের কাতারে থাকার সুযোগ করে দেয়।

সহধর্মিনী তাহমিনা রহমান ছায়ার মতোই আছেন সুফি মিজানের সাথে। বিভিন্ন বক্তব্যে স্ত্রীকে যোগ্য সম্মান দেখাতে ভোলেন না তিনি। স্ত্রী তাহমিনাকে ‘মহিয়সী নারী’ বলেই জনসম্মখে তুলে ধরেন সুফি মিজান। সাত ছেলে, এক মেয়ের জনক তিনি। ছেলেদের মধ্যে চার জন অস্ট্রেলিয়া এবং বাকি তিন জন যুক্তরাষ্ট্র থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন। কিন্তু তাদের মধ্যে কেউই বিদেশে স্থায়ী নিবাস গড়েননি। দেশে ফিরে বাবার গড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর হাল ধরেছেন। ছেলেরা নতুন নতুন শিল্প গড় বাবার প্রচেষ্টাকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছেন ও যাচ্ছেন।

বিজ্ঞাপন

ছিয়াত্তরেও সুফি মিজান নিয়মিত অফিস করেন। ব্যবসায় পূর্ণ সময় দেন। অফিসে ঢুকেই প্রতিটি ছেলের রুমেই গিয়ে খোঁজখবর নেন, তিনি ছেলেদের প্রতিও তার সম্মান ও স্নেহের প্রকাশ সকলের চোখে পড়ে। পারিবারিক বলয়ে পুরোদস্তুর একজন সংসারি মানুষ এই সুফি মিজান। বাসায় ফিরে ছেলের বউদের খোঁজখবর যেমনি রাখেন, তেমনি নাতি-নাতনিদের সাথে সময় কাটান। কখনো কখনো স্কুলপড়–য়া নাতি-নাতনিদের শিক্ষকও বনে যান তিনি।

সকল অর্থেই সফল ও পূর্ণাঙ্গ মানুষটি এবছর একুশে পদকে ভূষিত হলেন। এবং বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে এই পদক গ্রহণ করলেন তিনি।

এ বছর মোট ২০ জন্য ব্যক্তি ও দুটি প্রতিষ্ঠানকে একজন একুশে পদক তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্যে ৫ জন মরণোত্তর একুশে পদক পেলেন।

এই পুরস্কার হাতে নেওয়ার পর সুফি মিজানুর রহমান তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, বাংলাদশের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পুরস্কার নিতে পেরে তিনি নিজেকে খুবই ধন্য মনে করছেন। পুরস্কার সুফি মিজানের মতো আরও অনেকেই পেয়েছেন। কিন্তু সফল ব্যবসায়ী হিসেবে জীবদ্দশায় পুরস্কার পাওয়ার ঘটনাটি তাঁর মনোজগতে এক অন্যরকম আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। রাষ্ট্রীয় সম্মান পাওয়ায় জীবনে আরো অনেকদিন বেঁচে থাকার স্পৃহা নতুন শিল্পগড়ার প্রেরণা পাচ্ছেন বলেও জানান তিনি।

বিজ্ঞাপন

তাঁর পুরস্কার গ্রহণের সময় সঙ্গে ছিলেন সাত ছেলে, একমাত্র মেয়ে ও সহধর্মিনী। ব্যবসায় সাফল্য পাওয়ার সাথে পারিবারিক ঐক্য ও বন্ধন অটুট রাখার এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত সুফি মিজান। যা অনেকের জন্য অনুকরণীয়-অনুসরণীয় হতে পারে। অতি সাধারণ জীবনযাপন করেও আকাশছোঁয়ার মতো সফলতা অর্জন করেছেন কঠোর পরিমশ্রম, সততা, মেধা ও আন্তরিকতার মাধ্যমে। তাঁর ছেলেরা সবাই একবাক্যে বলেন, ‘আব্বুর মতো পরিশ্রমী কাউকে আমরা দেখিনি জীবনে। এ বয়সেও তাঁর পরিশ্রমের কাছে আমরা সবাই হার মানি।’

নিজের বাড়ি রূপগঞ্জকে ভুলে যান নি সুফি মিজান। সবশেষে সে সঙ্ক্রান্ত আমার নিজের ছোট্ট একটি অভিজ্ঞতা দিয়ে শেষ করতে চাই। ধান চাষ করেছেন গ্রামের বাড়ি রূপগঞ্জে। ফলন ভালো হয়েছে। তা দেখার জন্য আমাকে সঙ্গে নিয়েই চট্টগ্রাম থেকে রওনা হন ফজরের নামাজ পড়ে। রূপগঞ্জে গিয়েই সোনালী ধানের ফলন দেখে আমি মুগ্ধ। আর সুফি মিজানের মুখে শুনতে পেলাম অন্য একটি কথা। যা একজন শিল্পপতির মুখে শুনবো বলে ভাবিনি। তিনি বললেন, ‘শিল্পপতিরা যদি চাষবাদে এগিয়ে আসেন তাহলে বাংলাদেশের খাদ্য ও পুষ্টি সংকটসহ অনেক কিছুরই সমাধান হয়ে যাবে।’

১৩ বছর আগের ঘটনা এটি। বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সুফি মিজানের নানা উদ্যোগের অবদান রয়েছে তাতে।

সুফি মিজানের যে অফুরন্ত দম তিনি যে অসম্ভব পরিশ্রমী সেটি বুঝতে পেরেছি সেদিন। ধান ক্ষেত দেখে আমি ফিরি চট্টগ্রামে। তিনি চলে যান ঢাকায়। আমি ফিরে ক্লান্তশ্রান্ত হয়ে রাতে আর প্রতিবেদন তৈরি করতে পারিনি, করেছি পরেরদিন। আসার আগে আমাকে মায়া করে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছেন। তাকে খেতে বললে তিনি বলেন ‘আমি রোজা রেখেছি’। পরে জানতে পারলাম তিনি ঢাকায় গিয়ে অফিস করেছেন। বিদেশ থেকে আসা অতিথিদের সঙ্গে মাহফিল করেছেন। ১৩ বছর আগে তখন সুফি মিজানের বয়স ছিল ৬৩ বছর। আর তখন আমার বয়স ছিল ৩৮ বছর। সুফি মিজান এমনই, একজন যুবকও যার সঙ্গে দৌড়ে পেরে উঠেন না !

রফিকুল বাহার
আবাসিক সম্পাদক
একুশে টেলিভিশন লিমিটেড, চট্টগ্রাম।
rafiqul_bahar@yahoo.com

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন