বিজ্ঞাপন

দুই মুক্তধারায় মুক্তবিশ্বে প্রাণের বাংলা

February 21, 2020 | 3:24 pm

পার্থ সনজয়

‘যে মাটির জন্যে এমন হন্যে
এমন আকুল হলাম,
সে মাটিতে আমার অধিকার
এ মাটির বুকের কাছে মগ্ন আছে আমার অঙ্গীকার
যে ভাষার জন্যে এমন হন্যে, এমন আকুল হলাম
সে ভাষায় আমার অধিকার
এ ভাষার বুকের কাছে মগ্ন আছে আমার অঙ্গীকার’
– কবীর সুমন

বিজ্ঞাপন

মগ্ন থাকা সেই অঙ্গীকারেই একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর— থোকা থোকা বিষণ্ন সব নামের আরেক পিঠেই ‘আমরি বাংলা ভাষা’।

একুশ আমাদের পরিচয়। আমাদের সাংস্কৃতিক জাগরণের স্মারক। একুশের মতোই আমাদের আরও এক শক্তি ‘একুশের বইমেলা’।

একুশের বইমেলা ও একজন শ্রী চিত্তরঞ্জন সাহা

সদ্য স্বাধীন দেশে বাংলা একাডেমির ফুটপাতে চটের ওপর যে মেলা শুরু করেছিলেন প্রকাশক চিত্তরঞ্জন সাহা, তাই আজ মহীরুহ। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির বটতলায় চটের ওপর মাত্র ৩২টি বই ঠাঁই পেয়েছিল। যার প্রায় সবই ছিল শরণার্থীদের লেখা। ‘মুক্তধারা’ নয়, ‘স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদে’র ব্যানারেই ছিল এই বইমেলা। আর বইগুলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রথম অবদান।

বিজ্ঞাপন

১৯৭৪ সালের জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন উপলক্ষে মুক্তধারার চিত্তরঞ্জন সাহা, স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্সের রুহুল আমিন নিজামী ও বর্ণমিছিলের তাজুল ইসলামসহ আরও কিছু প্রকাশক তাদের বই নিয়ে একাডেমি প্রাঙ্গণের একপ্রান্তে পসরা সাজিয়ে বসেন। ওই বছর থেকে একুশ উপলক্ষে বাংলা একাডেমির নিজস্ব প্রকাশনা ছাড়ে বিক্রি শুরু হয়। একাডেমি ওই বছরে প্রকাশ করে লেখক পরিচিতি নামে একটি ছোট বই।

পরবর্তীকালে চিত্তরঞ্জন সাহা ধীরে ধীরে বইমেলা ও প্রকাশনা শিল্পকে একটি পেশাগত রূপ দিতে সচেষ্ট হন। তিনি নিজে জাপানে মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্প সম্পর্কে প্রশিক্ষণ নেন এবং তার প্রধান সম্পাদক অধ্যাপক আবদুল হাফিজকেও জাপান থেকেই এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। ওই সময় কেবল তার প্রতিষ্ঠিত ‘মুক্তধারা’ প্রকাশনা সংস্থাতেই পাণ্ডুলিপি পরীক্ষা ও সম্পাদনার ব্যবস্থা ছিল। তাই বলা যায়, বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পকে পেশাগত স্তরে উন্নীত করার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন শ্রী সাহা।

বিজ্ঞাপন

পরে ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমিকে মেলার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন। ১৯৭৯ সালে বইমেলার সঙ্গে যুক্ত হয় ‘বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি’। এ সংস্থাটিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা।

১৯৮৩ সালে কাজী মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে বাংলা একাডেমিতে প্রথম ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র আয়োজনের প্রস্তুতি নেন। কিন্তু ওই বছর তৎকালীন ক্ষমতাসীন এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ ট্রাক তুলে দিলে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এ বছর আর বইমেলা করা সম্ভব হয়নি।

এর পরের বছর ১৯৮৪ সালে সাড়ম্বরে বর্তমানের ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র সূচনা হয়। এরপরই বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলা ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’য় পূর্ণরূপ পায়। তারই পরিণত রূপ আজকের বইমেলা।

মুক্তধারা নিউইয়র্ক: বহির্বিশ্বে বাংলাভাষা

সময়টা ১৯৯২। নতুন প্রজন্মকে বাংলা বই পড়াতে আমেরিকায় পাড়ি জমানো নোয়াখালীর সন্তান বিশ্বজিৎ সাহা নিউইয়র্কে শুরু করেন বাংলা বইয়ের মেলা। ২৫ বছর আগে, ফেব্রুয়ারির ঠান্ডায় যে মেলা শুরু হয়েছিল, তাই আজ বহির্বিশ্বে বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড় বইমেলা। শুধু দুই বাংলার নয়, পৃথিবীর নানা জায়গার লেখক ও পাঠকদের একটা আশ্চর্য মিলনমেলা।

বিজ্ঞাপন

বিশ্বজিৎ সাহার উদ্যোগে ১৯৯২ সালে ‘মুক্তধারা নিউইয়র্ক’ ও ‘বাঙালি চেতনা মঞ্চে’র ব্যানারে জাতিসংঘের সামনে অস্থায়ী শহিদ মিনার তৈরি করে একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনাকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। নিউইয়র্ক থাকে বরফে ঢাকা। সেই বরফ ভেঙে প্রতি বছর মাঝরাতে বিশ্বজিৎ সাহা যান বন্ধুদের নিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন করতে।

বিশ্বজিতের হাতে তৈরি ‘মুক্তধারা ফাউন্ডেশন’ এখন নিউইয়র্ক স্টেট গভর্নরের স্বীকৃতি অর্জন করে সে দেশে ‘আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব সপ্তাহ’ নামে সম্মানিত হয়েছে। এই স্বীকৃতি অর্জনের পথটি সহজ ছিল না। এটা বাংলা ভাষার পক্ষে, বাঙালি জাতিসত্তার এক বিরাট অর্জন।

এত দিন ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে বাংলা বইয়ের মেলা করতে যে নিষ্ঠা ও শ্রম লাগে, তা সামান্য নয়। বইমেলাকে কেন্দ্র করে নিউইয়র্ক হয়ে ওঠে বিশ্ববাঙালির প্রাণের মেলা। এই মেলায় যারা যান, তারা ভাবেন তারা বাঙালি।

আর এই ভাবনাকে বাস্তব করেছেন একজন বিশ্বজিৎ সাহা। তার ‘মুক্তধারা নিউইয়র্ক’ বাংলা ভাষার আরেক স্বপ্নের নাম।

সারাবাংলা/টিআর

Tags: , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন