বিজ্ঞাপন

‘কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে প্রাণে বেঁচে গেছিলাম’

February 23, 2020 | 7:50 am

উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ‘ফ্রিজ থেকে কী যেন একটা বের করছিলাম। হঠাৎ বিকট শব্দে সবকিছু কেঁপে ওঠে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বের হয়ে পূর্ব দিকে দৌড় দেই। যদি পশ্চিম দিকে দৌড় দিতাম, তাহলে আমিও আগুনে পুড়ে মরতাম। একটি সেকেন্ডও অপেক্ষা করিনি আমি। ফ্রিজ খোলাই ছিল। চাবি, ক্যাশের টাকা, আগের জমানো টাকা, মোবাইল ফোন— কোনোকিছু নেওয়ার লোভ করিনি। হয়তো সে কারণেই আজও বেঁচে আছি।’

বিজ্ঞাপন

একটানা কথাগুলো বলে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন নাসির উদ্দিন। চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানসনের বিপরীতে নিশাত স্টোর নামে একটি দোকানের মালিক তিনি। মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে সারাবাংলার সঙ্গে আলাপের সময় এভাবেই তুলে ধরছিলেন একবছর আগের সেই ভয়াল দিনের স্মৃতি। বলতে বলতে কেঁপে উঠছিলেন, যেন এখনো সেদিনের সেই আগুনের আতঙ্ক তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাকে।

নাসির উদ্দিন বলেন, দোকান থেকে বের হয়ে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছি, আমার দোকান পুড়ে যাচ্ছে চোখের সামনে। আমার দোকান তখন খোলা ছিল। রাস্তার দু’জন গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন দোকানে। পরদিন তাদেরও মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

‘দোকান থেকে পোড়া ছাই ছাড়া আর কিছুই পাইনি। ৩ লাখ টাকার মালামাল, ফ্রিজ, টাকা পয়সা, মোবাইল ও অন্যান্য জিনিসপত্র— সব পুড়ে ভস্মীভূত হয়েছে,’— বলেন নাসির।

বিজ্ঞাপন

অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতা মানসিকভাবে দীর্ঘদিন তাড়া করেছে নাসিরকে। এখনো সেই রেশ কাটিয়ে উঠতে পারেননি। বলেন, সেদিনের স্মৃতি মনে করলে আমি কিছু করতে পারি না। আমি এক সপ্তাহের মতো ঘুমাতে পারিনি। এমনকি নিজের পোড়া দোকানে পাঁচ দিন ঢুকতে চেয়েছি, তাও ঢুকতে দেয়নি পুলিশ। পাঁচ দিন পর আমি আমার দোকানে ঢুকেছি।

চুড়িহাট্টায় গিয়ে দেখা যায়, নাসিরের মালিকানাধীন নিশাত স্টোরের অবস্থান ওয়াহেদ ম্যানসনের ঠিক বিপরীত দিকে। নিশাত স্টোর থেকে ওয়াহেদ ম্যানসনের দ্বিতীয় তলার যে জানালা ছিল, তা বরাবর সোজা ছিল।

আগুনের ঘটনার এক সপ্তাহ আগের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে নাসির উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ওয়াহেদ ম্যানসনের দ্বিতীয় তলার জানালা দিয়ে সেন্ট (বডি স্প্রে) বের হতো। গন্ধে এক সপ্তাহ ধরে কেউ টিকতে পারত না। দুই তলার জানালা আমার দোকান বরাবর হওয়ায় আরও বেশি খারাপ লাগত। এখানকার হোটেল, মসজিদে আসা মুসল্লি, আশপাশের দোকানদার ও কাস্টমার— কেউ টিকতে পারত না। জানালার মধ্যে একটি বড় ফ্যান (এক্সস্ট ফ্যান) সেট করা ছিল। তাতে আরও বেশি গন্ধ বের হতো। এ নিয়ে অনেকে বলাবলি করছিল, এটা বন্ধ হওয়া দরকার। তবে কেউ গিয়ে যে বলবে, এলাকায় কেউ থাকতে পারছে না, আপনারা এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেন— সেরকম কেউ ছিল না। এরপরই তো ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গেল।

বিজ্ঞাপন

এক প্রশ্নের জবাবে নাসির বলেন, দ্বিতীয় তলা কারা ভাড়া নিয়েছিল, তা আমরা কেউ জানতাম না। ভবনটি মূলত দেখাশোনা করত ওয়াহেদ ম্যানসনের মালিক সোহেলের শ্যালক মাসুদ। যাকে ভাড়া দিয়েছিলেন, তাকে বোম্বাইয়া নামে চিনত অনেকেই। তবে আমরা সেই বোম্বাইয়াকে কেউ দেখিনি।

চুড়িহাট্টার সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের প্রায় আট মাস পর দোকান চালু করতে পেরেছেন নাসির উদ্দিন। কিছু সহায়তা পেয়েছেন বিভিন্ন মহল থেকে। তাতেই ফের নতুন করে সবকিছু গড়ার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে চলেছেন।

সে কথা জানিয়ে নাসির বলেন, আজ বেঁচে আছি বলেই আট মাস পরে হলেও আবার দোকান চালু করতে পেরেছি। নতুন করে দোকান আবার সাজিয়েছি। মসজিদের ভবনে ভাড়া থাকি, তাই মসজিদ কমিটি ২৫ হাজার টাকা দিয়েছে। এছাড়া প্লাস্টিক দানা ব্যবসায়ী সমিতির পক্ষ থেকে ১০ হাজার টাকা পেয়েছি।

বিজ্ঞাপন

কেমিক্যাল ব্যবসার কথা উল্লেখ করে নাসির উদ্দিন বলেন, কেমিক্যাল গুদাম কত বড় সর্বনাশ ডেকে আনে, তা চকবাজারের মানুষ চুড়িহাট্টার আগুনের ঘটনায় বুঝতে পেরেছে। এখন কেউ আর কেমিক্যাল গুদাম ভাড়ায় দিচ্ছেন না। এমনকি প্লাস্টিকের দানার ব্যবসা করবেন, তাও বাড়িওয়ালারা দিতে চাচ্ছেন না।

নাসির বেঁচে আছেন, তবে চুড়িহাট্টার আগুন কেড়ে নিয়েছে ৬৭টি প্রাণ। এই যে আগুনের তাণ্ডব, তা থেকে নাসির শিখেছেন, জীবনের চেয়ে দামি আর কিছু নেই।

নাসিরের ভাষ্য, ‘মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে বেঁচে গেছি। টাকা বা মোবাইল নিতে গেলেও হয়তো আর বের হতে পারতাম না। যদিও আগুনের দৃশ্য দেখার সময় আফসোস হচ্ছিল। পরে বুঝেছি, এসবের চেয়েও জীবন অনেক দামি। বেঁচে থাকতে পারলে অনেক কিছুই সম্ভব। আর বাঁচতে না পারলে কোনো লাভ নেই। যারা গেছে, তাদের পরিবার বুঝছে, কতটা ক্ষতি হয়েছে।’

চুড়িহাট্টা ঘুরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, আগের মতো আর কেমিক্যাল গোডাউন নেই চুড়িহাট্টার বাড়িতে বাড়িতে। তবে সেই জায়গায় গড়ে উঠেছে প্লাস্টিক কারখানা। তা নিয়েও শঙ্কিত সবাই। এসব কারখানাতেও যদি ওয়াহেদ ম্যানসনের মতো কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তা নিশ্চয় একইরকম ক্ষতি বয়ে আনবে সবার জন্য।

নাসির বুঝতে পারছেন, এরকম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কেমিক্যাল গোডাউন বা কারখানা কতটা বিপজ্জনক। নাসির বুঝতে পারছেন জীবনের চেয়ে দামি কিছু নেই। কিন্তু যারা এখনো কেমিক্যাল গোডাউনের জন্য বাড়ি ভাড়া দিচ্ছেন বা বাসাবাড়িতে প্লাস্টিক কারখানা গড়ে তোলার সুযোগ করে দিচ্ছেন, তারা কি বুঝতে পারছেন জীবনের এই মূল্য?

সারাবাংলা/ইউজে/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন