বিজ্ঞাপন

এবার পাপিয়ার ক্যাসিনো সম্পৃক্ততার খোঁজে র‌্যাব

February 24, 2020 | 7:09 pm

উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী শামীমা নুর পাপিয়ার অর্থের উৎস বিভিন্ন উপায়ে জানার চেষ্টা করা হলেও কোনো সদুত্তর মেলেনি। র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) অনুসন্ধানে কিছু তথ্য বেরিয়ে এলেও অজানা রয়ে গেছে বিপুল পরিমাণ টাকার উৎস। তবে র‌্যাব এবার চোখ দিয়েছে ক্যাসিনোকাণ্ডের দিকে। আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী এই বাহিনীর ধারণা, গুলশান কেন্দ্রিক অনলাইন ক্যাসিনোকাণ্ডে জড়িত থাকতে পারে পাপিয়া দম্পত্তি। সেখান থেকে অধিকাংশ টাকা অবৈধ উপায়ে আয় করে থাকতে পারে।

বিজ্ঞাপন

সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাফী উল্লাহ বুলবুল সারাবাংলাকে বলেন, ‘পাপিয়ার অপরাধ সম্পর্কে জানতে সব জায়গায় খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। ক্যাসিনোকাণ্ডে তার সম্পৃক্ততা থাকতে পারে। সে বিষয়েও আমরা খোঁজ খবর নিতে শুরু করেছি। যেহেতু সে টাকার উৎস সম্পর্কে কোনো কিছু বলছে না, সেজন্য আমরা এর মূল রহস্য বের করতে কাজ করে যাচ্ছি। শুধু ক্যাসিনো নয় আরও কোথা থেকে সম্পদ অর্জন করেছে সেদিকেও আমরা নজর দেবো।’

আরও পড়ুন: পাপিয়াসহ চারজন রিমান্ডে

তিনি আরও বলেন, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এরকম একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার আগে অন্তত তিন মাস সময় নিয়ে থাকে। আর পাপিয়ার ক্ষেত্রে আমরা মাত্র সময় পেয়েছি ১২ ঘণ্টার মতো। আমরা মাঠে নেমেছি। রিমান্ডে আসলে এর রহস্য বের করতে পারব।’

বিজ্ঞাপন

র‌্যাবের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, ‘পাপিয়া ও তার স্বামী মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরী অনলাইন ক্যাসিনোর গডফাদার সেলিম প্রধানের গুলশানের বাসায় ক্যাসিনো খেলতেন। সেলিম প্রধান ধরা পড়ে কারাগারে গেলেও অনেকেই কৌশলে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। এদের মধ্যে পাপিয়া ও সুমন চৌধুরী অন্যতম।’

সুমনের পিএস সাব্বির আহমেদ ও পাপিয়ার পিএস শেখ তায়্যিবা র‌্যাবকে জানিয়েছে, ক্যাসিনোর টাকা দিয়েই ফার্মগেটের ইন্দিরা রোডের একটি বাসায় ২০১৮ সালে একটি ও ২০১৯ সালে আরেকটি ফ্ল্যাট কেনেন। ফার্মগেট, ২৮ ইন্দিরা রোডের একেকটি ফ্লাটের দাম প্রায় দেড় কোটি টাকা। আর একেকটি ফ্ল্যাটে ডেকোরেশন করেছেন অন্তত দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা দিয়ে। ফ্ল্যাটে রয়েছে দামি খাট-পালঙ্ক, ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্র।

আরও পড়ুন: যেভাবে বিত্তের পাহাড় পাপিয়া-মফিজুর দম্পতির

বিজ্ঞাপন

অভিযানকারী র‌্যাবের আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘বড় ধরনের অভিযান চলার কারণে ক্যাসিনো থেকে পাওয়া টাকা পাপিয়া সরাতে পারেনি। ব্যাংকের টাকাগুলোও বিভিন্ন সময়ে উঠিয়ে নিয়েছেন। অনেক টাকা দেশের বাইরে পাঠিয়েছেন। বাকি টাকা দেশে রেখে হুন্ডি চালিয়ে আসছিলেন এমন তথ্যও পেয়েছে র‌্যাব। তবে তাদের সব অ্যাকাউন্ট তল্লাশি ও দেশের বাইরে পাঠানো টাকার সন্ধান করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সহায়তা চাইব আমরা।’

এদিকে র‌্যাব জানিয়েছে, পাপিয়া দম্পতি চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণা করে টাকা আদায় করত বেকারদের কাছ থেকে। এছাড়া সিএনজি পাম্প স্টেশনের অনুমতি পাইয়ে দেওয়া, কারখানায় গ্যাস লাইনের সংযোগ দেওয়ার নামে টাকা হাতিয়ে নেওয়াসহ বিভিন্ন উপায়ে অবৈধভাবে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তারা।

র‌্যাব আরও জানায়, স্কুল-কলেজের সুন্দরী মেয়েদের ধরে এনে তাদের অশ্লীল ভিডিও করে তা বিভিন্ন ক্লায়েন্টের কাছে পাঠিয়ে দিত পাপিয়া। পছন্দ হলে তাদের ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করতো সুমন চৌধুরী ও সাব্বির আহমেদ। আবার কেউ পাঁচ তারকা হোটেলে আসতে চাইলেও কোনো বাধা থাকত না। এমন অনেক ক্লায়েন্ট আছে, হোটেলে যাদের অন্তরঙ্গ ভিডিও ধারণ করে ব্লাকমেইল করে মোটা অংকের টাকা আদায় করত। এছাড়া চাঁদাবাজি, মাসোহারা আদায়, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসার মাধ্যমেও টাকা উপার্জন করেছে পাপিয়া দম্পত্তি।

আরও পড়ুন: পাপিয়া প্রতিদিন বারের বিলই দিতেন আড়াই লাখ টাকা!

বিজ্ঞাপন

র‌্যাবের দুদিনের অপারেশনে ছিলেন এমন একজন কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিমানবন্দরে যখন পাপিয়া, তার স্বামী সুমন চৌধুরী, সহকারী সাব্বির আহমেদ ও শেখ তায়্যিবাকে আটক করা হচ্ছিল তখন তারা যেভাবে ভয়ভীতি দেখানো শুরু করেছিল, তাতে র‌্যাব সদস্যরা হতভম্ব হয়ে যায়। তাদের প্রথমে বুঝিয়ে বহির্গমন পথ আটকানো হয়। এ সময় পাপিয়া বেশকয়েকজন মন্ত্রীকে ফোন করার জন্য মোবাইল বের করেন। তবে তার সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। কারণ কেউ তার ফোন ধরেননি। এমনকি কয়েকজন প্রভাবশালী সংসদ সদস্যকেও ফোন করেন পাপিয়া। তাতেও কাজ হয়নি।’ আদৌ ওইসব ব্যক্তি তার ফোন ধরেন কি-না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে বলে জানায় র‌্যাব।

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘আটকের পর প্রথম দিন পাপিয়াসহ অন্যরা কোনো তথ্যই দিচ্ছিল না। আবার নারী হওয়ায় কোনো উপায়ও পাওয়া যাচ্ছিল না। তবে সময় নিয়ে কৌশল অবলম্বন করে তাদের আলাদা করে পাপিয়ার কাছ থেকে কিছু তথ্য বের করা হয়। পাপিয়া সব সময়ই আমাদের ভয়ভীতি দেখিয়েছেন। র‌্যাব সদস্যরা কোনোভাবেই তার কথায় বিচলিত হয়নি। তার এত ক্ষমতার উৎস কোথায় র‌্যাবকে সেটাও বলেননি পাপিয়া।’

র‌্যাব সুত্র জানায়, পাপিয়া-সুমন দম্পত্তির অপকর্মের সঙ্গে আর কারা জড়িত সে বিষয়েও খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। যতবড় ক্ষমতাশালীই হোক না কেন, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। তবে পাপিয়ার অপকর্মের সঙ্গে এখন পর্যন্ত কোনো সংসদ সদস্য বা মন্ত্রীর সংশ্লিষ্টতা পায়নি র‌্যাব।

আরও পড়ুন: পাপিয়া-মফিজুর দম্পতির নামে আরও দু’টি মামলা

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া বিভিন্ন ছবির বিষয়ে জানতে চাইলে র‌্যাবের গণমাধ্যম শাখার সহকারী পরিচালক এএসপি সুজয় সরকার কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে র‌্যাবের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘ছবি যে কেউ তুলতে পারে। সেই ছবি যদি কেউ ব্যবহার করে টাকা উপার্জন করে তবে তা হবে প্রতারণা। আর সেই প্রতারণার দায় তাকেই নিতে হয়। পাপিয়ার বেলাতেও তাই হবে। অপরাধের সঙ্গে ছবির ব্যক্তি কখনো জড়িত হয় না। র‌্যাব এমন কোনো তথ্য খুঁজে পায়নি। আর যারা না বুঝে ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়াচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ যে কেউ আইনের আশ্রয় নিতে পারেন।’

গত ২২ ফেব্রুয়ারি পাপিয়া ও তা স্বামী মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরী, সাব্বির আহমেদ ও শেখ তায়্যিবাকে অর্থপাচার ও জাল মুদ্রা রাখার অভিযোগে আটক করে র‌্যাব। পরে তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে বিদেশি মদ, পিস্তল, গুলি ও প্রায় ৬০ লাখ টাকা উদ্ধার করে। এ ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে বিমানবন্দর ও শেরেবাংলা নগর থানায় আলাদা তিনটি মামলা হয়। বিমানবন্দর থানার মামলায় পাপিয়াসহ চারজনকে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠালে ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে।

২০০৬ সালে নরসিংদী কলেজে ইন্টারমেডিয়েট প্রথম বর্ষে পড়ার সময় মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরীর সঙ্গে পাপিয়ার পরিচয় হয়। এরপর সেই সম্পর্ক প্রেমে রূপ নেয়। এর তিন বছর পর ২০০৯ সালে তারা বিয়ে করেন। ২০১০ সালে বিবাহিত অবস্থায় নরসিংদী পৌর ছাত্রলীগের পদ পান পান। এরপর শুধুই এগিয়ে যাওয়া তাদের। গড়ে তোলেন নিজস্ব ক্যাডারবাহিনী ‘কিউ অ্যান্ড সি’। এই ক্যাডার বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যের হাতে ও পিঠে ট্যাটু আঁকা আছে। বিয়ের সময় তেমন কিছু না থাকলেও গত ১০ বছরের ব্যবধানে গড়েছেন অঢেল সম্পদ। যার বেশির ভাগই ২০১৮ ও ২০১৯ সালে অবৈধভাবে অর্জন করেছেন।

সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন