বিজ্ঞাপন

সাম্যের লড়াইয়ে নারীবাদী ‘মেয়ে নেটওয়ার্ক’

March 6, 2020 | 10:00 am

সিরাজুম মুনিরা, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর

বর্তমান সময়ে যে দর্শনটি সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত হয়, সম্ভবত তার নাম নারীবাদ। কিছুটা দেরিতে হলেও বাংলাদেশে লেগেছে নারীবাদের ঢেউ। মানে, এই দেশে নারীবাদী মানুষ যেমন তৈরি হচ্ছে, তেমনি তাকে প্রতিহত করতে বা এই মতকে দমন করতেও প্রস্তুত থাকছেন একদল।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মনে নারীবাদ সম্পর্কে কিছু ধারণা আছে। যার বেশিরভাগই নেতিবাচক। পরিচিত অনেক মানুষের কাছেই আমি জানতে চেয়েছি নারীবাদ কী? জবাবে তারা বিভিন্নভাবে বলেছেন যে, নারীবাদ হলো পুরুষবিদ্বেষ। নারীবাদ মানে পুরুষের সমান হতে চাওয়া। অনেকেই পুরুষের সমান অধিকার পাওয়ার সঙ্গে সড়কের পাশে যত্রতত্র মুত্রত্যাগের স্বাধীনতার প্রসঙ্গ এনেছেন।

নারীবাদ মানে যে মানুষে মানুষে সমতা, নারীবাদ যে সব মানুষের সমান অধিকারের কথা বলে সেটা অনেকে জানেনই না। এমন বাস্তবতায় এই দেশে নারীবাদকে জানাতে, নারীবাদ নিয়ে কথা বলতে তৈরি হয়েছে অনেক ছোট ছোট উদ্যোগ। এসব উদ্যোগের ফলাফল হিসেবে, নারীবাদ ইতিবাচক হিসেবে পৌঁছে যাচ্ছে ঘর থেকে ঘরে, মানুষের মন থেকে চেতনায়।

বিজ্ঞাপন

এবছর নারী দিবসের আগে সারাবাংলা কথা বলেছে তেমনই একটি উদ্যোগের প্রতিষ্ঠাতার সঙ্গে। উদ্যোগটির নাম ‘ মেয়ে নেটওয়ার্ক ‘। সারাবাংলার সঙ্গে এই নেটওয়ার্ক নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করেছেন এর প্রতিষ্ঠাতা ও সংগঠক তৃষিয়া নাশতারান। পেশায় তিনি একজন গবেষক এবং ফোরসাইট স্ট্র্যাটেজিস্ট।

তৃষিয়ার কাছে জানতে চাই, মেয়ে নেটওয়ার্ক কী?

জবাবে তিনি জানালেন, মেয়ে নেটওয়ার্ক বাংলাভাষী নারীদের দ্বারা পরিচালিত একটি নারীবাদী প্ল্যাটফর্ম। স্বভাবে এটি একটি তৃণমূল সংগঠন, যেখানে সাধারণ মেয়েরা একত্রিত হয়ে কাজ করে। ডিজিটাল যুগের ভাষায় মেয়ে একটি অরগানিক প্ল্যাটফর্ম, যেখানে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে মানুষ একত্রিত হয়। আমরা অনলাইন নেটওয়ার্কিংয়ের মাধ্যমে চিন্তাভাবনা করি এবং অফলাইন অ্যাক্টিভিজমের মাধ্যমে ভাবনার বাস্তবায়ন করি।

বিজ্ঞাপন

তৃষিয়া বলেন, বাংলাভাষী সমতাকামী মানুষদেরকে নিয়েই মেয়ে নেটওয়ার্ক। অর্থাৎ বাংলায় কথা বলতে পারে এবং মানুষের সমতায় বিশ্বাসী এমন সকল মানুষকে একত্রিত করে কাজ করতে সচেষ্ট থাকে মেয়ে নেটওয়ার্ক।

অর্থাৎ আমরা দেখছি, ভাষাটা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। ভারী ভারী তত্ত্ব কিংবা বিদেশি ভাষায় লেখা রেফারেন্স দিয়ে নয়। এখানে নারীবাদ আলোচনা করা হচ্ছে নিজের ভাষায়। যে ভাষা বুঝতে ও বোঝাতে সহজ, ফলে ভাষা ভীতির কারণে নারীবাদ সম্পর্কে জানাশোনাটা বন্ধ হয়ে যায় না।

শুরুর গল্প:

মেয়ে নেটওয়ার্কের যাত্রা শুরু হয়েছিলো ২০১১ সালে একটা ফেসবুক গ্রুপ থেকে। কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই এর সূত্রপাত। তৃষিয়া বলেন, ‘কর্মজীবনের শুরু থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। এর মধ্যে জেন্ডারভিত্তিক বৈষম্য কমবেশি সবখানে উপস্থিত ছিলো। আমার জন্য ব্যাপারটা একদম নতুন ছিলো। কারণ পরিবারে এবং স্কুল-কলেজে এ ধরনের বৈষম্য কখনো অনুভব করিনি আমি। আমার অনভ্যস্ত চোখে নারী ও পুরুষের প্রতি বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ খুব অস্বস্তি জাগাচ্ছিল। আরও অবাক হচ্ছিলাম যখন দেখছিলাম বৈষম্যকারী কখনো কখনো নারীই। আবার অনেক নারী এই বৈষম্যগুলোকে সহজ চোখে মেনেও নিচ্ছে। এসব দেখতে দেখতে প্রতিনিয়ত মনে নানান প্রশ্ন আর বিরক্তি জমা হচ্ছিল। আমি চাইছিলাম প্রথমে মেয়েদের সাথে আলাপ করে প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে। সেই চাওয়া থেকে ২০১১ সালের জুন মাসে মেয়ে নামে একটা গ্রুপ খুলি ফেসবুকে।’

বিজ্ঞাপন

‘সেখানে আমার চেনা মহলের নারীদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। শুরুতে আমরা শুধু গল্প করতাম। হাত পা ছড়িয়ে বসে আড্ডা দিতে দিতে আমরা এক থেকে অনেক হয়ে উঠতে থাকি। একটা সময় আমরা আবিষ্কার করি যে আমরা সবাই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কিছু দলছুট, লক্ষ্মীছাড়া নারী, যারা একই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফিরছি। এভাবে দল বেঁধে আলাপ করতে করতে আর প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে মেয়ের যাত্রা শুরু। তবে শুরুতে এটা নেটওয়ার্ক ছিলো না। শুধু একটা গ্রুপ ছিলো। নেটওয়ার্কের রূপ নিতে শুরু করে ২০১৩ সালে, যখন গণজাগরণের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের সহযোদ্ধাদেরকে খুঁজে পাই এবং রানা প্লাজা ধসের পরে আমাদের স্বেচ্ছাসেবীদের হাত ধরে সন্ধির যাত্রা শুরু হয়। একই বছর অক্টোবর মাসে উদ্যোক্তা বন্ধুদেরকে নিয়ে আমরা রাঙতা নামের মেলা করি। আমাদের জানা মতে, সেসময় রাঙতা বাংলাদেশের প্রথম কোনো মেলা যেখানে প্রকাশ্যে পাকিস্তানি পণ্য বর্জন করার ঘোষণা দেওয়া হয়।’

সেবার মেলা সফল ছিল জানিয়ে তৃষিয়া বলেন, ‘মেলার সাফল্যের পরে আমাদের কাজের চাপ বাড়তে থাকে। অনলাইনের সীমানা পেরিয়ে অফলাইনে কাজ বাড়তে থাকে। ২০১৩ সালের শেষভাগ আর ২০১৪ সালের মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে মেয়ে গ্রুপ থেকে নেটওয়ার্কে রূপ নেয়। বাংলাভাষী নারীদের নিয়ে জেন্ডারভিত্তিক সমতা বিষয়ক চিন্তাভাবনার জন্য আরো বড় পরিসরে সিস্টারহুড নামের একটা গ্রুপ খুলি আমরা। সেই সঙ্গে সন্ধি ও রাঙতার কাজকে আরো গুছিয়ে আনা হয়। এভাবে কাজ করতে করতে সময়ের প্রয়োজনে একটা ছোট ফেসবুক গ্রুপ থেকে মেয়ে নেটওয়ার্কের শুরু।’

খুব চিন্তাভাবনা করে নেটওয়ার্কের নাম ‘মেয়ে’ রাখা হয়নি বলে জানালেন তৃষিয়া। তিনি বলেন, যেহেতু মেয়েদেরকে নিয়ে আলাপ করার জন্য গ্রুপ খুলেছিলাম তাই মেয়ে নাম রেখেছিলাম। তবে পরে যখন এটা কলেবরে বাড়তে লাগলো, তখন নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব রেখেছিলাম। সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে সেটা আর হয়ে ওঠেনি। মেয়ে নামটাই সবার পছন্দ। তাই এটাই রয়ে গেল।

যে লক্ষ্য নিয়ে মেয়ে নেটওয়ার্কের যাত্রা শুরু হয়েছিল তার কতটুকু পূরণ হয়েছে, জানতে চাই তৃষিয়ার কাছে।

জবাবে তিনি বলেন, ‘যেমনটা আগেই বলেছি, সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য নিয়ে মেয়ে শুরু হয়নি। এক ধরনের ব্যক্তিগত যাতনা থেকে আটপৌরেভাবে মেয়ে শুরু হয়েছিল। সেদিক দিয়ে মেয়ে আমাদের কল্পনাকেও ছাড়িয়ে গেছে। ২০১১ সালে শুরু হওয়া ফেসবুক গ্রুপ যে একটা শক্তিশালী প্ল্যাটফর্মে রূপ নেবে, সেটা আসলে আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি। এই দীর্ঘ ও বর্ণাঢ্য পথচলা সম্ভব হয়েছে অক্লান্ত স্বেচ্ছাশ্রম, সততা আর সৃজনশীলতার মাধ্যমে। আমরা নিজেদেরকে কোনো নির্দিষ্ট ছকে আবদ্ধ না রেখে সময়ের প্রয়োজনে নতুন নতুন আইডিয়া প্রয়োগ করেছি, স্ট্র্যাটেজি বদলেছি, যার যতটুকু সামর্থ্য আছে তা দিয়ে একসাথে কাজ করেছি। মেয়ের মাধ্যমে আমরা জেনেছি যে এখানে আমরা একা নই। একই প্রশ্ন, একই যাতনা আমাদের অনেকের আছে। আমরা জেনেছি যে নারী পুরুষের বৈষম্যের শেকড় হচ্ছে পুরুষতন্ত্র। এর উৎখাত না হওয়া পর্যন্ত বৈষম্য দূর হবার নয়। মেয়ে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আমরা ছোট পরিসরে একটা আত্মসচেতন নাগরিক গোষ্ঠী তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি। তবে পুরুষতন্ত্র উৎখাত করতে আমাদেরকে আরো অনেক দীর্ঘ পথ বাড়ি দিতে হবে।’

মেয়ের কাজের পরিসর:

মেয়ে বর্তমানে তিনটি প্রধান শাখায় কাজ করে। সিস্টারহুড, সন্ধি ও রাঙতা।

সিস্টারহুড: বাংলাভাষী নারীদের একটি বিকল্প সাপোর্ট সিস্টেম। পরিবার আর সমাজ যখন মুখ ফিরিয়ে নেয়, তখন সিস্টারহুড মানসিক সমর্থন, চিকিৎসা এবং আইনি পরামর্শের মাধ্যমে নারীদের পাশে দাঁড়ায়। ২০১৫ সালে পহেলা বৈশাখে টিএসসিতে যৌন হয়রানির প্রতিবাদে সিস্টারহুড ‘আরেক বৈশাক’ নামের উৎসবের আয়োজন করে আলোচিত হয়েছিল। এর পরের বছর মেয়ে থেকে আয়োজিত হয় রংবাজি নামের ইভেন্ট, যেখানে নারীরা নিমতলিতে রিকশাপেইন্টের মাধ্যমে যৌনসহিংসতাবিরোধী শ্লোগান এঁকেছিল। এছাড়া পারিবারিক সহিংসতা, তালাক ও শিশু নির্যাতন নিয়ে একাধিক কর্মশালা ও ক্যাম্পেইন হয়েছে সিস্টারহুড থেকে।

সন্ধি: মেয়ে নেটওয়ার্কের স্বেচ্ছাসেবামূলক শাখা যেটি আর্তমানবতার সেবার নিয়োজিত। রানা প্লাজা ধসের পর এর যাত্রা শুরু। এরপর বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগে আর্থিক ও কায়িক শ্রমের মাধ্যমে সন্ধির স্বেচ্ছাসেবীরা মানবতার ডাকে সাড়া দিতে চেষ্টা করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু দুর্ঘটনা হলো পেট্রোল বোমা হামলা (২০১৩), নেপালে ভূমিকম্প (২০১৫), উত্তরবঙ্গের হাওর অঞ্চলে জলোচ্ছ্বাস (২০১৭), পাহাড়ে সহিংসতা (২০১৭)। সাভারে সাভারে গার্মেন্ট শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য নির্মিত স্কুল ‘সংকলন পাঠশালা’য় সন্ধি অর্থযোগ করেছে। এছাড়া শিশুদেরকে নিয়ে সন্ধি বিভিন্ন ধরনের আনন্দময় কর্মশালার আয়োজন করে থাকে। গত তিন বছর ধরে সন্ধি কাজ করছে হাজেরা বেগমের সাথে, যিনি যৌনকর্মীদের সন্তানদেরকে মায়ের স্নেহ দিয়ে লালন করছেন।

রাঙতা: মেয়ে নেটওয়ার্কের সবচেয়ে ছোট অথচ দৃশ্যমান শাখা হচ্ছে রাঙতা। এর শুরু হয়েছিলো পাকিস্তানি পণ্যমুক্ত মেলা হিসেবে। সময়ের সঙ্গে এটি নবীন উদ্যোক্তা তৈরির কারখানায় রূপান্তরিত হয়। ২০১৬ সাল থেকে রাঙতা মেয়ে নেটওয়ার্কের আর্থিক যোগানদাতার ভূমিকায় রয়েছে। সন্ধি ও রাঙতার মাধ্যমে নারী ছাড়া অন্য জেন্ডারের মানুষদের সঙ্গে মেয়ে নেটওয়ার্কের যোগাযোগ স্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

এই পর্যায়ে তৃষিয়ার কাছে প্রশ্ন ছিল, এতো কর্মযজ্ঞ কারা সামলান? তারা কী বেতনভুক্ত কর্মী?

তৃষিয়া বলেন, মেয়ের সদস্যরাই কাজগুলো করেন। কোনো সদস্য যখন কোনো সমস্যা কিংবা আইডিয়া উত্থাপন করেন তখন তাকে সেই আইডিয়া বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। বাকিরা তাদের সামর্থ অনুযায়ী স্বেচ্ছাসেবি হিসেবে যোগ দেন। আমরা নিজেদেরকে ভলান্টিয়ার বলতে ভালোবাসি। সবাই মিলে কাজগুলো করে ফেলি।

মেয়ে নেটওয়ারর্কে দীর্ঘ যাত্রায় একটি প্রশ্নের মুখোমুখি তৃষিয়াকে বারবার হতে হয়েছে। সেটি হলো, জেন্ডারের সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য শুধু নারীদের জন্য প্ল্যাটফর্ম কেন? পুরুষদের অংশগ্রহণের কি প্রয়োজন নেই?

তৃষিয়া বলেন, ‘পুরুষদের অংশগ্রহণের প্রয়োজন অবশ্যই আছে। সময়ের সাথে সাথে আমরা আমাদের প্ল্যাটফর্মকে সকল জেন্ডারের জন্য প্রসারিত করেছি। তবে সিস্টারহুড শুরু থেকে সম্পূর্ণ নারীকেন্দ্রিক। এর পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী একজন প্রান্তিক মানুষ। শিক্ষায়, যোগ্যতায়, আর্থিক বা পেশাগত অবস্থান ইত্যাদিতে নারী যতই অগ্রসর হোক না কেন, পুরুষতন্ত্র নারী সবসময় পুরুষের থেকে পশ্চাতপদ মানুষ। গবেষণা এবং পরিসংখ্যান যেমন এই বক্তব্য সমর্থন করে, তেমনি মেয়ে নেটওয়ার্কে হাজার হাজার নারীর জীবন থেকে উঠে আসা অসংখ্য গল্প এই কদর্য সত্যকে তুলে ধরে। এমন একটা সমাজে একজন নারীর ভাবনার প্রকাশের জন্য নিরাপদ এবং নির্বিঘ্ন একটি জায়গা থাকা খুবই প্রয়োজন বলে মনে করি আমরা। এ জন্য সিস্টারহুড শুধুমাত্র নারীদের জন্য। এখানে নারীরা নিজেদের গল্প ও জ্ঞানের সমন্বয়ে একতাবদ্ধ হয়ে বৈষম্যহীন ভবিষ্যতের পথকে প্রসারিত করতে চেষ্টা করে।’

তবে এই পথে অনেক নারীবাদী পুরুষ ও তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি যোগ দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে আসছিলেন জানিয়ে তৃষিয়া বলেন, ‘সে কারণে গত বছর আমরা সব জেন্ডারের মানুষের জন্য বন্ধু মানুষ নামে একটি নতুন প্রকল্প শুরু করেছি। তাছাড়া সন্ধি আর রাঙতার মাধ্যমে অফলাইনে সব জেন্ডারকে নিয়ে কাজ আগে থেকেই হয়ে আসছে মেয়ে নেটওয়ার্কে। অনলাইনে আমাদের ফেসবুক পেইজ এবং ওয়েবসাইটও সবার জন্য উন্মুক্ত।’

‘মেয়ে’র সবথেকে বড় সাফল্য হিসেবে মেয়েদের ঐক্যকে চিহ্নিত করলেন তৃষিয়া নাশতারান। তিনি বলেন,  পুরুষতন্ত্রের জনপ্রিয় বুলি ‘মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু’-কে ভুল প্রমাণ করে মেয়ে নেটওয়ার্ক নারীদের বন্ধুতার একটা মঞ্চ গড়ে তুলতে এবং ধরে রাখতে পেরেছে। কোনো পুঁজি অথবা পূর্ব-অভিজ্ঞতা ছাড়া একটা সংগঠন নয় বছর টিকে থাকা, কোনো বাহ্যিক সহায়তা ছাড়া নিজের ব্যয়ভার বহন করতে পারাটাকেও বিরাট সাফল্য মনে করি আমি।

এই নয় বছরে মেয়ে নেটওয়ার্কে ঝুলিতে জমা পড়েছে সাফল্যের ছোট ছোট অসংখ্য গল্প। সেসব মেয়েদের ব্যক্তিগত বিষয় তাই, প্রকাশ করা সমীচীন নয় বলে মনে করেন এই সংগঠক। তিনি বলেন, যখনই কোনো সংকট উপস্থিত হয়েছে, তা হোক ব্যক্তিগত কিংবা সামাজিক, মেয়ের সদস্যরা যে যার অবস্থান থেকে এগিয়ে গিয়ে সাধ্যমতো সাহায্য করেছে। মানুষ এখানে মানসিক সহায়তা পেয়েছে, আইনি সহায়তা পেয়েছে, চিকিৎসা বিষয়ক দিকনির্দেশনা পেয়েছে, কাজ পেয়েছে।

এমনকি সম্পূর্ণ অচেনা মানুষকে বিপদের সময় তার বাড়িতে গিয়ে সহযোগিতা করা, নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেওয়া, আর্থিক অনটনে পড়ালেখা কিংবা চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করার মতো কাজও করেছেন নেটওয়ার্কের সদস্যরা।

তৃষিয়া বলেন, কোনো প্রাপ্তির প্রত্যাশা না রেখে মানুষের জন্য নীরবে কাজ করে যেতে পারা ভালো মানুষগুলোকে একত্রিত করতে পারা মেয়ের অন্যতম সাফল্য। মেয়ের আরেকটা বড় সাফল্য রাঙতা। যে সময় রাঙতা শুরু হয়েছিল, সে সময়ে বাংলাদেশের বাজার পাকিস্তানি পণ্য, বিশেষ করে পাকিস্তানি লন কাপড়ে ছেয়ে ছিলো। একটা ক্রেতা শ্রেণি ছিলো যারা বাংলাদেশি লেবেল দেখলে জিনিস কিনত না। এমনকি বাজারে দেশি কাপড় পাকিস্তানি নামে বিক্রির নজিরও পাওয়া যেত। আমরা যখন রাঙতার ব্যানারে লিখলাম ‘এখানে কোনো পাকিস্তানি পণ্য পাওয়া যাবে না’, তখন কেউ কেউ সমালোচনা করেছিল, হাসাহাসিও করেছিল। বলেছিল এভাবে নাকি ব্যবসা হয় না। রাঙতা শুধু যে ব্যবসাসফল হয়েছে, তা-ই না। রাঙতা থেকে এক ঝাঁক সচেতন উদ্যোক্তা ও ক্রেতা তৈরি হয়েছে যারা ব্যবসার আগে আদর্শ এবং মানবিকতা যাচাই করে নেয়। এখন বাংলাদেশে শুধুমাত্র দেশি পণ্যের অনেক অনেক মেলা হয়, অনলাইনে বেশ কিছু গ্রুপ আছে যারা দেশি উদ্যোক্তা তৈরি করে। এই যাত্রার একদম শুরুর দিকের পথিক রাঙতা। সেটা আমাদের সফলতার একটি প্রিয় স্মৃতি।

মেয়ের চলার পথে বাধা এসেছে, চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হয়েছে, ছিল সীমাবদ্ধতাও।

সে প্রসঙ্গে তৃষিয়া বলেন, ‘শুরুতে নারীকেন্দ্রিক একটা প্ল্যাটফর্ম বলে কেউ কেউ তাচ্ছিল্যের চোখে দেখত। ভাবিদের আড্ডা, কিটি পার্টি ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে কটু কথা বলত কেউ কেউ। তবে এগুলো গুরুতর কিছু নয়। যারা এসব কথা বলত, সময়ের সাথে সাথে মেয়ের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা যেমন তৈরি হয়েছে, তেমনি তারা নিজেরাও মেয়ের বিভিন্ন প্রকল্পে যুক্ত হয়েছে। এছাড়া অনলাইনে সরব উপস্থিতি দেখে মেয়ে নেটওয়ার্ককে হালকাভাবে নেওয়ার প্রবণতা দেখেছি কারো কারো মধ্যে। নতুন যেকোনো কিছুকে নিজের জায়গা করে নিতে কিছু অনভ্যস্ত চোখের অস্বস্তি ডিঙাতে হয়। সময়ের সাথে সাথে এই অভ্যাসগুলো বদলাবে আশা করি।’

‘আর যদি সীমাবদ্ধতার কথা বলি তাহলে সেগুলো মূলত অনলাইনে। আমরা যেহেতু অনলাইনে বেশি নেটওয়ার্কিং করি, অনলাইন প্রাইভেসি নিয়ে আমাদেরকে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। সিস্টারহুড ও বন্ধু মানুষ গ্রুপে নিজের পরিচয় আড়াল করে পোস্ট দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তাতে সংবেদনশীল তথ্যের নিরাপত্তা অনেকখানি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। কিন্তু যত যা-ই করা হোক না কেন, অনলাইনে প্রাইভেসি কখনো শতভাগ নিশ্চিত নয়। অনেকের ডিজিটাল লিটারেসির অভাব রয়েছে। ফলে না বুঝে তথ্যের ভুল প্রয়োগ হয় হরদম। অনলাইন যোগাযোগের সীমাবদ্ধতার কারণে প্রায়শই আবেগ, অনুভূতি, প্রকাশভঙ্গি ভিন্নভাগে প্রকাশ পায়। এতে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ সৃষ্টি হয়। এসব কারণে অতীতে কিছু অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা হয়েছে আমাদের। কেন জানি, অনেকে মনে করেন অনলাইনে যা দেখতে বা পড়তে পাওয়া যায় তার সব যেভাবে খুশি ব্যবহার করা যায়। দেখা গেছে শিক্ষাগতভাবে যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিরাও বিনা অনুমতিতে অন্যের ব্যক্তিগত এবং সংবেদনশীল তথ্যের অন্যায় প্রয়োগ করেছেন। এসব ক্ষেত্রে এই মানুষগুলোকে আমরা বর্জন করেছি ‘

নয় বছরে অল্প কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত অভিজ্ঞতাও জমা হয়েছে মেয়ে নেটওয়ার্কের ঝুলিতে। এরমধ্যে যে ঘটনার কথা বললেন তৃষিয়া সেটি সাংগঠনিক। ২০১৫ সালে মেয়ে নেটওয়ার্কের পৃষ্ঠপোষকতায় ও সিস্টারহুডের সদস্যদের নিয়ে গড়ে ওঠা একটি প্রকল্প নেটওয়ার্কের অজ্ঞাতসারে স্বতন্ত্র সংগঠন হিসেবে গণসংযোগ ও আর্থিক যোগাযোগ শুরু করে। মেয়ে নেটওয়ার্কে কখনোই এমনটা হয়নি। এখানে সবাই আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেয় ও সকল হিসাব সবার জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়। ফলে ওই প্রকল্পটির আদর্শগত স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এটা মেয়ে নেটওয়ার্কের জন্য একটা ধাক্কা ছিল।

তৃষিয়া বলেন, ‘ওটা আমাদের জন্য অনেক বড় একটা ধাক্কা ছিল। উপযুক্ত প্রমাণ পাওয়ার পরে আমরা তাদের সাথে সবরকমের সম্পর্ক চ্ছিন্ন করি, যার জের দীর্ঘদিন ধরে বইতে হয়েছিলো আমাদের। সেই ক্ষতি পূরণ করতে একদিকে আমাদেরকে যেমন পরিশ্রম বাড়াতে হয়েছিল, অন্যদিকে সাংগঠনিকভাবে আমরা আরো সজাগ হয়ে উঠতে পেরেছিলাম।’

`মেয়ের লোগো সেই সময় তৈরি করি। এই লোগোটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এর মাধ্যমে মেয়ে নেটওয়ার্কে নারীদের গড়ে তোলা বলয়ের মাঝে সীমাহীন সম্ভাবনা তুলে ধরা হয়েছে।’

মেয়ে’র ভবিষ্যত পরিকল্পনা:

মেয়ে নেটওয়ার্কের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য লৈঙ্গিক বা জেন্ডার সমতা। মেয়ে নিজেকে নারীবাদী সংগঠন বলে পরিচয় দেয়। আমরা স্বেচ্ছাশ্রম, সৃজনশীলতা এবং সুশিক্ষার মাধ্যমে নারীবাদের বিস্তার ও জেন্ডারের সমতার প্রসারে কাজ করে যেতে চাই।

যেহেতু নারীবাদ নিয়ে এখনো আমাদের মনে অনেক প্রশ্ন, অনেক জিজ্ঞাসা রয়েছে গেছে, তাই সারাবাংলার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে কিছু বার্তা পৌঁছে দিতে চান তৃষিয়া।

তিনি বলেন, ‘সবাইকে বলব নারীবাদ সম্পর্কে খোলা মনে পড়ালেখা করতে ও নারীবাদী হয়ে উঠতে। নারীবাদ নিয়ে আমাদের দেশে নানান বিভ্রান্তিমূলক চিন্তাভাবনা রয়েছে। কেউ ভাবেন নারীবাদীরা পুরুষবিদ্বেষী, কেউ আবার ভাবেন যারা নারীদের ব্যাপারে কথা বলেন তারা সবাই নারীবাদী। বিশেষ করে অনলাইনে অল্পবিদ্যাকে নির্ভর করে এক ধরনের নারীবাদবিদ্বেষ চোখে পড়ে, যেটা নারীবাদের লড়াইটাকে আরো কঠিন করে তোলে। অনেকে জানেন না যে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যে কেউ পুরুষতান্ত্রিক হতে পারে, আবার নারীবাদীও হতে পারে। পুরুষতন্ত্র শুধু যে নারীকে অবদমিত করে তা নয়। পুরুষও পুরুষতন্ত্রের বলি হচ্ছে হরদম। এই ব্যাপারগুলো বুঝতে হলে খোলা মনে সমাজকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে, পড়ালেখা করতে হবে, বৈষম্যের গল্পগুলো কান পেতে শুনতে হবে। তার জন্য সবার মেয়ে নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়া জরুরি নয়। সেটা সম্ভবও নয়। যে যার অবস্থান থেকে এই যাত্রায় অংশগ্রহণ করতে পারেন।’

বাইরের কেউ যদি মেয়ে নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হতে চান তাহলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগের সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে মেয়ের ফেসবুক পেইজে মেসেজ পাঠানো কিংবা ইমেইল করা। পেইজের লিংক- https://www.facebook.com/meyenetwork/, ইমেইল ঠিকানা: meyenetwork@gmail.com.

সবশেষে জানতে চাই, তৃষিয়ার নারী দিবস ভাবনা। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে নারী দিবস হচ্ছে বাসে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের মতো। নারী এখনো প্রান্তিক মানুষ। তাই এগুলো আছে। আমি চাই এমন একটা দিন আসুক যখন নারী দিবসের প্রয়োজন থাকবে না আর।’

সারাবাংলা/এসএমএন

Tags: , , , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন