বিজ্ঞাপন

উন্নয়ন অনেক হলো, এবার চাই সুশাসন

March 6, 2020 | 5:40 pm

প্রভাষ আমিন

বাংলাদেশে এখন অন্যরকম এক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সরকারি দলের সাথে বিরোধী দলের দারুণ মিল-মোহাব্বত; যার উদাহরণ বাংলাদেশে তো বটেই, বিশ্বেই খুব একটি নেই। জাতীয় পার্টি হলো পোষা বিরোধী দল। বর্তমান সরকারের গত টার্মে তো জাতীয় পার্টি এক অভিনব বিশ্বরেকর্ড গড়েছিল। একই সঙ্গে সরকারে এবং বিরোধী দলে থাকার উদাহরণও খুব বেশি থাকার কথা নয়।

বিজ্ঞাপন

আমরা অভ্যস্ত ছিলাম বিক্ষুব্ধ বিরোধী দলে। কথায় কথায় গালাগাল, চিৎকার-চেচামেচি, ওয়াকআউট, বয়কট, ভাংচুর, পাল্টাপাল্টিতে সংসদ সদা উত্তপ্ত থাকতো। আমরা সবাই বললাম, এ কেমন কথা। বিরোধী দল অবশ্যই সরকারের সমালোচনা করবে, তবে সেটা হতে হবে গঠনমূলক।

আমাদের চাওয়া পূরণ হয়েছে, একটু বেশিই হয়েছে। গঠনমূলক তো অনেক পরের কথা, বিরোধী দল সমালোচনাই করতে চায় না। বক্তৃতা শুনে বোঝার উপায় নেই বক্তা সরকারি দলের না বিরোধী দলের। বাংলাদেশে অনেকদিন ধরেই সংসদ নেতা ও বিরোধী দলীয় নেতা নারী। ১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের পর থেকে এটা প্রায় রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। শুরুতে সেটা শেখ হাসিনা আর খালেদা জিয়ার মধ্যে অদলবদল হতো। কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি এই রেওয়াজের চরিত্র বদলে দিল। এখনও বিরোধী দলীয় নেতা একজন নারী। তবে তিনি খালেদা জিয়া নন। বেগম রওশন এরশাদ, টানা দুই সংসদে বিরোধী দলীয় নেতার আসন অলঙ্কৃত করছেন তিনি। তবে জাতীয় পার্টি যতই পোষা হোক, রওশন এরশাদ সুযোগ পেলেই সরকারের ভুল ধরিয়ে দেন, সমালোচনা করেন; তবে সেটা অবশ্যই আমাদের চাওয়ামত গঠনমূলক সমালোচনা।

গত মাসে সংসদের বছরের প্রথম অধিবেশনের সমাপনীর দিনে সংসদ নেতা এবং বিরোধী দলীয় নেতার মধ্যে হালকা বিতর্ক হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী সংসদ অধিবেশনের সমাপনী দিনে সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর ঠিক আগে বক্তব্য রাখেন বিরোধী দলীয় নেতা। সর্বশেষ অধিবেশনের সমাপনী দিনে বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ বলেন, ‘ব্যাংকে টাকা নেই, অনেকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত দেয়নি, টাকা বাইরে নিয়ে গেছে, সোনা তামা হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে কীভাবে বাংলাদেশ মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরকে টপকে যাবে; তার একটি ব্যাখ্যা অর্থমন্ত্রীর দেয়া উচিত।’

বিজ্ঞাপন

নিয়ম অনুযায়ী, বিরোধী দলীয় নেতার পরে অর্থমন্ত্রীর ব্যাখ্যা দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে বিরোধী দলীয় নেতার প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ব্যাংকে টাকা নেই, বিরোধী দলীয় নেতার এ অভিযোগ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘দেশের রিজার্ভ এখন ৩২ বিলিয়ন ডলারের ওপর। চিন্তার কিছু নেই। যে রিজার্ভ আছে, তাতে ছয় মাসের খাদ্য আনা যাবে। রেমিট্যান্স এসেছে ১৮ বিলিয়ন ডলার। ব্যাংকে টাকার কোনো অসুবিধা নেই, যথেষ্ট টাকা আছে। সেবা খাত, অবকাঠামোসহ প্রতিটি খাতে ব্যাপকভাবে উন্নয়মূলক কাজ হচ্ছে।’

প্রধানমন্ত্রী পাল্টা প্রশ্ন রাখেন, ‘টাকা যদি নাই থাকতো, তাহলে এগুলো কী করে হতো?’ বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে সিঙ্গাপুরের চেয়েও শক্তিশালী দাবি করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সিঙ্গাপুর ছোট দেশ, জনসংখ্যাও খুব কম। সেখানে শৃঙ্খলা আছে। সিঙ্গাপুরে বিরোধী দল বা অন্য কোনো কিছু নেই। একটা পত্রিকা সরকার দ্বারা চলে। সেখানকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশ যে রকম, তাতে উন্নয়ন করাটা অনেক সহজ। আর বাংলাদেশ আয়তনে ছোট, কিন্তু জনসংখ্যা অনেক বেশি। এখানে প্রতিনিয়ত অগ্নি সন্ত্রাস, খুনখারাবি, অত্যাচার- এগুলো মোকাবিলা করতে হয়। এখানে উন্নয়ন করা কঠিন কাজ।’

বিজ্ঞাপন

প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন, তার সাথে আমি দ্বিমত করছি না। তিনি তুলনামূলক বিবেচনায় বাংলাদেশকে এগিয়ে রাখছেন। এটা তো মানতেই হবে, অবকাঠামোগত উন্নয়নে অকল্পনীয় পরিবর্তন আসছে বাংলাদেশে। পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মত বড় প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলছে। মেট্রোরেল আর এক্সপ্রেসওয়ের কাজ প্রতিদিন বদলে দিচ্ছে ঢাকার চিত্র। উন্নয়ন নিয়ে প্রশ্ন নেই। তবে প্রশ্ন আছে দুর্নীতি নিয়ে, সুশাসন নিয়ে। সবক্ষেত্রেই অনিয়ম আর দুর্নীতির ফিসফাস। উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু তার ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। বাংলাদেশের উন্নয়ন ব্যয়, বিশ্বের যে কোনো দেশের তুলনায় বেশি। বিভিন্ন খাতে কেনাকাটায় যে অনিয়মের খবর পত্রিকায় আসে তা পিলে চমকে দেওয়ার মত। সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের নামে যে অনিয়মের খবর বেরোয়, তা অবিশ্বাসের সীমানাও ছাড়িয়ে যায়। কথায় কথায় বিদেশ যাওয়ার ঘটনা যে কোনো প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে দেয়। এমনকি পুকুর খনন দেখতে বিদেশে যাওয়ার খবরও পত্রিকায় দেখেছি। সরকারি কর্মকর্তাদের অধিকাংশ সফরই আসলে পিকনিক বা প্লেজার ট্রিপ। সরকার তার কর্মকর্তাদের সন্তুষ্ট রাখতে বিদেশে পাঠালে আপত্তি নেই। কিন্তু সমস্যা হলো, টাকাটা যায় জনগণের পকেট থেকে, জনগণের করের টাকায়। এক্ষুণি সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের ব্যাপারটি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। সত্যিকারের দরকার হলে অবশ্যই যাবে। কিন্তু সেই প্রয়োজনটা যেন সত্যিই হয়।

ব্যাংকের টাকার অভাব নেই, এটা যেমন সত্যি; তেমনি লুটপাটেরও তল নেই। বেসিক ব্যাংককে ধ্বংস করে দেওয়া আবদুল হাই বাচ্চু এখনও আরামসে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কেউ তার টিকিটিও ছুতে পারছে না। ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীরের পদ্মা ব্যাংক এখন নাম বদলে ফারমার্স ব্যাংক হিসেবে টিকে থাকার লড়াই করছে। পি কে হালদার তো সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা নিয়ে কানাডায় পাড়ি জমিয়েছেন। এই পি কে হালদার একাই একাধিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়ে গেছেন। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং তো বাঁচবে কিনা সন্দেহ। কানাডা যেন এখন বাংলাদেশী লুটেরাদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশিরা এই লুটেরাদের ঘৃণা জানাতে রাস্তায় নেমেছে। কিন্তু এতে তাদের কিছু যাবে আসবে বলে মনে হয় না। সময় এসেছে কানাডা বা অন্য দেশগুলোর সাথে সরকারি পর্যায়ে যোগাযোগ বাড়ানো, যাতে কোনো লুটেরা ব্যাংকের টাকা চুরি করে পৃথিবীর কোথাও গিয়ে শান্তিতে থাকতে না পারে।

আমাদের এখানে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। পত্রিকায় দেখলাম, বিভিন্ন ব্যাংকের মালিকরা পরস্পর যোগসাজশে ব্যাংক থেকে সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। এটা হলো এধারকা মাল ওধার। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিউটের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে বছরে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার করছে। এই সংস্কৃতি থেকে বেরোতে না পারলে রিজার্ভ যতই থাক আর রেমিট্যান্স যতই আসুক অর্থনীতি শক্ত ভিত পাবে না। এই লুটেরারা অর্থনীতির তলা ছিদ্র করে ফেলছে।

উন্নয়ন অনেক হয়েছে। এখন চাই টেকসই ও মানসম্পন্ন উন্নয়ন। চাই সুশাসন। সমাজের সবক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করতে পারলে সবচেয়ে ভালো। তবে প্রায়োরিটির ভিত্তিতে আর্থিক খাত, উন্নয়ন কাজের ব্যয় এবং সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের  বিষয়টিতে শৃঙ্খলা আনতে হবে। আপাতত এটা দিয়ে শুরু করতে পারলে, আমাদের অর্থনীতি আরো অনেক গতি পাবে। আমরা এগিয়ে যেতে পারবো পরবর্তী ধাপে।

বিজ্ঞাপন

লেখক: সাংবাদিক

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন