বিজ্ঞাপন

‘আনসাং উইমেন’ সম্মাননা পাওয়া ৯ নারীর গল্প

March 7, 2020 | 1:35 am

রাজনীন ফারজানা

ঢাকা: মুক্তিযুদ্ধ ও জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখায় ৯ নারী পেয়েছেন ‘আনসাং উইমেন ন্যাশন বিল্ডার্স ২০২০’ সম্মাননা। দ্য ডেইলি স্টার ও আইপিডিসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের আয়োজনে শুক্রবার (৬ মার্চ) রাজধানীর র‌্যাডিসন ব্লু ওয়াটার গার্ডেনে তাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। একনজরে সম্মাননা পাওয়া ৯ নারীর তথ্য তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য।

বিজ্ঞাপন

টেপরি রানী

১৯৭১ সালের শুরুর দিকে মাতং রায়ের সঙ্গে বিয়ে হয় ১৬ বছরের টেপরি রানীর। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মে মাসের মাঝামাঝি ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার বলিদ্বার গ্রাম নিজ বাড়ি থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে আটকের পর জিম্মি হন। ছয় মাস ধরে তাকে ক্যাম্পে নির্যাতন করার ফলে শ্রবণ প্রতিবন্ধীতে পরিণত হন। ক্যাম্প থেকে ফিরে আসার পর তার স্বামী তাকে গ্রহণ করেনি। জায়গা হয়নি সমাজেও। ৭২ সালের মার্চে জন্মগ্রহণ করে তার সন্তান সুধীর। স্থানীয়রা তাকে গ্রহণ তো করেইনি, উল্টো অবজ্ঞাভরে তাকে ডাকে পাঞ্জাবির ছেলে বলে। চাল কলে কাজ করে একাই সন্তানকে বড় করেছেন তিনি। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সরকার থেকে বীরাঙ্গনা উপাধি দেওয়ার পর সরকার থেকে তাকে নিয়মিত ভাতা ও বসবাসের জায়গা দেওয়া হয়। দুই কন্যা সন্তানের বাবা সুধীর অটোরিকশা চালিয়ে সংসার চালাচ্ছেন।

বিজ্ঞাপন

বিভা রানী

মুক্তিযুদ্ধের সময় অষ্টম শ্রেণিতে পড়তেন বিভা রানী। মে থেকে জুনের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তানিরা আক্রমণ করলে অন্যান্য নারীদের সঙ্গে আখ ক্ষেতে লুকিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি। শিকার হতে হয় অমানুষিক নির্যাতনের। স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনী তোড়কি বন্দরে তার বাবার দোকান পুড়িয়ে দেয়। এসময় বিভা রানীর পরিবার পালানোর চেষ্টা করলে একজন আরেকজনের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যান। হানাদার বাহিনীর হাতে জিম্মি হন কিশোরী বিভা।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন- জাতীয় জীবনে অবদান, সম্মাননা পেলেন ৯ নারী

পাকিস্তানিরা চলে যাওয়ার পর তার বাবা মেয়েকে খুঁজে বের করেন ও আগস্ট মাসে অনুকূল মজুমদারের সঙ্গে বিয়ে দেন। বিয়ের পর স্বামী ও পরিবারের সঙ্গে ভারতে পালিয়ে যান এবং দেশ স্বাধীন হলে ফিরে আসেন। সেলাই মেশিন চালিয়ে পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছেন সেই থেকে।

কিন্তু আজও সরকারি স্বীকৃতি মেলেনি বিভা রানীর। ৬০ বছরের বিভা রানীর জীবন সংগ্রাম শেষ হয়নি আজও। একমাত্র ছেলে একটি দুর্ঘটনার পর ভুল চিকিৎসার পর মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধীতায় ভুগছে। একা হাতে অভাবের সংসারে ছেলেকে নিয়ে আছেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

লায়লী বেগম

২০০৭ সালে সিডরের আঘাতে বদলে যায় বরিশালের লায়লী বেগমের জীবন। এই ঘূর্ণিঝড়ের কয়েক মাসের মধ্যে তার বাবা মারা যান এবং বড় ভাই অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় তার ছোট ভাই বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেলে মায়ের দেখাশোনার দায়িত্ব পড়ে লায়লীর ওপর। ধলভাবগার প্রত্যন্ত গ্রামে কাজের সুযোগও খুব কম। তাই অল্প কিছু জমিতে চাষবাসের কাজ শুরু করেন তিনি। কিন্তু এতে দু’জন মানুষের পেট চলা মুশকিল। পরে মাছ ধরতে শুরু করেন। শুরুতে অবজ্ঞা ও অসহযোগিতা পেলেও একসময় একরকম মনের জোরেই মাছ ধরা চালিয়ে যেতে থাকেন তিনি। সপ্তাহে প্রায় প্রতিদিন ছয় থেকে সাত ঘণ্টা সাগরে মাছ ধরেন। এভাবেই ৩৫ বছরের লায়লীই বরিশাল বিভাগের একমাত্র লাইসেন্সপ্রাপ্ত নারী জেলে।

কামরুন নাহার মুন্নী

টাঙ্গাইলের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক কামরুন নাহার। সমাজ থেকে দারিদ্র্য ও বাল্যবিয়ে বন্ধে কাজ করছেন তিনি। আর মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন খেলাধুলা। মেয়েদের মানসিক ও শারীরিকভাবে সচেতন করতে মেয়দের ফুটবল প্রশিক্ষণ দেন তিনি।

২০১১ সালে স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেয়। পরে জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে তাকে মেয়েদের জেলা ফুটবল দলের দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করা হয়। ২০১৬ সালে তার দল জেলা চ্যাম্পিয়ন হয়। ২০১৭ সালে তিনি টাঙ্গাইল অনূর্ধ্ব-১৭ বালিকা ফুটবল টিমের ম্যানেজার হন ও যুব গেমস জেতেন। পরের বছর তিনি জেলার অন্য একটি মেয়েদের ফুটবল দলের প্রশিক্ষক হন এবং জেএফএ অনূর্ধ্ব-১৪ মহিলা জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন হন।

সোনু রানী দাস

নারায়ণগঞ্জের টানবাজারের দলিত সম্প্রদায়ের সুইপার কলোনিতে জন্ম নেন সোনু। এই পল্লির প্রথম নারী হিসেবে তিনি গ্র্যাজুয়েশন করেন। বর্তমানে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে পড়ছেন। তার বড় ভাই ও স্বামীর উৎসাহে লেখাপড়া চালিয়েছেন।

শিক্ষিত হয়ে নিজ গোষ্ঠীর মানুষের অধিকারের জন্য কাজ করছেন সোনু। বিবিএ করার পর চাকরি করলেও সন্তানের জন্মের পর চাকরি ছেড়ে দেন। বর্তমানে নিজ কমিউনিটির মধ্যে বাল্যবিয়ে রোধ ও শিক্ষা বিস্তারের কাজ করছেন। নিজে টিউশন দেন এবং সবাইকে উচ্চশিক্ষার গুরুত্ব বোঝান।

কোহিনূর বেগম

সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার বোরঙ্গাইল গ্রামের সুবিধা বঞ্চিত মানুষগুলোর প্রধান শত্রু বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। দিনমজুরির ওপর নির্ভরশীল চরের এই মানুষগুলো কয়েক মাস চরম খাদ্যকষ্টে ভোগে। চরের পানি কমার পর আবারও কাজ শুরু করেন তারা। ওই কয়েক মাসের কষ্ট কমাতে কোহিনূর বেগমের মাথায় আসে দারুণ বুদ্ধি। তিনি কমিউনিটি ফুড ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। সুবিধার সময়ে গ্রামের লোকজন কোহিনূরের ফুডব্যাংকে বিনামূল্যে ধান-চাল জমা রাখেন। বন্যার সময় সেই খাবার কাজে লাগে তাদের। তারা এই ফুডব্যাংকের চেয়ারম্যান বানিয়েছেন কোহিনূরকে।

মমতাজ মহল বেবি

খুব বেশিদিন হয়নি প্রাক্তণ ভারতীয় ছিটমহল দাশিয়ারছড়া বাংলাদেশের অংশ হয়েছে। কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি উপজেলার অংশ এটি এখন। এই গ্রামের মমতাজ ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে একটি ছোট টিনের ঝুপড়িতে কিছু পুরনো বই, দুটো বুকশেলফ, দুটো টেবিল আর কয়েকটি চেয়ার নিয়ে শুরু করেন একটি লাইব্রেরি। তার স্বামীর কাছ থেকে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার জমি পেয়েছিলেন। তাই স্বামীর নামে লাইব্রেরির নাম দেন ‘গোলাম মাওলা আলোর দিশারী’ গ্রন্থাগার। এর আগে ব্র্যাকের একটি প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন তিনি। এখন লাইব্রেরির মাধ্যমে আলো ছড়াচ্ছেন নিজের এলাকায়।

জয়া চাকমা

রাঙামাটির মেয়ে জয়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতক শেষ করে পেশাদার ফুটবলার হন। তবে ছোটবেলা থেকেই ফুটবল খেলতেন তিনি। জাতীয় দলের সাবেক খেলোয়াড় বাংলাদেশ ফুটবলে প্রথম মহিলা রেফারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। খেলোয়াড় হিসেবে ইন্দো-বাংলা গেমস, এএফসি অনূর্ধ্ব-১৯ টুর্নামেন্ট ইত্যাদিতে অংশ নেন তিনি।

২০১২ সালে রেফারি হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন জয়া। সম্প্রতি মহিলা ফুটবল দলের বিকেএসপি কোচ হিসেবে যোগ দিয়েছেন। তার দল ভারতে খেলে পরপর দুবার ‘সুব্রত মুখার্জি কাপ’ শিরোপা জিতেছে। জয়া চাকমা জেতেন সেরা রেফারির পুরস্কার। নিয়মিত প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই করে আজকের এই অবস্থানে পৌঁছেছেন জয়া।

মারজিয়া রাব্বানী শশী

ফরিদপুরের মেয়ে জন্মান্ধ মারজিয়া অসম্ভব মনোবলের চমৎকার উদাহরণ। অত্যন্ত মেধাবী শশীর কোনোকিছু শুনলেই মুখস্থ হয়ে যেত। তাই তার বাবা তাকে স্বাভাবিক স্কুলে লেখাপড়া করান। একে একে স্কুল শেষ করে পরীক্ষার হলে বোনের সহযোগিতায় এইচএসসি পাশ করেন তিনি। এরপর চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন থাকলেও শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে পারেননি। পরে ঢাকার সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ফরিদপুর বার অ্যাসোসিয়েশনের ১৩৪ বছরের ইতিহাসে তিনিই প্রথম দৃষ্টিহীন নারী আইনজীবী। তার বাবা ফরিদপুর জেলা জজ কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী গোলাম রাব্বানী মৃধার অনুপ্রেরণাতেই আইনজ্ঞ হন শশী। মাগুরার মো. জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে বিয়ে হয় তার।

কিন্তু এত বাঁধা পেরিয়েও সুখের দেখা পাননি তিনি। বর্তমানে দুটো কিডনিই বিকল। সপ্তাহে দু’বার ডায়ালাইসিস করতে হয়। নিরাপদ কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য হাসপাতালের আইসিউতে অপেক্ষায় আছেন তিনি। আজ তার হয়ে পুরস্কার গ্রহণ করেন তার মা।

সারাবাংলা/আরএফ/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন