বিজ্ঞাপন

নির্যাতনের সংসারে ২২ বছরের লড়াই, তবুও বাঁচল না রোকসানা

March 9, 2020 | 9:30 pm

সাদ্দাম হোসাইন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: রোকসানা আক্তার (৪০)। ১৮ বছর বয়সে বাবা-মা পছন্দ করে একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন যাত্রাবাড়ির বাসিন্দা রেজাউল ইসলাম রেজা’র (৫০) সঙ্গে। কিন্তু বিয়ের আগ থেকেই শুরু হয় রেজার পরিবারের যৌতুকের মহড়া। বিয়ের মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেই ছেলেকে পুরো স্যুট না দেওয়াকে কেন্দ্র করে বিয়ে ভেঙে দিতে চেয়েছিল রেজার পরিবার।

বিজ্ঞাপন

ঠিক এমনই পরিবারে হাজারও প্রতিকূলতার মাঝে রোকসানা লড়াই করে কাটিয়ে গেছেন একে একে ২২টি বছর। ততদিনে রোকসানার কোলজুড়ে আসে দুই ছেলে-মেয়ে। সেই ছেলে মেয়েরা বড় হয়েছে, বিয়ে দিয়েছেন মেয়েকে। ছেলেও পড়ছে নবম শ্রেণিতে। তবুও তার প্রতি স্বামী-শ্বাশুড়ি-দেবরের এতটুকু মায়া হয়নি, থামেনি নির্যাতন। কখনও মানসিকভাবে, কখনও শারীরিকভাবে। এত নির্যাতন সহ্য করা রোকসানাও শেষ পর্যন্ত লড়াইয়ে হার মেনে চলে গেলেন ওপারে..!

নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যাওয়া একমাত্র মেয়ে রোকসানাকে হারিয়ে তার মায়ের এখন আপসোস- কেন সেদিন যৌতুকের দাবি মেনে নিয়ে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। এসব ভেবে ঠিক যেন নিজেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারছেন না তিনি।

বিজ্ঞাপন

ভাই রাজুর সঙ্গে ছবিতে রোকসানা

রোকসানার মা রাজিয়া বেগম সারাবাংলাকে বলেন, আমার মেয়ে ছিল একটু লাজুক আর চাপা স্বভাবের। কষ্ট পেলেও মুখ ফুটে কাউকে বলত না। এমনকি আমাকেও না। সে চাইত আজ না হয় কাল তার স্বামী ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু মেয়ের সে আশাটা পূরণ হল না। শেষ পর্যন্ত মেয়েটাকেই বাঁচতে দিলো না। অথচ আমাদের একমাত্র মেয়ের সুখের জন্য যখন যা চেয়েছে তখন তা দিয়েছি। গয়না-টাকা, খাট ফার্নিচার থেকে শুরু করে সবই দিয়েছি। এমনকি গত ৫-৬ বছর ধরে প্রতি মাসে ৮-১০ হাজার করে টাকাও দিতাম মেয়ের সুখের জন্য। তবুও এক মুহূর্তের জন্যও সুখ খুঁজে পেল না আমার রোকসানা। মেয়েটাকে তারা এতই কষ্ট দিয়েছে!

রাজিয়া বেগম চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেন, মেয়ের বিয়ে ঠিক হওয়ার পর আমাদের কাছে দশ ভরি স্বর্ণ আর একটা পরিবারের খাট-ফার্নিচার, টিভি-ফ্রিজসহ যাবতীয় যা যা লাগে সব চেয়েছে। আমরাও রাজি ছিলাম ছেলেটা ভালো মনে করে। আর আমাদেরও একমাত্র মেয়ে তাই। কিন্তু এতকিছুতে রাজি হওয়ার পরও যেদিন বিয়ে সেদিন সকালে তারা জানায়, ছেলেকে কোট-স্যুট দিতে হবে। না দিলে বিয়ে হবে না। অথচ আগের দিন ১ লাখ টাকা পাঠিয়েছি জামাই ও তাদের পরিবারের সকলের পোশাক কেনার জন্য। কিন্তু তারা এতো লোভী ছিল যে কোট-স্যুটের জন্যও বিয়ে ভেঙে দিতে চেয়েছিল। পরে আমার দেবর (রোকসানার চাচা) গিয়ে তাদেরকে কোট-স্যুট কিনে দিলে তারপর বিয়ে হয়। কিন্তু সেসময় যদি বুঝতাম তারা এত খারাপ তাহলে কোনোদিনও মেয়ে বিয়ে দিতাম না।

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, বিয়ে হওয়ার দুমাসের মাথায় ৫০ হাজার টাকার জন্য মেয়েকে মারধর করেছিল। পরে আমি ডিপিএস ভেঙে সে টাকা দিই। তখন বলেছিলাম মেয়েকে নিয়ে আসব। কিন্তু মেয়ে বলত কিছুদিন গেলে ঠিক হয়ে যাবে। ৫০ হাজার টাকা নেওয়ার ২ বছর পরে ১ লাখ টাকা নেয়। এর ২/৩ বছর পরে আরও দেড় লাখ টাকা নেয়। এভাবে প্রায় ১০-১৫ লাখ টাকা নিয়েছে আমাদের কাছ থেকে। কিন্তু কী লাভ হলো? শেষ পর্যন্ত মেয়েটাকেই মেরে ফেলল।

গত ১ ফেব্রুয়ারি শ্বশুর বাড়ি থেকে দুই সন্তানের জননী রোকসানার মরদেহ উদ্ধার করেছিল যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ। তার শ্বশুর বাড়ি রাজধানীর যাত্রাবাড়ির করাতিটোলার ৪৭/১ নম্বর বাড়িটি। ৫ তলার ওই বাড়িটির প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় রোকসানার স্বামী ও শাশুড়ি এবং দেবর ও ননদসহ যৌথ পরিবার হিসেবে বসবাস করে। বাকি ৩-৫ তলা পর্যন্ত করিম নামের এক ব্যক্তি ভাড়া নিয়ে হোটেল মেহেরান নামে একটি আবাসিক হোটেল পরিচালনা করছে।

ভাই-বাবার সঙ্গে রোকসানা

বিজ্ঞাপন

অভিযোগ রয়েছে, রোকসানাকে মারধরের পর হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ রোকসানার স্বামী ও ননদকে গ্রেফতার করে রিমান্ড শেষে কারাগারেও পাঠিয়েছে। কিন্তু রিমান্ডে আসামিরা রোকসানার মৃত্যুর বিষয়ে ঠিক কী ধরনের তথ্য দিয়েছে সে বিষয়ে জানাতে রাজি হচ্ছেন না তদন্ত কর্মকর্তা। ঘটনাটিকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলে প্রতিবেদন প্রস্তুতের চেষ্টা চলছে বলে তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রোকসানার পরিবারের।

রোকসানার ভাই রাজু আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, গত ৩১ জানুয়ারি দুপুরে আমাদের ভাগ্নে (রোকসানার ছেলে) কাঁদতে কাঁদতে আমাদের বাসায় (জুরাইন) আসল। জিজ্ঞেস করলে সে জানায়, তাকে তার বাবা, দাদি আর চাচারা মিলে মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। এর আগেও বাড়িতে মারধর করলে নানার বাড়িতে চলে আসতে সে। তারপর দুতিনদিন থেকে চলে যেত। তাই এবারও আগের মত ভেবে কিছু বলিনি। এদিন ঠিক বিকেল সোয়া তিনটার দিকে আমার নাম্বার একটা কল আসে আমার বোনের নাম্বার থেকে। রিসিভ করার পর আমি হ্যালো হ্যালো করলেও ওপাশ থেকে আমার বোন আমার সঙ্গে কথা বলতে পারছে না এটি বোঝা যাচ্ছে।

কারণ আমি মোবাইল স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি আমার বোনকে তারা (স্বামী-শাশুড়ি-দেবর) গালিগালাজ করছে ইচ্ছে মত। এভাবে প্রায় ২০/২৫ মিনিট পর মনে হলো কেউ একজন তার থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে কলটা কেটে দিয়েছে। এরপর আমি যতবারই তল দিয়েছি কেউ রিসিভ করেনি। তখনও ভাবলাম অন্যদিন যেরকম ঝগড়া হয় হয়ত এমন কিছু। তাই অত গুরুত্ব দিইনি। ভাবলাম ঠিক হয়ে যাবে। ওইদিন আর কিছু জানতে পারিনি।

পরের দিন সিটি নির্বাচন ছিল তাই সবাই নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত ছিল। কিন্তু এদিন রাত দশটার দিকে আমার বোনের জামাইয়ের নম্বর থেকে কেউ একজন কল দিয়ে বলল আপনার বোন অসুস্থ, তারে সালাউদ্দিন হাসপাতালে আনা হয়েছে। এ কথা বলে কেটে দিল। আমিও দ্রুত বাসায় এসে বাড়িতে বলেই হাসপাতালের দিকে যাচ্ছিলাম। পথে থাকতেই আবারও ফোন দিয়ে বলল, আপনার বোন মারা গেছে, হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে যাচ্ছি, হাসপাতাল যাওয়ার দরকার নাই, বাসায় আসেন। এ সময় আমি চিৎকার করে করে বলতেছিলাম, তারে হাসপাতালে রাখেন আমি আসা পর্যন্ত। কিন্তু তারা কথা শোনেনি।

আমি হাসপাতাল যাওয়ার পর ডাক্তাররা বলল, সে বহু আগেই মারা গেছে। হাসপাতাল আনার অন্তত ৭-১০ ঘণ্টা আগে। তাই আমরা তাকে ঢাকা মেডিকেল নিয়ে যেতে বলেছি।

রাজু বলেন, এরপর আমি বোনের শ্বশুর বাড়িতে দৌড় গিয়ে দেখি। তারা আমাদের জন্য অপেক্ষা না করেই বোনকে দাফনের জন্য খাটিয়া নিয়ে এসেছে। গোসল করানোর জন্য গরম পানি করতেছে। তাদের কাড়িতে নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা থেকেও তাদের আত্মীয় স্বজন এসেছে। অথচ আমাদের বাসা তাদের বাসার পাশেই। কিন্তু আমাদেরকে খবর দিল দাফন করার আগে। কতটা খারাপ তারা। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। পরে থানা পুলিশকে খবর দিলে পুলিশ এসে লাশ নিয়ে ময়নাতদন্তের জন্য মিটফোর্ট হাসপাতালে নেয়। এরপর আমরা নির্যাতনের পর হত্যা মামলা দায়ের করি।

রাজু অভিযোগ করে বলেন, ওই দিন রাতে যখন পুলিশ লাশ উদ্ধার করতে আসে তখন বাড়িতে সবাই ছিল। কিন্তু পুলিশ শুধু ছেলে রেজা আর তার বোন রিনাকে গ্রেফতার করেছিল। অথচ সেখানে মূল হত্যাকারী আমার বোনের দেবর সোহেল ও তার শাশুড়ি রিজিয়া ছিল। কিন্তু পুলিশ তাদেরকে গ্রেফতার না করে বোনের ননদ আর স্বামীকে গ্রেফতার করেছে। যে কারণে মামলার আসামি হওয়ার পর তারা দুই আসামিকে গ্রেফতার করছে না। এমনকি ওই আসামিদের অবস্থান উল্লেখ করে খোঁজ দিলেও পুলিশ আমলে নেয় না। এ রকম হলে আমরা আমাদের বোনের বিচার পাবো কী করে?

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে যাত্রাবাড়ী থানার তদন্ত কর্মকর্তা মো. বিল্লাল হোসেন জনি সারাবাংলাকে বলেন, আসামিকে ধরা হচ্ছে না এমন অভিযোগ ভুল। আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে।

যে দুজনকে গ্রেফতার করেছেন তারা কি হত্যার দায় স্বীকার করেছে? জবাবে তিনি বলেন, এটির তদন্ত চলমান। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলতে পারব না।

সারাবাংলা/এসএইচ/একে

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন