বিজ্ঞাপন

বস্তির আগুনে গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহকারী নেতাদেরও ‘কপাল পুড়েছে’

March 11, 2020 | 9:06 pm

উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: মিরপুরের রূপনগরের ‘ট‘ ব্লক বস্তিতে ভয়াবহ আগুনে পুড়েছে স্থানীয় সুবিধাভোগী বেশ কয়েকজন নেতারও কপাল। কারণ ওইসব নেতাই বস্তিতে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির লাইন সরবরাহ করেছিল। এই সব খাত থেকে প্রতিমাসে বিল আদায হতো কোটি টাকারও বেশি। আগুনে সব পুড়ে যাওয়ার কারণে এসব নেতাদেরও টাকা তোলা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

বুধবার (১১ মার্চ) পুড়ে যাওয়া বস্তিবাসী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে অবৈধ গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগের বিষয়ে জানা যায়।

জানা যায়, প্রায় ৩০ বছর থেকে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের এ জায়গাটিতে বাস ও টিন দিয়ে ঘর তুলে করে নিম্ন আয়ের লোকদের ভাড়া দেয় স্থানীয়রা। এ বস্তির পশ্চিম পাশে ৭ নম্বর ওয়ার্ড রূপনগর আবাসিক এলাকা অবস্থিত। পূর্বপাশে ৬ নম্বর সেকশন ট ব্লক আবাসিক এলাকা। দক্ষিণ দিকে ট ব্লকের বর্ধিত অংশ এবং উত্তর দিকে ঝিলপাড় বস্তি ও রূপনগর থানা।

বিজ্ঞাপন

বস্তিবাসী জানিয়েছে, গ্যাস, বিদ্যুতের যেভাবে অবৈধ সংযোগ ছিল তাতে যে কোনো সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা ছিল। আজ তাই ঘটল। আগুনে সব পুড়ে ছাই হলো। সবার স্বপ্নও পুড়ে গেল।

আলমগীর তার পরিবারকে নিয়ে পাঁচটি ঘর তুলে সাতবছর ধরে থাকতেন এই বস্তিতে। আজ সব পুড়ে গেছে। কিছু কাপড় চোপড় ছাড়া কিছুই বের করতে পারেননি।

বিজ্ঞাপন

আলমগীর জানান, তার ঘরে দুইটি গ্যাসের চুলা ছিল। গ্যাস বাবদ বিল দিতে হতো এক হাজার টাকা। ফ্রিজের বিল দিতে হতো ৪০০ টাকা। পানি বিল ১০০ টাকা দিতে হতো। সব টাকা তুলত স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা রাসেল মিয়া।

বস্তির আরেক বাসিন্দা রাবেয়া বেগম জানান, তাদের দুইটি ঘরে ১০টি রুম ছিল। পরিবার মিলে পাঁচটিতে থাকত আর পাঁচটি ভাড়া দিতো। তাদের চারটি চুলা ছিল। গ্যাস বিল দিতে হতো ২ হাজার আর বিদ্যুৎ বিল বাবদ রুম প্রতি ৩০০ টাকা। রাসেল মিয়া টাকা তুলত।

রাবেয়া বলেন, ‘প্লাস্টিকের পাইপে গ্যাস লাইনের সংযোগ দেওয়া ছিল। বস্তির ৭০ শতাংশ চুলায় গ্যাস সংযোগ দিয়েছিল রাসেল মিয়া।’

বিজ্ঞাপন

স্থানীয় আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক কানন আক্তার সারাবাংলাকে বলেন, পুরো বস্তিতে অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ দিয়েছিল রাসেল, ইউসুফ, রহিম ও আলমগীর। এরা সবাই স্থানীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত। প্রতি মাসে এক কোটির বেশি টাকা উঠত। যা সবাই মিলে ভাগ বাটোয়ারা করে নিতো। গ্যাস বিদ্যুৎ অফিসের কর্মকর্তারাও এই টাকার ভাগ পেত। পুলিশও টাকা পেতো বলে জানান তিনি।

আওয়ামী লীগের আরেক মহিলা নেত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গ্যাসের চুলা বিল, ফ্রিজ বিল, ডিস বিল, বিদ্যুৎ বিল সব খাত থেকে এই বস্তি থেকে ১ কোটি টাকার বেশি উঠত। সংশ্লিষ্ট অফিসগুলোয় মাসোহারা দেওয়ার পর বাকি টাকা ভাগাভাগি হতো।

রূপনগরের ওই বস্তির চোরাই বিদ্যুতের বিষয়টি স্বীকার করে ঢাকা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (ডেসকো) রূপনগর বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সুলতান উদ্দিন বলেন, ‘আমরা ওই বস্তিতে প্রায়ই অভিযান চালিয়ে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিই। এরপরেও তারা চোরাইভাবে লাইন টেনে নেয়। গত সপ্তাহেও আমরা কয়েকবার সেখানে অভিযান চালিয়েছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘অবৈধ বিদ্যুতের বিষয়টি সেখানকার স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ কাউন্সিলরকেও জানিয়েছি। আমরা বস্তিবাসীদের এটিও বলেছি, আপনারা খুঁটির মাধ্যমে বৈধভাবে বিদ্যুৎ নেন। আমরা বৈধভাবে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করে দেব।’

তিতাস গ্যাসের মিরপুর-১২ জোনের দায়িত্বরত কর্মকর্তা ইঞ্জিনিয়ার মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি দায়িত্বে আসার পরে এমন কয়েকটি বস্তিতে গত তিনমাসে একাধিক অভিযান পরিচালনা করেছি। অভিযানের সময় শত শত অবৈধ গ্যাসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছি। কিছুদিন আগে ওই বস্তির একপাশে আগুন লাগার ঘটনাও ঘটেছিল বলে শুনেছি। আমরা নিয়মিত আমাদের অভিযান চালিয়ে এসব অবৈধ সংযোগগুলো বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলাম। তবে অভিযান শেষ করে আসার পর আবার তারা সংযোগ দেয়। তাছাড়া অভিযানে গেলে স্থানীয় লোকজন হামলার ঘটনাও ঘটিয়েছে একাধিকবার।’

অবৈধ গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগের বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত রাসেল ও রহিমের নম্বরে কল করা হলে তারা ফোন রিসিভ করেননি।

এ সব বিষয়ে জানতে চাইলে ৬ নম্বর ওয়ার্ডের নতুন কাউন্সিলর বাপ্পী চৌধুরী ও ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের মোবাইলে বেশ কয়েকবার ফোন করেও রিসিভ করেননি। ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর রজব আলীও কথা বলতে বিব্রত বোধ করেন।

তবে সরকারি জায়গা দখলের বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরশনের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মো. মোবাশ্বের চৌধুরী বলেন, ‘অবৈধভাবে এসব সংযোগ দেওয়া আছে। গ্যাস বেলুন থেকে যে ঘটনাটি ঘটেছে তার থেকেও চলন্তিকা বস্তির মতো বড় ভয়াবহ ঘটনা তো এখানেও ঘটতে পারে। এখানে আগুন লেগে যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।

তিনি বলেন, ‘সেখানে ঘর তুলে দীর্ঘদিন যাবত তারা অবৈধভাবে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা বিষয়টি তিতাস এবং বিদ্যুৎ অফিসকে একাধিকবার জানিয়েছি। কিন্তু তারা তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তারা শুধুমাত্র দায়সারা ভাব দেখিয়েছে। তারা যদি চায় তাহলে অবশ্যই গ্যাস-বিদ্যুৎ চুরি করে লাইন নেওয়া বন্ধ হবে।’

বস্তির ওই জায়গার বিষয়ে কাউন্সিলর আরও বলেন, ‘এটি মূলত গৃহায়ন ও গণপূর্তের জায়গা। এটি একটি জলাশয়। এটি কেউ দখল করে রাখতে পারবে না। এটিকে দখল মুক্ত করে মিনি হাতিরঝিলের মতো একটি প্রজেক্ট করার পরিকল্পনা আছে আমাদের।’

সারাবাংলা/ইউজে/একে

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন